বাংলার বাণী
ঢাকা: শুক্রবার ১১ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩
এবার গণ নির্দেশের পালা
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ছোট-বড় প্রায় সবকটি রাজনৈতিক সংগঠনের বক্তব্য জনগণের সামনে এসে পড়েছে। মোজাফফর পন্থী থেকেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ছাড়াও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিবারের বিভিন্ন (অস্পষ্ট) নিজ নিজ দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছেন গণতান্ত্রিক রাজনীতি অনুযায়ী দায়িত্ব এখন এসে পড়েছে জনগণের কাছে। তারা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সমস্যার প্রেক্ষিতে রচিত সংগঠনসমূহের বক্তব্য বিচার বিশ্লেষণ করবেন এবং আসর সাধারণ নির্বাচনে তাদের রায় জানিয়ে দেবেন। সেটাকে মেনে নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন সমূহ ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে যে সকল রাজনৈতিক দল জনগণের আশা-ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নন বলে অভিযোগ উঠেছে তারা অন্ততঃ সুযোগ পাবেন গণভোটের এই রাজনৈতিক ব্যারোমিটারে বাংলার মানুষের চিন্তা চেতনার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হতে।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে, বিষয়বস্তুর দিক থেকে অন্যান্য দলের সঙ্গে চার্জ রয়েছে সুস্পষ্ট প্রভেদ। অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন যখন বাস্তব অবস্থার নেতিবাচক বিশ্লেষণ নিয়ে খুব বেশি বাষ্পৃত থেকেছে আওয়ামী লীগ তখন রেখেছে সমস্যা সমাধানে সুস্পষ্ট নীতি নির্দেশ। অথচ এতে তাদের গর্বিত হবার কিছু নেই। কারণ দায়িত্বশীল এবং প্রায় দুষুগের সংগ্রামী সকল আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নিকট থেকে দেশের সার্বিক সমস্যার বাস্তবমুখী বিচার-বিশ্লেষণ এবং তার প্রেক্ষিতে আগামী দিনের পথ নির্দেশ বাংলাদেশের জনগণ স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করে। এই প্রত্যাশার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের অগাধ আস্থা-সীমাহীন বিশ্বাস এবং অকৃত্রিম ভালবাসা। তাই সংগ্রামের দিনে যেমন আত্মত্যাগের দিনে যেমন, তেমনি যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে পূনর্গঠনের দিনেও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এসেছে। সামনে তাদের কন্টকাকীর্ণ পথ কিন্তু লক্ষ্য এক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
সংগ্রামী গণ ঐক্যের কথা উল্লেখ করে দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান বলেছেন সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর এর সংগ্রামী সাধনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে যে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন স্বাধীনতা-উত্তরকালে দারিদ্র দুঃখ, অভাব অনাচার, দুর্নীতি ও সব রকমের প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার। অবশেষ এর বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে জয় যুক্ত হবার জন্য আমাদের সেই সংগ্রামী গণ-ঐক্যকে অটুট রাখতে হবে। ভবিষ্যৎ সংগ্রামের চরিত্র-চিত্রন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, পুরাতন প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা ও মানসিকতাকে বর্জন করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক জীবন-যাত্রার সোপান নির্মাণের প্রয়োজনে লোভ-লালসা হীন সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শন কে গ্রহণ করার জন্য দেশবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রকাশিত ইশতেহারের যেমন রয়েছে দলের রাজনীতি আদর্শগত দিক তেমনি সেই আদর্শের আলোকে রয়েছে সমস্যা সমাধানের বাস্তবসম্মত পথ। রয়েছে মূল শিল্প উৎপাদন যন্ত্রের উপর জনগণের মালিকানা বিস্তৃত কর্মসূচি, রয়েছে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিকভাবে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস; পণ্যের উৎপাদন এবং উন্নয়নের বলিষ্ঠ প্রত্যয়, জনসাধারণের শিক্ষা স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদান প্রভৃতি প্রগতিশীল কর্মনীতি অনুসরণ করে নিতে হয়েছে আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী মেনিফেষ্টো।
অবশ্য শুধু এটাই পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। নির্বাচনী মেনিফেষ্টো কমিটির প্রধান যেমন বলেছেন দলীয় ইশতেহার এবং এই নির্বাচনী ইশতেহার দু’টোকে পাশাপাশি সাজিয়ে পড়লেই তবে দলের মূল বক্তব্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকেবহাল হওয়া যাবে। আওয়ামী লীগ মুজিববাদের আলোকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বদ্ধপরিকর। স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশের শাসনভার গ্রহণ এরপর থেকেই আওয়ামী লীগ তার সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছে। এবারের নির্বাচনে তাই দল তার নীতি সম্বন্ধে জনগণের রায় গ্রহণে আগ্রহী। যদি জনগণ আওয়ামী লীগের পথকে ভ্রান্ত মন বলে মনে করে এবং তার বিরুদ্ধে রায় প্রদান করে তবে সেরা একে বাছাই করবার জন্যই আওয়ামী লীগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করেছে আসন্ন নির্বাচন হবে আওয়ামী লীগের দর্শন তথা মুজিববাদের ওপর গণভোট। আমরা সেই গণ নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। গণদেবতার সেই নির্দেশকে অমান্য করতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীতে নেই। বাংলাদেশের ছোট বড় সকল রাজনৈতিক দলই সেই কোনো নির্দেশ মেনে নেবেন বলে শুধু আদায় করেন নি পথে-প্রান্তরে তারস্থরে চিৎকার করে তা বিশ্ববাসীর কর্নে পৌঁছে দেবার আপ্রাণ প্রয়াস পাচ্ছেনা। এই সদিচ্ছা অক্ষয় হোক। সাতই মার্চের মধ্যে যেন তার সীমায়িত হয়ে না পড়ে। ভবিষ্যত বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে এই গণতান্ত্রিক মানসিকতা চিরজাগ্রত থাকুক, গণতন্ত্রকামী সকল মানুষের মত আমরাও তাই আশা করি।
শহীদের মায়ের কান্না
মহান একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণের দিন চলে গেলো। দেশের সকল জাতীয় সংবাদপত্র গুলোর শহীদ দিবস উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে শহীদ আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ এর মধ্যে একটি পত্রিকায় “তিনি এক শহীদের মা” শিরোনামের একটি খবর প্রকাশ পেয়েছে। নিঃসন্দেহে খবরটি হৃদয় স্পর্শ করার মতো। অবশ্য সংবাদটি যদি সত্য হয়। বায়ান্নর শহীদদের মধ্যে আব্দুল জব্বারের নাম অন্যতম। শহীদ আব্দুল জব্বারের মা আজও বেঁচে আছেন। বৃদ্ধ চপটারের মায়ের মুখে নাকি হাসি নেই। প্রতিবারের একুশে ফেব্রুয়ারীতে বৃদ্ধ তার শহীদ সন্তানের মাজারে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন। সন্তানের শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তিনি নাকি আজ অরক্ষিতা, তার দেখবার কেউ নেই। একজন মানুষের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে জীবনের বাকীটা তিনি কাটাচ্ছেন। অথচ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে একুশের শহীদ জব্বারের মায়ের জন্য কর্তৃপক্ষ কেন কিছু করেননি? একজন মায়ের একমাত্র সন্তানের উপর নির্ভরশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার যে মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে তার হৃদয়ের কান্না বোঝার মতো কোনো কর্তৃপক্ষের কি কোনদিন ছিলেন না? স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তান আমলে এই সকল সন্তানহারা শহীদদের মায়েদের দেখবার মতো কেউ ছিলনা। পাকিস্তান সরকারের কাছে তা আশা করাও ছিল বৃথা। দেশের স্বাধীনতা লাভের পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। শহীদ জব্বার এর মায়ের কান্না যখন দেশবাসী শুনবে তখন তাদের মনেও একটা স্বাভাবিক ক্ষোভের ছায়া নামবে। যখন দেশের মানুষ জানবে একুশের শহীদদের চেয়ে এই দিনটিকেই শুধু বড় করে দেখা হচ্ছে তখন দেশবাসী কর্তৃপক্ষকে মূর্খ ভাববে। একুশে শহীদ দিবস যেমন মহান, ঐদিনের শহীদদের জীবন বিসর্জন তেমনই অনন্ত ঘটনা। তাই শহীদদের যাঁরা আজও বেঁচে আছেন বিশেষ করে জব্বারের মায়ের নেয় যারা আজও পথে পথে দরিদ্রতার বিষ জ্বালা বুকে নিয়ে সন্তানের জন্য কেঁদে ফেরেন তাদের প্রতি সরকারের অবশ্যই কিছু করণীয় রয়েছে। আর সে দায়িত্ব সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কেন এতদিন সেই নৈতিকতাকে কর্তৃপক্ষ বিসর্জন দিয়েছেন তা আমরা জানিনা। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে অবিলম্বে জব্বারের মায়ের মত বাকী জীবনের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। এবং একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ সকল পবিত্র নামের যাদের আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে মা, বাবা, ভাই-বোন রয়েছেন তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কতৃপক্ষকে নিতে হবে। একুশে শহীদ জব্বারের মায়ের দারিদ্রতার কান্না দেশের মানুষ কোনদিন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ভবিষ্যতে বরং দেশবাসী জানতে চাইবে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ বরকত-সালাম-রফিক-জব্বারের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনের জন্য কর্তৃপক্ষ কি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সরকার এ প্রশ্নের একটা সঠিক ও সহানুভূতিশীল উত্তর দেবেন বলে আমরা আশা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক