You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952 | একুশের স্বাতন্ত্র্য চেতনা : সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারা ডঃ মহীউদ্দীন খান আলমগীর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ - সংগ্রামের নোটবুক

একুশের স্বাতন্ত্র্য চেতনা : সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারা ডঃ মহীউদ্দীন খান আলমগীর

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪

সন্দেহাতীতভাবে একুশ বাংলাদেশের সাহিত্য ও শিল্পকর্মে স্বাতন্ত্র্যবোধ, সৃজনীশক্তি, সাহসিকতা ও মুক্তবুদ্ধির দীপ্ত ভিত্তি ও অবিনাশী সঞ্চালক। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের সাহিত্য ও শিল্পকর্মের এই বিকাশ পরিমাণ ও উৎকর্ষতার মানদন্ডে যুগবৎভাবে প্রসারিত ও সুদীপ্ত বলে যে কোন পর্যবেক্ষকের কাছে প্রতীয়মান। এই বিকাশের ক্রম-বিশ্লেষণে (অতিসরলীকরণের প্রান্তিক সম্ভাবনা স্বীকার করে নিয়েও) প্রধানতঃ ৩টি পর্যায় প্রকৃতি ও পদ্ধতিগভাবে হয় বলা চলে।
প্রকৃতিগতভাবে সাহিত্য ও শিল্পকর্মের বিকাশ প্রথম পর্যায়ে প্রধানতঃ অতি মানবিক ও অলৌকিক বিষয়সমূহকে বাদ দিয়ে মানবতাবোধকে স্থান দিয়েছে। এই মানবতাবোধের প্রতিচ্ছবি ছিল মানবিক গুণের ও সংবেদনশীলতার যা সাধারণ মানুষের অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে প্রতিভাত করা ছিল এই ক্ষেত্রে প্রচেষ্টার লক্ষ্য। এবং এই ধরনের অনুকরণীয় লক্ষ্য বলেই তা ছিল রক্ত মাংসের সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখের অনুভূতির বাইরে, আশা-আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে। ৫০-এর দশকে সাধারণভাবে প্রতিভাত সাহিত্য ও শিল্পকর্মের মুক্তির এই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। দ্বিতীয় পর্যায়ে, ৬০-এর দশকে এলো সেই চরম যখন সমকালীন আর্থ-সামাজিক পরিবেশে সাধারণ মানুষের চারপাশে, ‘বুকের পাঁজর, ফুসফুস, পাকস্থলী, প্লীহায়, যকৃতে আর অন্ত্রের গলিতে দুঃখ তার লেখে নাম এবং দুঃখ থেকে মুক্তির স্বপ্নে ফুসিয়ে উঠে মানুষ ‘মাইনষের রক্ত’ শরীরে প্রবাহমান থাকার সচেতনতায়। এই সেই সময় যখন সাধারণ মানুষ চায় মুক্তি, আত্মবিশ্বাসের দীপ্তিতে বলীয়ান হয়ে বলতে চায়, ‘পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, জ্বলন্ত জ্যোৎস্নার ধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক, এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’। তৃতীয় পর্যায়ে আশা-নিরাশা এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির দ্বন্দ্বের, যার শুরু ৭০-এর দশকে। এই দশকের মানস-প্রকৃতি প্রতিফলিত হয়েছে এক নতুন পৃথিবী থেকে অবহেলিত ও বঞ্চিতের প্রত্যাশায় উচ্ছ্বাসের আবর্তে তলীয়মান বাস্তবতায়, সুযোগ-সন্ধানীর কূটচক্রে সরল-সাধারণ্যের থমকে দাঁড়ানোয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল বিভ্রান্তির প্রতিরোধের দৃঢ় সংকল্পে। পরাধীনতার রাহুতে অভুক্ত ছিলাম, স্বাধীনতা তাই সরল, অথচ ইস্পাত কঠিন দাবী—‘ভাত দে হারামজাদা’। অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিকে যে স্বাধীনতার প্রত্যয়, তারই কি ফলশ্রুতি হিসাবে সত্যিই দেখি, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ।’ এই সময়ে আমার জিজ্ঞাসা, ‘বেতারে বেতারে টাইশোভিত ঘোষকের ললিত কন্ঠে কাদের শোনিত পিপাসার স্তুতিগান…..‘শহীদের রক্তে বারবার ভিজে যাচ্ছে মাটি, আমার আনুগত্য রাখি কোথায়, কোথায় রাখি আমি?’
সাহিত্য ও শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে একুশের স্বাতন্ত্র্যবোধের এরূপ প্রকৃতিগত বিকাশ পদ্ধতিগতভাবে ক্রমান্বয়ে তিনটি বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত করেছে বলা চলে। প্রথমতঃ একুশের চেতনা সাহিত্য, শিল্পকর্ম ও চর্চাকে জলসাঘর, স্থানীয় বিত্ত নির্ভরশীলতা ও তুষ্টির গন্ডির বাইরে এনে সাধারণ মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে প্রেরণা যুগিয়েছে। জমিদার বাড়ির বিকল্পে গ্রামের প্রাথমিক স্কুল, লাখপতির আবাস-আঙ্গিনা পর হয়ে অবারিত উন্মুক্ত প্রান্তর, শান বাঁধানো ঘাট উৎরিয়ে মেঠো সড়ক আর জনপথে জনতার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন, কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক ও শিল্পী/নাটকের উপস্থাপনা, সঙ্গীতের আনুগত্যবোধ ও শিল্পীর ছবি লেখা ব্যক্তিগত বিত্তের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে, সাধারণ চিত্তের বিত্ত প্রসারণে গৌরবান্বিত হতে চেয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের এই গণ-উন্মেষমুখী ধারা কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে বৈদগ্ধের আবরণে কেমন যেন নগরমুখী হয়ে গেছে। ৬০-এর দশকে এ নগরকেন্দ্রিক চর্চা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিচ্ছুরণের কেন্দ্র হিসাবে নগর থেকে সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রে নতুন ভাবনা ও প্রয়োগ কৌশল দেশের ৮১০০০ গ্রামে যেতে যেতে যেন আটকিয়ে গেছে, চলিষ্ণু প্রাণচাঞ্চল্য, চিত্তের উদার ও প্রগতিশীল, প্রসারণ থমকে দাঁড়িয়ে গেছে শিক্ষার ও আত্মবিকাশের প্রাকৃতিক সুযোগের অসম প্রয়োগের কারণে। যার ফলশ্রুতি হিসাবে সম্ভবতঃ তৃতীয় পর্যায়ে এই দশকে ৬৯-এর গণজাগরণ এবং ৭১-এর মুক্তি সংগ্রামের পরেও নগরে ‘কীর্তন খোলা’র দাহ, ‘সাত পুরুষের ঋণে’র পরিশোধন এবং ইবলিশের সনাক্তকরণের সাথে পরিচয় সম্প্রসারণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেখতে পাচ্ছি সারা দেশে প্রায় ৮০% জনসাধারণ রয়ে গেছেন বাংলা অক্ষর জ্ঞানের পরিধির বাইরে; প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার দাবীদার দেশের সকল শিশুর ৬০% ভাগ শিক্ষার মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত, খোর-পোষ সমর্থনের অনুপস্থিতিতে এই প্রাথমিক পর্যায়েই প্রথম শ্রেণীর তুলনায় পঞ্চম শ্রেণীতে অবলোপন হার উঠে এসেছে ৬৫% ভাগে। দেখতে পাচ্ছি যে শিক্ষার সর্বস্তরে এখনও বাংলা ভাষার সার্বিক প্রচলন ঘটেনি, সকল বিষয়ে যথাযথ পরিভাষার উদ্ভাবন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতরা মাথা চুলকাচ্ছেন, তাৎপর্য বিরল বিতর্কে গমগীন থাকছেন। দেখতে পাচ্ছি, অন্যান্য ভাষা, সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞান কর্ম থেকে ফলপ্রসূ নিসর্গ আহরণের প্রচেষ্টা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রকৃতিগতভাবে একুশের স্বাতন্ত্র্য সাহিত্য শিল্প ক্ষেত্রে লক্ষ্য সম্পর্কে স্থির-প্রত্যয় অর্জন করা সত্ত্বেও পদ্ধতির সর্বাঙ্গীন উদ্ভাবনের অভাবে এবং যথার্থ প্রয়োগের অনুপস্থিতিতে লক্ষ্যে পৌঁছানোর গতি ক্রমান্বয়ে শ্লথ হয়ে যাচ্ছে।

দুই
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একুশের স্বাতন্ত্র্য চেতনা, পর্যায়ক্রমে গণতান্ত্রিক মানবিক অধিকার, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামের মৌল ভিত্তি ও প্রেরণার উৎস অবয়বে ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বান—‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারী উৎসারিত স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের সংগ্রামের তৎকালীন পর্যায়কে বিশেষায়িত করেছে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নবেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে এই স্বাতন্ত্র্যবোধের দলিলায়িত ফলশ্রুতি হিসাবে বাংলাদেশের জনগণ অঙ্গীকার করেছেন যে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ এই অঙ্গীকার অনুযায়ী সাংবিধানিক প্রাধান্যের মৌল ভিত্তি ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক’ হিসাবে জনগণকে দায়িত্ব দেয়া এবং জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালানার ৪টি মূলনীতির মধ্যে দুটো মূলনীতি হিসাবে গৃহীত হয়েছে। গণতন্ত্র উদ্ভূত, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধ এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ রাষ্ট্র পরিচালনার অনুসরণীয় নীতি হিসাবে সাংবিধানিক মর্যাদাও প্রাধান্য পেয়েছে; জনগণের মৌলিক অধিকাররূপে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ, গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবজ, জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ, চলাফেলা, সমাবেশ, সংগঠন, চিন্তা, বিবেক, বাক ও বুদ্ধির স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রত্যয়সমূহের প্রয়োগ ও বিস্তরণের প্রতিকূলে মোটামুটিভাবে দুটি নিয়ামক কাজ করেছে বলা চলে। প্রথমতঃ একুশের স্বাতন্ত্র্য উজ্জীবিত রাজনৈতিক অধিকারের প্রত্যয় নির্ণয় ও অর্জনের সংগ্রামকালে ৫০ ও ৬০-এর দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর রূপরেখা ও প্রক্রিয়া সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে অর্থনৈতিকভাবে পৃথকীকরণ ও সামাজিকভাবে মেরুকরণের অশুভ প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়নি। রাজনৈতিক অঙ্গনের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রথাগত রাজনৈতিক প্রভুদের কাতারে উঠিয়ে তাদের আপেক্ষিকতার সম-অধিকার পেতে চেয়েছিলেন। আর সাধারণ কর্মী, সহযোগী ও জনগণ সার্বিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এসব অধিকার অর্জনকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিতে সম-অধিকার অর্জনের নামান্তর মনে করেছিলেন। কেবলমাত্র কিছু বামপন্থী চিন্তাশীল ব্যক্তি একটি যথাযথ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে লক্ষ্য হিসাবে স্থিরীকৃত রাজনৈতিক অধিকার অর্জনকে বাস্তবক্ষেত্রে ফলবহ করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক সংগ্রামের সার্বিক উন্মাদনায় এবং দ্রুত প্রাপ্তির স্বপ্নিল মোহে এ প্রয়োজন মেটানোর দিকে জাতিগত দৃষ্টি দেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। দ্বিতীয়তঃ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রত্যয় ও লক্ষ্যসমূহ জাতিগতভাবে স্থিরীকৃত হওয়া সত্ত্বেও এসব ক্ষেত্র পর্যায়ে বাস্তবায়ন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করার জন্য প্রশাসনিক কাঠামোর যথাযথ সংশোধন সংস্কার কিংবা বিকল্পায়নের রূপরেখা স্বাধীনতার আগের দুই দশকে করা হয়নি। ফলে স্বাধীনতাউত্তরকালে একটি সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সংস্কার বা বিকল্পায়নের বদলে, কিংবা বিকল্প অবয়ব স্থির না করে আমরা অস্তিত্বমান প্রশাসনিক কাঠামো ও পদ্ধতি বহুলাংশে ভেঙেছি, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার অনুকূলে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যবহারের পথ উন্মুক্ত করেছি। ফলে একুশের স্বাতন্ত্র্যে উৎসারিত রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রত্যয়গতভাবে স্থিরীকৃত হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয় পর্যায়েই, যথার্থ প্রয়োগ-অনুগামী কাঠামো ও পদ্ধতি উদ্ভাবনের অনুপস্থিতিতে, খর্ব ও ব্যাহত হয়েছে। সর্ব পর্যায়ে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার ভূমিকা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিংবা গোষ্ঠীভিত্তিক শক্তির দাপটে স্তিমিত হয়ে গেছে, ইমদুদের লাগামবিহীন বিচরণে আইনের শাসন লজ্জায় নীরবে নির্ভতে আশ্রয় খুঁজেছে, ব্যক্তি, সংবিধানকালে বাক ও বিবেক, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা সংবিধানের মুদ্রিত অবয়বের বাইরে সম্প্রসারিত হওয়ার পরিধি ক্রমান্বয়ে খর্ব হয়ে গেছে।

তিন
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একুশের স্বাতন্ত্র্য চেতনা আঞ্চলিক সম-উন্নয়নের প্রত্যয় ও দাবীর জন্ম দিয়েছে। ’৫৬ ও ’৬২ সালের তৎকালীন পাকিস্তানের সংবিধান গ্রহণের আগে সম-উন্নয়নের দাবীর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের আর্থিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্টকরণের প্রস্তাব দেয়া, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আঞ্চলিক সমতার প্রশ্ন এবং এ বিষয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের অবতারণাকরণ এই স্বাতন্ত্র্যবোধেরই অর্থনৈতিক অভিব্যক্তি হিসাবে বিবেচ্য। ৬৯—৭০ সালের গণ-আন্দোলনের ও ৭১ সালের স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রবাহে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম-উন্নয়ন তথা ইস্পিত উন্নয়নের দাবী ও প্রত্যাশা রাজনৈতিক দাবী ও প্রত্যাশার সহযোগে নির্ণায়কের ভূমিকা নিয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার সংজ্ঞায়ন ‘স্বাধীনতা তুমি’ ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি…..তুমি মজুর-যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গন্থিল পেশী’ একুশ হতেই উৎসারিত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দীপ্ত কর্ম-সৃজনশীলতার ভিত্তিতে সম্প্রসারিত পার্থিব লভ্যতার শক্তিতে ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবেরন উৎকর্ষতা বর্ধনের সামাজিক স্বপ্ন এই সংজ্ঞায়নে রূপ পেয়েছে। ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্যতম মূলনীতি হিসাবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা হয়। সাংবিধানিক প্রাধান্য দিয়ে ঘোষণা করা হয় ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে। এই গৃহীত সূত্র অনুযায়ী, উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বন্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হিসাবে জনগণকে স্বীকৃত দেয়া; ‘মেহনতি মানুষ-কৃষক-শ্রমিক ও জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দেয়া, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধনের’ ভিত্তিতে সকল নাগরিকের জীবনের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করা এবং সুষম উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসাবে স্থিরীকৃত করা হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এইসব প্রত্যয় ও প্রকৃতিগত লক্ষ্য স্থিরীকৃত হয়েছে সত্য কিন্তু এখানেও স্থিরীকৃত লক্ষ্যসমূহ অর্জনের উদ্দেশ্যে যথার্থ প্রক্রিয়া নির্দিষ্টকরণ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। প্রক্রিয়া নির্দিষ্টকরণের দুবর্লতা মোটামুটিভাবে তিন পর্যায়ে কিয়বা অবয়বে এক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে বলা চলে। প্রথমতঃ ৫০-এর দশকে অর্থনৈতিক সম-উন্নয়ন ও সাধারণ মুক্তির প্রত্যয় সুচিন্তিত ও নির্দিষ্ট পথ ধরে সেই সময়কার কৃষক আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করতে এগিয়ে যায়নি। প্রায় সমকালীন তেভাগা আন্দোলনে, জমিদারী উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় ভাগ বা বর্গাচাষীকে পরিব্যাপন স্বত্ব দেয়ার দাবীর অনুকূলে এবং রফতানীকৃত পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার উন্নয়ন উদ্দেশ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে স্থানান্তকরণ ও আমদানী বাণিজ্য ক্ষেত্রে পশ্চিমাঞ্চলীয় বণিকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিকূলে একুশে স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রত্যক্ষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। এর কারণ সম্ভবতঃ তখনও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য উপকরণ কিংবা নিয়ামক হিসাবে যথার্থভাবে স্বীকার করা হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬০-এর দশকে আঞ্চলিক সম-উন্নয়নের দাবী, আমদানী-রফতানী বিন্যাস, সঞ্চয় আহরণ ও বিনিয়োগ বিভাজন সম্পর্কে সুতীক্ষ্ম বক্তব্য ও প্রতিবাদের মাধ্যমে ২১শের স্বাতন্ত্র্য প্রতিভাত হয়েছে; অথচ, অন্তঃসমাজের ইস্পিত অর্থনৈতিক কাঠামো, আয় বন্টন বিন্যাস, বিনিয়োগ-প্রযোজনা, সম্পদ মালিকানা ও মূলধন-শ্রমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত কোন রূপরেখা উপস্থাপিত হয়নি। ফলতঃ ভূমি সংস্কারে প্রয়োজন, গ্রামাঞ্চলে শক্তি কাঠামোর অশুভ প্রভাব ও দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থিত জনগণের উপযোগ বিনিয়োগ প্রযোজনার প্রস্তাব ততটা সোচ্চারিত হয়নি যতটা হয়েছে আঞ্চলিক ভিত্তিতে সম্পদ, আয় ও বিনিয়োগ বিভাজনের দাবীর। ফলে তৃতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতার পরবর্তী দশকে এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মস্পৃহার অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি। সৃষ্টি হয়েছে বেশকিছু চ্যুতি ও বিভ্রান্তির। এইসব চ্যুতি ও বিভ্রান্তির এক বিশেষ দিক প্রতিভাত হয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানা ও উদ্যমের সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় গ্রহণীয় ভূমিকার রূপরেখা নির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসাবে উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বন্টন প্রণালীসমূহের গণ-মালিকানা নিয়ন্ত্রণকে গ্রহণ করা হয় এবং সকল নাগরিকের জন্য ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে প্রত্যেককে কর্ম অনুযায়ী’ সূত্রমাফিক স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। নীতি বা সূত্র হিসাবে এই ক্ষেত্রে তর্কের তেমন কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু পরিধি ছিল বিস্তারিত কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করার। কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির অবর্তমানে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উদ্যম, রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উৎপাদনশীল সম্পদে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অন্য একদিকে এসব চ্যুতি ও বিভ্রান্তির প্রতিফলন ঘটে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রক্রিয়া পদ্ধতি সংস্কার উদ্ভাবন বা সম্প্রসারণের ব্যবস্থা হাতে নেয়া হয়নি। গণক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হলো, অথচ ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের পরিধি বিস্তৃত ও সুসংহত করা হলো না। উৎপাদন বর্ধনের কথা কথা হলো, অথচ উৎপাদন বহির্ভূত কর্মকান্ডে পারদর্শিতা কিংবা অংশগ্রহণকে নিপূণতার মানদন্ড দেয়া হলো। বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ বাড়িয়ে জনকুশলের পরিধি বিস্তারণ উদ্দেশ্য হিসাবে বিবৃত হলো, অথচ সার্বিকভাবে গণক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কিংবা শক্তিমান গোষ্ঠীর অর্থ সংস্থানকল্পে বা কায়েমী স্বার্থ আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রসারণকল্পে ব্যবহার্য হয়ে দাঁড়ালো।

চার
সামাজিক ক্ষেত্রে একুশের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় অবদান ধর্মনিরপেক্ষতা। ভাষা, সাহিত্য শিল্পকর্ম, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে কেবলমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার সাম্প্রদায়িকত ও ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে একুশের স্বাতন্ত্র্য বের করে এনে মুক্ত, প্রগতিশীল ও উদার মূল্যবোধের বিশাল পৃথিবীতে উৎসারিত করেছে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রতিকূলে দুই দশকের প্রায় বিরামহীন সংগ্রামের পর ১৯৭২ সালে গৃহী সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার গ্রহণ এক্ষেত্রে মুক্ত ও সামাজিক মূল্যবোধের বিজয় ঘোষণা করেছে। এই মূলনীতি উদ্ভূত অনুযায়ী সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক, মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা বিধান, মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ, সর্বস্তরের জনগণকে জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার ও অংশগ্রহণ করার সুযোগ প্রদান, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণ বৈষম্য দূরীকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সামাজিক ক্ষেত্রে একুশের স্বাতন্ত্র্য সমসচেতন ভূমিকা পালন করেছে বলা চলে। মানবাধিকার ও স্বাধীনতা দান হিসাবে দেয়া কিংবা পাওয়া যায়না, ত্যাগের বিনিময়ে সচেতন সংগ্রামের ভিত্তিতে অর্জন করতে হয় হৃদয়ের আনুগত্যবোধ দিয়ে নিয়ত সংরক্ষণ করতে হয়—একুশের এই অনুশাসন, এই শিক্ষা-সমাজ ও সংস্কৃতির সকলক্ষেত্রে গণজাগরণকে উজ্জীবিত ও প্রভাবিত করে এসেছে। ‘পলাশতলীর হাড্ডীসার ক্লান্ত ফতুর কৃষক’, ‘ঝড় বাদলের নিত্য সহচর মেঘনার মাঝি’, ‘চটকলের শ্রমিক’, কামারের নয়ন’, ‘পুত্তলি’, ‘মাটিলেপা উঠানের উদাস কুমোর’, ‘সঙ্গীহীন তাঁতী’, ‘রাজস্ব দফতরের করুণ কেরানী উজ্জ্বল তরুণ ছাত্র’, ‘নব্যকালের লেখক’—সমাজের প্রায় সর্বস্তরের জনগণ ‘জীবনের ডাকে’ প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারীতে সমবেত হন, চতুর্দিকে ‘মানবিক বাগান’ আর ‘কলমবন’ তছনছ হতে দেখে সালাম বরকতের উত্তরসূরী হয়ে রাজপথে নামেন, শূন্যে তোলেন ফ্লাগ, বুকে পেতে দেন ঘাতকের থাবার সম্মুখে। ৫২ থেকে ৮২ পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের, জীবনচাঞ্চল্যের, চলিষ্ণু বিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু শহীদ মিনার-উৎস ২১ ফেব্রুয়ারীর সম-সচেতন-বিবেকবান।
প্রত্যয় ও প্রকৃতিগতভাবে এই স্বাতন্ত্র্য সম-সচেতন বিবেকায়নের উৎস হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে সত্যি, কিন্তু তথাপিও যথার্থ প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে বা পদ্ধতিগতভাবে সম্ভবতঃ সকল ক্ষেত্রে ইস্পিত মাত্রায় ফল দিতে সক্ষম হয়নি। এই বিবেকায়ন প্রক্রিয়ায় সংগঠিত নগরাঞ্চলীয় বা শিল্প শ্রমিক শরীক হয়েছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংগঠিত ক্ষেত-মজুর এখনও অসংশ্লিষ্ট রয়েছেন, উপজাতীয়রা, বেদে ও ঋণি সম্প্রদায়, চা বাগানে কর্মরত কুলী-কামীন, দীপাঞ্চলের জেলেরা এবং সর্বোপরি গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত জনসাধারণ এখন সম-সচেতনতায় উজ্জীবিত হয়ে বিবেকায়িত প্রক্রিয়ায় শ্রেণীগত সমান অধিকার আদায়ে তৎপর হয়ে উঠেননি। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো ও প্রক্রিয়ায় এই সংখ্যাগরিষ্ঠের শ্রেণী সচেতন ও কার্যক্রম প্রতিনিধিত্ব আনেনি। ফলে ছায়াঘেরা গ্রামের গোলাপীরা জীবনের প্রয়োজনে ট্রেনে উঠে আসছেন বেল তৈলের জরীমন ও অন্যান্যদের সংখ্যা বুভুক্ষের ক্ষুধা ও বঞ্চিতের তৃষ্ণা বেড়েছে। ফলে ৮০ দশকের শুরুতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সকল গৃহস্থালীর ৫২% কার্যতঃ ভূমিহীন, অথচ ২২% গৃহস্থালী ৭৫% কর্ষণযোগ্য ভূমির মালিক; এখনও এই দেশে সকল গৃহস্থালীর ৫৯% ভাগ ক্যালরী, ৬০% ভাগ প্রোটিন, ৮১% ভাগ ক্যালসিয়াম, ৮৯% ভাগ ভিটাটিমন এ, ৮৫% ভাগ রক্তের লৌহিত কণিকা ও ৩৩% ভাগ ভিটামিন সি’র স্বল্পতায় ভুগছেন। বস্তুতঃ এখনও জাতিগতভাবে আমরা সচেতন নই যে অপুষ্টির এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই জাতি ও দেশের সংস্কৃতি আগামী ১০ বছরে প্রতিবন্ধীর অভাবনীয় সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে।
০০০