বাংলার বাণী
ঢাকা: বুধবার ২রা ফাল্গুন, ১৩৭৯ ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩
স্বাগত মহান দিবস
গত পরশুদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ‘একুশে বইমেলার’ উদ্বোধন করেছেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সপ্তাহব্যাপী এক বক্তৃতামালার আয়োজন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী এই বক্তৃতামালার উদ্বোধনী ভাষণে বলেছেন, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মচেতনার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ত্যাগদীপ্ত সংগ্রামের দিন। এই আত্মচেতনা দিনের প্রয়োজন নৈতিক ও চারিত্রিক ক্ষেত্রে বিপ্লব। এই নবগঠিত জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মবিকাশ আত্মবিশ্লেষণের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। তিনি আরো বলেছেন, কোন জাতিই বিশ্বে মর্যাদাশীল হতে পারে না যদি তার আর্থিক বা নৈতিক উন্নতি না হয়। বস্তুতপক্ষে আসন্ন একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে দেশের প্রতিটি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে করেছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হল সপ্তাহব্যাপী দেশে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের ভাষা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত বক্তৃতামালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বক্তৃতামালা শুরু হয়েছে। এর দু’টোরই উদ্বোধন করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী। জনাব চৌধুরী তাঁর সারগর্ভ বক্তৃতায় ভাষা দিবসকে জাতির আত্ম নৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লব আনয়নের দিবস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দিবস মূলত আজকের স্বাধীনতারই সর্বপ্রথম স্তর ছিল। ভাষা আন্দোলন কে যদি স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করি তাহলে আমরা দেখব ভাষা আন্দোলনের পর থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক সংগ্রাম। আন্দোলনে স্তরবিন্যাসের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন ছিল এই স্বাধীনতার প্রবেশ পথ। সেই প্রবেশপথের মধ্য দিয়েই জাতি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশের স্বাধীনতার সূর্য এনেছে ছিনিয়ে। আজ স্বাধীন বাংলার মাটিতে দ্বিতীয়বারের মতো এসেছে সেই ভাষা দিবস। এই দিনে প্রতি সত্যিকারের মর্যাদা তখনই দেখানো হবে যখন দেশের প্রতিটি কাজে কর্মে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। মায়ের ভাষার প্রতি তখনই যথার্থ সম্মান দেখানো হবে যখন এদেশের মানুষের জাতিগত সত্যিকারের উন্মেষ হবে। আত্মবিশ্লেষণ এ ও আত্মচেতনা জাতি আপন স্বাজাত্যের পরিচয়ে গর্বিত হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেসকল শিক্ষাবিদদের প্রচেষ্টায় বক্তৃতামালা শুরু হয়েছে তার অন্তর্গূঢ় কথা হবে এদেশের প্রতিটি স্তরে ভাষা প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করা ও জাতিকে তার স্বাজাত্য অভিমানে গড়ে তোলা। দেশের প্রতিটি শিক্ষিত জন যদি ভাষার প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে আসেন তাহলেই সম্ভব দ্রুত সরকারি প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন হওয়া। আমরা ‘একুশে’ সামনে রেখে দেশের প্রতিটি শিক্ষিত জনের প্রতি সেই আহ্বানই রাখবো।
বাংলাদেশ-উত্তর ভিয়েতনাম কূটনৈতিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পর্যায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। দু’টি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন আরো সুদৃঢ় করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ও উত্তর ভিয়েতনামের জনগণ একই পথের অনুসারী। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দু’দেশের সরকারের লক্ষ্য। উত্তর ভিয়েতনাম তথা সমগ্র ভিয়েতনামী জনতা বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে এবং এখনো করছে। ভিয়েতনামি বীর জনতার মনোবলকে ভেঙে দিতে পারেনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে সমগ্র ভিয়েতনামের মুক্তি পাগল জনতা আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। সকলেই কামনা করেছেন যে, আমরা যেন আমাদের সংগ্রামে জয়যুক্ত হই। জয় যখন এলো-যখন আমরা স্বাধীন হলাম, তার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশকে সানন্দে স্বীকৃতি জানালেন উত্তর ভিয়েতনাম সরকার। বাংলাদেশ সরকার ও উত্তর ভিয়েতনাম সরকারকে স্বীকৃতি জানালেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর ভিয়েতনাম ও ভিয়েতনামে মুক্তি ফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এলেন। তারা সরজমিনে দেখে গেলেন বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা। যাবার সময় নিয়ে গেলেন প্রীতি ও শুভেচ্ছা বাণী।
দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে বাংলাদেশ ও উত্তর ভিয়েতনাম আরো কাছাকাছি আসবে। সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে এক নয়া দিগন্তের উন্মোচন হবে।
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ভিয়েতনামের বীর জনতার সংগ্রাম আজকের দিনে সমগ্র এশিয়ার মুক্তিকামী মানুষদের আত্মপ্রত্যয় ও চেতনার উৎস। উত্তর ভিয়েতনামের বাংলাদেশ সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী। প্রত্যেকেরই রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস। বাংলাদেশের সরকার ও জনতা জোট নিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়-এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে।
এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলোর ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এখনো এশিয়ার বুকে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বটে তবু ভিয়েতনামের বুকে স্থায়ী শান্তি কখন প্রতিষ্ঠিত হবে একথা কেউ বলতে পারে না। ভিয়েতনামের মাটিতে এখনও বিষফোঁড়ার মতো টিকে রয়েছে থিউর সরকার। যার একমাত্র লক্ষ্য হল ভিয়েতনামি নির্জনতার মুক্তিসংগ্রামের বুকে ছুরি মারা। থিউ সরকারকে ঘিরে আবার যে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠবে না তা কে বলতে পারে। প্যাথেটলাও ও লাওসের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কম্বোডিয়ায় এখনো যুদ্ধ চলছে। মার্কিন বোমারু বিমান গুলো সেখানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনই একটি সংকটজনক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দুটো দেশ সমগ্র এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নে বিশেষ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে এই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক