1950 | পঞ্চাশের দশকে আমরা | মোহাম্মদ সুলতানের সঙ্গে ফয়েজ আহমদের কথোপকথন
সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪
[আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত (১৯৫২) ও সম্পর্কিত নানা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কয়েকটি বৈঠকে সুলতানের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়। প্রধানতঃ পঞ্চাশ দশকের রাজনৈতিক ঘটনার বিশেষ বিশেষ দিক এই সমস্ত অনির্ধারিত ও তাৎক্ষণিক আলোচনা স্থান পায়। পুরনো ঢাকার শ্রীশ দাস লেনস্থ এক তস্য গলিতে শতবর্ষের জীর্ণতার ভাড়া করা গৃহে বা আমার তোপখানাস্থ বাসায় এ জাতীয় আলোচনা উঠতো—আমি কোন কোন সময় বন্ধু সুলতানের বক্তব্য, যা, আমি ইতিহাসের অংশ বা ইতিহাসের উপাদান বলে মনে করেছি, টেপবদ্ধ করে রাখতে উৎসাহী ছিলাম। সে সমস্ত টেপে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও দেশের প্রথম প্রগতিশীল প্রকাশনালয় পুঁথিপত্রে’র প্রতিষ্ঠাতা এবং একুশের প্রথম প্রামাণ্য সংকলন-পুস্তকের প্রকাশক সুলতানই প্রধান কথক; আমি শ্রোতা ও প্রশ্নকর্তা। টেপ থেকে প্রাপ্ত বিশ্বস্ত অনুলিপির সংশ্লিষ্ট অংশ বিশেষ এখানে উপস্থিত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এদেশে বিরল চরিত্রে অধিকারী এবং প্রগতিশীল ও বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের সঙ্গে আজীবন সম্পর্কিত রাজনৈতিক নেতা কমিউনিস্ট মোহাম্মদ সুলতানের টেপবদ্ধ আলোচনার বিষয়বস্তুসমূহকে আমি বর্তমানে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। লেখক।]
ফয়েজ আহমদ : তুমি তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে গভীর সম্পর্কিত, আমি জানি। আমার অনেক বন্ধুই ছিলেন। যত দূর মনে পড়ে, তুমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র।
মোহাম্মদ সুলতান : এম, এ ক্লাসেরও ছাত্র।
ফয়েজ আহমদ : দ্বিতীয় পর্যায়ের (১৯৫২) ভাষা আন্দোলনে বহু ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতা বিভিন্ন স্তরে ফেব্রুয়ারী মাসে জড়িত ছিলেন। এর ইতিহাস আজকে প্রায় ঊনত্রিশ-ত্রিশ বছর পরে অনেকে সঠিকভাবে বর্ণনা করেছেন বলে মনে হয় না। অনেক অংশ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হচ্ছে বলে কেউ কেউ বলছেন। তবে এমনও হতে পারে যে স্মৃতিভ্রম অথবা সবটা মনে নেই। দীর্ঘদিনের ব্যাপার। আমার যতো দূর ধারণা, তোমার মোটামুটিভাবে অনেক অশ সঠিক জানা। অনেক নোটও আছে। রাজনীতি কিভাবে আসল; কারা প্রকৃতপক্ষে ১৪৪-ধারা ভঙ্গ করলো। কাদের কারণে এ আন্দোলন সে সময় একটি বিশেষ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো এবং আমাদের দেশের নাগরিক ভাষার জন্যে শহীদ হলো—সেই সম্পর্কেই তোমার বক্তব্য টেপবদ্ধ করে রাখতে চাচ্ছি।
মোহাম্মদ সুলতান : সত্যিকারভাবে ভাষা আন্দোলন দু’টো পর্যায়ে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের ‘মহা শক্তিশালী মানব’ জিন্না সায়েব ঢাকায় ঘোষণা করলেন উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। তখন প্রধানতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভয়ঙ্কর প্রতিবাদ করে, ১১ মার্চে সে আন্দোলন শুরু। সে সময় আমি রাজশাহী কলেজের ছাত্র হিসেবে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলাম। কিন্তু ১৯৫২ সালের (ঢাকায়) আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। তখনকার ঘটনা যতোট বলা সম্ভব বলতে পারি।
ফয়েজ আহমদ : বাহান্ন সালের ঘটনা, প্রেক্ষিত, তার সঙ্গে কারা জড়িত, কারা মিলিটেন্ট ছিলেন এবং কাদের উদ্যোগেই একশ’ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করা হয়, সেটাই।
মোহাম্মদ সুলতান : ঊনপঞ্চাশ সালে আমি ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই—বলছি, এ কারণে যে প্রেক্ষিতটা সকলের মনে রাখা দরকার। ছাত্ররাই ১৯৪৭ সালে প্রধানতঃ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির উপর হামলা প্রতিবাদ করেছিল। সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাস্তবতঃ সে সময় আমাদের দেশে বামপন্থী বা প্রগতিশীল কোন শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠেনি। ঢাকায় এসে দেখলাম যে, তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের সামান্য একটি অংশ অর্থাৎ দু’চারজন কাজ করছেন। ছাত্র লীগ বলতে শেখ মুজিব সায়েবের পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ছিল; আর শাহ আজিজ সায়েব বা নাজিমুদ্দিন সায়েবের ছিল নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। এ দু’টো প্রতিষ্ঠান প্রধানতঃ গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে, সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের জন্যে, রাজনৈতিক সামগ্রিক মুক্তির সংগ্রামের জন্যে ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। আমরা যার জন্যে মনে করলাম যে, যে কোন জায়গা থেকে (সরকারের) গণবিরোধী কর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ বেতন বাড়লো এবং একান্ন সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন চলছিল। এমন সময় ১৯৫২ সালে জানুয়ারী মাসের ঘটনা এবং প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন সায়েব ঢাকায় ঘোষণা করলেন যে, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় আটচল্লিশ সালের ন্যায় সবাই প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। সে আন্দোলনের সময় একটা বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হ’য়ে দাঁড়ায়; এখনো প্রত্যেকের তা’ জানা দরকার। পাকিস্তান প্রধানতঃ পাঁচটি ভাষার রাষ্ট্র ছিল—বাংলা, সিন্ধী, পাঞ্জাবী, পসতু ও গুজরাটি। এই ভাষাগুলোর একটিকেও পাকিস্তান সরকার স্বীকার করলেন না। শাসকবৃন্দ নিজের ভাষা উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইলেন।
ফয়েজ আহমদ : তুমি বলতে চাও, উত্তর ভারতের যে সাধারণভাবে চলতি ভাষা উর্দু, সেটাই তারা চালু করতে চান।
মোহাম্মদ সুলতান : হ্যাঁ, পাকিস্তানের কোন অংশেই কোন লোকই উর্দুই ভাষা জানতো না বা উক্ত ভাষায় কথা বলতো না। কিন্তু যারা মূল শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলেন, তাদেরই ভাষা ছিল উর্দু এবং এই উর্দুকে চাপিয়ে দিয়ে তারা রাজনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ব্যবস্থা বজায় রাখার ঘৃণ্য চক্রান্ত অবলম্বন করেন। এই চক্রান্ত বুঝতে আমাদের বিলম্ব হয়নি। সুতরাং আমরা মনে করি যে এর বিরুদ্ধে সবল ও শক্তিশালী প্রতিবাদ হওয়া দরকার।
ফয়েজ আহমদ : সেই আন্দোলনের সময়কার অনেক তর্ক-বিতর্কের কথা নিশ্চয়ই তোমার মনে পড়ে? পাকিস্তানের নিজস্ব ভাষাগুলো ছিল অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রত্যেকের ঐতিহ্য আছে। উর্দুর তেমন কোন ঐতিহ্য ছিল না; ছিল না বলে এর কোন ‘ফোক’ নেই কিন্তু। তুমি জান বর্তমানে সমৃদ্ধ উর্দু একটি আহরিত বা তৈরি করা ভাষা। প্রথমে এই ভাষার প্রতি কারো কোন বিদ্বেষ ছিল বলে আমার মনে হয়নি। একটা বিদেশী ভাষারূপে চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারের আপত্তিটা ছিল প্রধানতঃ। মূলতঃ সেটা রাজনৈতিক কারণেই। ভাষার প্রতি কোন বিদ্বেষ প্রকাশের অবকাশ ছিল না—ভাষা তো মানুষেরই। কিন্তু তখন সরকার (আমাদের) ভাষা বিদ্বেষী বলে প্রচার করতে চেষ্টা করেছিলেন।
মোহাম্মদ সুলতান : সঠিক বলেছ তুমি। ’৪৭ সালের পর কোলকাতা বা বিহার প্রদেশ আর উত্তর ভারত থেকে বহু উর্দু ভাষাভাষী লোক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করে এবং বাংলা ভাষী নাগরিকগণ তাদের সাদর সংবর্ধনা জানান। ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মস্থল, স্কুল-কলেজ সর্বত্র তারা। সুতরাং প্রথমে উর্দু ভাষার প্রতি কিন্তু একজন বাঙালীরও কোন প্রকার বিরূপ বা প্রতিবাদী মনোভাব ছিল না। কিন্তু শাসকগণ উর্দু ভাষাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করতে চাইলেন, স্বাভাবিক কারণে এখানকার লোকই শুধু নয়, আমার মনে আছে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও প্রচন্ড প্রতিবাদ হয়। ‘খাইবার মেল’ বলে একটি পত্রিকা ওখান থেকে বের হতো। তারা পরের দিন (নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের, ৩১ জানুয়ারী) সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখে যে, উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। আমার মনে আছে, পরের দিন ঢাকায় খাইবার মেলের সেই কাটিং সম্পাদকীয়টা ইংরেজী ভাষায় ছাপিয়ে ইউনিভার্সিটি নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেই। আরো অনেক ঘটনা আছে, যা’ অনেক বন্ধু জানেন না—২১ ফেব্রুয়ারী একাধিক উর্দু ভাষী ভদ্রলোক এই বাংলা ভাষার দাবীতে আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খেটেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন সাংবাদিক এখনো ঢাকা শহরে আছেন; তার নাম জয়নাল আবেদীন।
ফয়েজ আহমদ : তিনি এখন ‘টাইমস’ পত্রিকায় আছেন।
মোহাম্মদ সুলতান : ‘টাইমস’ বা কোন একটা সিনেমা ফিচারের সঙ্গে।
ফয়েজ আহমদ : ‘টাইমস’-এরই সিনেমা বিভাগে জড়িত।
মোহাম্মদ সুলতান : তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান-কোরিয়া সমিতির সেক্রেটারী ছিলেন সাইদ—তিনিও জেল খাটেন। সৈয়দপুরে বহু অবাঙালী বন্ধু, যারা আমাদের ইউথ মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাও অনেকে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামে কারাগার ভোগ করেছেন। তারা সবাই বাড়িতে উর্দু ভাষা বলতেন; অথচ বাংলা ভাষার জন্যে আন্দোলন করেছেন। তাছাড়া ঠিক সেই আন্দোলনের সময়, অনেকে জানেন না, করাচীর স্টুডেন্ট ফেডারেশন আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং বাংলা ভাষার জন্য করাচীতে তারা মুভমেন্ট করেছেন। তাদের আন্দোলনের নিউজ-কাটিং আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এখন যারা ছাত্র লীগ করেন তারা হয়তো এসব জানেন না। কিন্তু তখনকার ছাত্র লীগের নেতৃবর্গ জানেন যে, আমরা ১৯৫৪ সালে যখন যৌথভাবে ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন ১৭ নং রেংকিন স্ট্রীটে করেছিলাম, তখন করাচী থেকে আগত বন্ধুরা বাহান্নর আন্দোলনের বহু কাগজ-পত্র ও কাগজের কাটিং (সমর্থনে) সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। যেহেতু, আমাদের পরিচ্ছন্ন বক্তব্য ছিল যে, পাকিস্তানের সকল ভাষার সমান মর্যাদা দিতে হবে এবং প্রত্যেকটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় মর্যাদায় পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সেইহেতু আমরা ভাষার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একক ছিলাম না। সমগ্র পাকিস্তানের অন্যান্য ভাষার লোকও এগিয়ে আসেন।
ফয়েজ আহমদ : অর্থাৎ তুমি বলতে চাও, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র অন্যান্য প্রাচীন ভাষা-সংস্কৃতির ওপরও আক্রমণের শামিল। স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলে বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তাদেরও সমর্থন ছিল।
মোহাম্মদ সুলতান : এখানে ইতিহাসের একটা প্রেক্ষিত তোমাকে বলতে চাই। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সীমান্ত গান্ধী তিনি….।
ফয়েজ আহমদ : তুমি আবদুল গাফফার খাঁ কথা বলছো।
মোহাম্মদ সুলতান : হ্যাঁ, গাফফার খাঁর কথা বলছি। আটটি রাজনৈতিক দল মিলে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে—এটা কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যারা দেশে গণতান্ত্রিক দাবী প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আন্দোলন করছিল, তাদের একত্রিত করার প্রথম সোপান হিসেবে কাজ করে।
ফয়েজ আহমদ : ন্যাপ প্রতিষ্ঠার তারিখ ও স্থান মনে আছে?
মোহাম্মদ সুলতান : রূপমহল হলে, ঢাকায়, মিটিং হয়। সমগ্র পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি, সামন্ততান্ত্রিক শোষণ বিরোধী শক্তির এই সমাবেশে মওলানা ভাসানী, আবদুল গাফফার খান, আবদুস সামাদ আচকজাই, মিয়া ইফতেখারউদ্দিন যোগদান করেছিলেন। এঁদের নেতৃত্বে সর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক যে ন্যাপ গড়ে ওঠে তার প্রধান বক্তব্য ছিল দুটো—একটা অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে, অপরটি সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে। এবং পাঁচটি অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক সার্বভৌম গণতান্ত্রিক পাকিস্তান গড়ে তোলা। এই যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ভিত্তি হিসেবে প্রথমেই বলেছি, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কাজ করে। ভাষা আন্দোলনের এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসাম্প্রদায়িক প্রেক্ষিত ও আবেদনকে আজো অনেকে জোর করে ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। এখন ২১-শে’কে শোক দিবস বলে উল্লেখ করে ৫২-র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাৎপর্য মুছে ফেলার প্রচেষ্টার অভাব নেই—মসজিদে-মন্দিরে মোনাজাত-প্রার্থনা করে একটা আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে রূপান্তর করা হচ্ছে। কোন শাসক ও শোষকগোষ্ঠী চান না যে, ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত ও তাৎপর্য গ্রহণ করে দেশের মানুষ নতুন করে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে আসুক। সুতরাং ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট, যে ভিত্তি, সেটাকে সব সময় আমাদের মনে রাখলে, আমার মনে হয়, ভাষা আন্দোলনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।
ফয়েজ আহমদ : তোমার এই রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সাথে অনেকেই একমত হতে পারেন। তোমার কি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কাহিনীটা এখনো মনে আছে?
মোহাম্মদ সুলতান : ৩১শে জানুয়ারী নাজিমুদ্দিন সায়েব বক্তৃতা করার পূর্বেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এই ভাষা আন্দোলন কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং সে কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আবদুল মতিন। তিনি এখন বামপন্থী আন্দোলনের একজন নেতা; ’৭১ সালে তিনি বিভিন্ন সংগ্রাম করেছেন। (বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, যার অন্যতম নেতা মতিন সায়েব, গঠিত হবার পূর্বেই এই টেপ ধারণ করা হয়েছিল।) তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিটিং ডাকেন। সেই সভাতে প্রথম আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম যে, ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে সমস্ত স্কুল-কলেজে ধর্মঘট পালন করা হবে। ধর্মঘটের পর সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী একত্রিত হয়ে পরবর্তী কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। আমার মনে হয় পাকিস্তান হবার পর প্রথম ৪ঠা ফেব্রুয়ারী মুসলিম মেয়েরা স্কুল-কলেজ বন্ধ করে মিছিলে বেরিয়ে এসেছিল। কামরুন্নেসা স্কুলের হেড মিস্ট্রেস গেট বন্ধ করে রাখেন। মেয়েরা দেয়াল টপকিয়ে বের হয়ে আসে। ঢাকা শহরে মুসলিম মেয়েরা একটি ব্যাপক মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ধর্মঘটী ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি মিটিং হয়েছিল—একটি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে এবং অপরটি বেলতলায় ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচীর বিরোধিতার একটা প্রচেষ্টা নেয়া হয়। কিন্তু সে সভা তারা করতে পারেনি।
ফয়েজ আহমদ : বেলতলা সভায় নেতৃত্বদানকারী কারো নাম মনে আছে?
মোহাম্মদ সুলতান : তাদের সংগঠন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ (নি-পূ-পা-মু-ছা-লী) অর্থাৎ নাজিমুদ্দিন ও শাহ আজিজ গ্রুপের লোকেরা চেষ্টা করেছিল।
ফয়েজ আহমদ : তার মানে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তির পুরনো ট্র্যাডিশন—গণবিরোধী বক্তব্য বলার জন্যে পাল্টা কোন কিছু মিটিং-টিটিং করা।
মোহাম্মদ সুলতান : তখনো তারা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফলতা অর্জন করেনি। এইদিনেই প্রথম আমরা সিদ্ধান্ত করলাম যে, একটা পতাকা দিবস পালন করা হবে। (১১ই ফেব্রুয়ারী) ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রাদেশিক পরিষদের সভা আহ্বান করা হয়েছিল। সেদিন আমরা বিক্ষোভ করে এ্যাসেম্বলীর সামনে যাবো এবং বাংলা ভাষার দাবীতে প্রস্তাব গ্রহণের জন্যে চেষ্টা করবো।
ফয়েজ আহমদ : সে সভায় কে সভাপতিত্ব করলেন।
মোহাম্মদ সুলতান : সম্ভবতঃ মতিন সায়েব।
ফয়েজ আহমদ : আমতলায় ভাষার পক্ষে অনুষ্ঠিত এই সভায় যারা বক্তৃতা করেছিলেন, তাদের কারো কারো মুখমন্ডল নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি।
মোহাম্মদ সুলতান : হ্যাঁ, মনে পড়ে। ছাত্র লীগের নেতা ওয়াদুদ, কামরুজ্জামান, আউয়াল সায়েব, মতিন, রওশন আখতার, হাসান হাফিজুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, মূর্তজা বশীর প্রমুখ এবং রাজনৈতিক নেতাও অনেকে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারীতেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয় যে, একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ হওয়া দরকার। প্রতিটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রত্যেকটি হল থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হবে এবং ৯৮ নং নবাবপুর রোড আওয়ামী লীগ অফিসে কর্মপরিষদের মিটিং হবে।
১১ই ফেব্রুয়ারী পতাকা দিবসের (ফ্ল্যাগ’ডে) পুনরায় অনুষ্ঠিত আমতলার সভায় সর্বদলীয় কর্মপরিষদকে ২১শে ফেব্রুয়ারী সঠিকভাবে উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে আবেদন করা হয়। কর্মপরিষদের উপর দায়িত্ব দেয়ার পর থেকেই সেই কমিটিতে একটা দুর্বলতা লক্ষ্য করি। তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাবছিল যে, সর্ব ব্যাপক একটা সংগ্রামে নামলে তাদের উপনির্বাচনে ইতিপূর্বে বিজয়ী তিনজন প্রতিনিধির নির্বাচন বাতিল হয়ে যেতে পারে এবং শূন্য আসনে সরকার আর নির্বাচন করতে দেবে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ভাবছিল, আন্দোলন যদি এভাবে এগিয়ে যায়, তা’হলে বামপন্থী শক্তি হয়তো অন্যভাবে কোন সুযোগ নেবে। এই সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংকোচ থাকার দরুণ প্রথম থেকেই তারা চেষ্টা নিচ্ছিল একুশ যেন একটি জঙ্গী আন্দোলনে রূপান্তরিত না হয় এবং এইদিনে যাতে সারাদেশে সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু না হয়। এর জন্যে পেছন থেকে একটা রাশ টানার প্রচেষ্টা ভেতরে দেখা যায়। যার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আগে থেকেই কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল—২১ তারিখে কোন রকম আপোস করা চলবে না। যা’হোক, ১১ থেকে ২০ তারিখ চলে এলো—তখন চাপা গুঞ্জন সকলের মধ্যে যে, সর্বদলীয় কর্মপরিষদ হয়তো আগামীকাল (২১শে) মিছিল করার কোন সিদ্ধান্ত নেবে না। গুজব ছিল, শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হবে, প্রয়োজন হলে সামরিক বাহিনীকেও নিয়োগ করা হবে এবং গোলাগুলি করে এদেশের রাজনৈতিক যে গতিধারা সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলবে।
এদিকে গত দু’বছরে বামপন্থী সংগঠন ও সংগ্রামী কর্মীরা, বিশেষ করে ছাত্র সমাজ, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ভাষার উপর হামলার বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে সচেতন হয়ে উঠছিল। ২০ তারিখ বিকেল পাঁচটার সময় ৯৮ নম্বর নবাবপুর অফিসে সর্বদলীয় কর্মপরিষদের অনুষ্ঠিতব্য সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে—এই কথাটা ক্রমেই পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠে। প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি যে একটা তীব্র সংগ্রাম গড়ে তুলতে চায়, তাকে বানচাল করার চেষ্টা তারা নেবে। পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের জন্ম ১৯৫০ সালে। রাজবন্দী মুক্তি, যুদ্ধজোট বিরোধিতা, শান্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবীসহ যুব লীগ ১৪ দফা দাবী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই যুব লীগ অফিসেই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক অলি আহাদ, যুগ্ম-সম্পাদক ইমাদুল্লাহ ও আমি বেলা প্রায় একটা থেকে দেড়টার দিকে এক বৈঠকে বসি—২১শে কি কর্মসূচী নেয়া উচিত ও কি বক্তব্য সর্বদলীয় সভায় বলা প্রয়োজন সে সব বিষয়ে আলোচনা করার জন্যে।
ফয়েজ আহমদ : কি সিদ্ধান্ত তোমরা তিনজন নিলে?
মোহাম্মদ সুলতান : যুব লীগ অফিস ৪৩/১ যুগীনগর লেনে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার এমন যদি সিদ্ধান্ত স্থির হতে চলে, তবে যুব লীগের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তাব পেশ করতে হবে। মিছিল বের করে প্রাদেশিক পরিষদে বক্তব্য উপস্থিত করতে হবে। এই প্রস্তাব যুব লীগের পক্ষ থেকে অলি আহাদ উত্থাপন করবেন স্থির হলো। যুব লীগের অপর প্রতিনিধি জনাব তোয়াহা তখন সর্বদলীয় সভায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করতেন। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টিরও ভূমিকা ছিল যে, একটা ব্যাপক আন্দোলনে এইভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়া এবং আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার সাথে চলার একটা চেষ্টা নেয়া।
ফয়েজ আহমদ : কমিউনিস্ট পার্টি সে সময় রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে চায়নি, যাকে রাজনৈতিক দিক থেকে হঠকারিতা বলা যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে না এই ইস্যুকে তারা সঠিক মনে করেননি বলে তোমাদের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নিতে চলছিল?
মোহাম্মদ সুলতান : আমার মনে হয়, দেশের বামপন্থী চিন্তাধারার নতুন ছাত্র-যুব সংগ্রামী সমাজকে তারা তখন সঠিকভাবে ধরতে পারেননি। এটাকে ডান চিন্তার একটি ভীতি বা দুর্বলতা বলেই ব্যাখ্যা করা যেতেও পারে। তাদের একটা নির্দেশ ছিল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ যাতে না করা হয়, সেভাবে প্রস্তুতি নেয়া। প্রায় ১৪টি সংগঠন সেই মিটিং-এ (সর্বদলীয় কর্মপরিষদ, ২০শে) উপস্থিত ছিল। আতাউর রহমান খান এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার প্রস্তাব যখন পাশ হচ্ছিল, তখন অলি আহাদ দাঁড়িয়ে বলেন, আমি এই প্রস্তাবের সাথে একমত নই এবং আমার আর একটি প্রস্তাব আছে। তার প্রস্তাবে বলা হয় : সর্বদলীয় সভা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে না বলে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন ও আগামীকাল (২১শে ফেব্রুয়ারী) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সভায় যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ছাত্ররা মিছিল করে বেরিয়ে যায়, তা’হলে মূল প্রস্তাব ও এই কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে। এই প্রস্তাবটিও মূল প্রস্তাবের সাথে সংযোজিত হয়ে গৃহীত হয়। একদিন কার্য পরিচালনা করার জন্যে কাজী গোলাম মাহবুবকে কর্মপরিষদের কনভেনর করা হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এই কমিটি বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে গোলাম মাহবুবও কনভেনর থাকবেন না। শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারী উদযাপনের জন্যই তাকে কনভেনর করা হয়। সর্বদলীয় কমিটির কনভেনর আতাউর রহমান সায়েব তখনও আছেন। মাহবুব সায়েব এই দিনটির জন্য কনভেনর। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম ছাত সমাজ ব্যাপকভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে। আমরা আটজন ছাত্রকর্মী রাত ১টার সময় বসলাম ঢাকা হল (শহীদুল্লাহ হল) ও ফজলুল হক হলের মাঝখানের পুকুর ঘাটে। আগামীকাল ২১শে কিভাবে মিছিল ও আন্দোলন পরিচালনা করবো ও প্রথমে কিভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবো সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ফয়েজ আহমদ : পুকুর ঘাটের সভায় কারা কারা ছিলেন?
মোহাম্মদ সুলতান : গাজীউল হক, এস এ বারী এটি, হাবীবুর রহমান শেলী, কমরুদ্দীন শহুদ, আমি নিজে—অন্যান্যদের নাম এখন মনে আসছে না।
ফয়েজ আহমদ : আবদুল মতিন ও অলি আহাদ ছিলেন?
মোহাম্মদ সুলতান : মতিন উপস্থিত ছিলেন না। অলি আহাদ তখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন বলে ডাকা হয়নি। এ কেবল ছাত্রদের সভা। সিদ্ধান্ত নিলাম এমন লোককে ছাত্র সভায় (সকালের) সভাপতি করা হবে, যিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গে প্রস্তাব পাশ করাবেন। প্রয়োজন হলে গায়ের জোরে এ প্রস্তাবকে পাশ করতেই হবে।
ফয়েজ আহমদ : গায়ের জোরে, মানে, কি বলতে চাও?
মোহাম্মদ সুলতান : সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সন্ধ্যার সভায় চারজন মাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন—সিদ্ধান্ত অন্য। এই চারজন সমর্থক হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা কমিটির কনভেনর আবদুল মতিন, ইসলামিক ব্রাদারহুডের নেতা ইব্রাহীম তাহা, তমদ্দুন মজলিশের প্রতিনিধি ও প্রস্তাবক অলি আহাদ নিজে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবেই। আমরা ওখানেই প্রথম সিদ্ধান্ত করলাম যে, গাজীউল হককে আগামীকাল সকালে (২১শে) ছাত্রদের সভায় সভাপতিত্ব করতে হবে। আর কাউকেই আমরা সভাপতি হতে দেব না। দু’নম্বর সিদ্ধান্ত হলো, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে হাবীবুর রহমান শেলী থাকবে। তিন নম্বর সিদ্ধান্ত, আমার উপর দায়িত্ব, আমাদের মধ্যে কারা গ্রেফতার হচ্ছে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করছে তার প্রতি নজর রাখা—গেটের উপর দাঁড়িয়ে খাতায় নাম লেখার দায়িত্ব পড়লো।
ফয়েজ আহমদ : আজকের দিনে হাইকোর্টের বিচারপতি হাবীবুর রহমান (শেলী), তার কথাই বলছ?
মোহাম্মদ সুলতান : হ্যাঁ, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেরা ছাত্র এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাস করতেন। তিনি হাসি মুখেই সে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন—প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন। ২১শের সকাল ন’টার পূর্বেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেই দেখি মেডিকেল কলেজ এলাকাসহ এই অঞ্চল পুলিশ সর্বপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘিরে আছে। এরপরই ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে আসতে শুরু করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিং ঠিক বেলা ১১টায় আরম্ভ হলো। আমাদের পূর্ব রাত্রের কর্মসূচী অনুযায়ী গাজীউল হক চেয়ারে বসলো, আমাদের প্রস্তাব মতে। সেই আমতলাতেই মিটিং।
ফয়েজ আহমদ : কোন প্রতিবাদ হয়নি?
মোহাম্মদ সুলতান : (পূ-পা-মু) ছাত্র লীগের পক্ষ থেকে শামসুল হক সায়েব দাঁড়িয়ে বলতে চেষ্টা করেন যে, আজকে কোন মতেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যাবে না।
এই ছাত্র লীগের তখন প্রেসিডেন্ট কামরুজ্জামান সায়েব ও সেক্রেটারী ওয়াদুদ সায়েব। আর নিখিল পূ-পা-মু ছাত্র লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বর্তমান আবদুস সামাদ আজাদ (এম, এ, সামাদ) এবং এর সেক্রেটারীর নামটা এখন ভুলে গেছি। এরা আগের দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভাঙবেন না। শামসুল সায়েব ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে চেষ্টা করার সময় মিটিং থেকে তীব্র প্রতিবাদ হয় এবং তাকে বসিয়ে দেয়া হয়। এরপর মতিন সায়েব প্রস্তাব এনে বক্তৃতা করেন ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করার পক্ষে। বিপুল সমর্থনের পর মিছিল করার জন্যে সভা ভেঙে যায়।
ফয়েজ আহমদ : গাজীউল হককে সভাপতি করা নিয়ে কি কোন হিচ বা আপত্তি হয়েছিল?
মোহাম্মদ সুলতান : অন্য কাউকে সভাপতি করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ চেষ্টা করেছিল। আমরা প্রস্তাব করেই একটা টিনের চেয়ার নিয়ে তাকে আমতলায় বসিয়ে দেই। ঠিক ছিল, এমনকি যদি গুলিও হয় গাজী চেয়ার ছাড়তে পারবে না। গাজী সেটা সম্পূর্ণভাবে পালন করেছিল। এখানে একটি কথা বলা দরকার যে, সকাল সাড়ে ন’টা থেকে দশকটার মধ্যে তোয়াহা সায়েব ও শহীদুল্লাহ (কায়সার) সায়েব একটি প্রস্তাব নিয়ে আসেন—প্রস্তাবটি, যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে প্রস্তাব হয়েই যায়, তবে যেন দশজন দশজন করে মিছিল বের হয়।
ফয়েজ আহমদ : কেন, দশজনের দলে মিছিল কেন?
মোহাম্মদ সুলতান : যেন মিছিলে শৃঙ্খলা থাকে। মিছিল কিভাবে হবে, এই নিয়ে দ্বিমত হয়নি।
ফয়েজ আহমদ : পরোক্ষভাবে এবার তারা (কমিউনিস্ট পার্টি) সমর্থন জানালেন।
মোহাম্মদ সুলতান : হ্যাঁ, মিছিল হবেই এই সংখ্যাগরিষ্ঠ স্দ্ধিান্ত দেখে তারা মিছিলের বিরোধিতা করেননি। তারপর একটার পর একটা মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে শুরু করলো। পুলিশ আইন ভঙ্গকারী এক একটি দল ধরে গাড়িতে তুলে নিচ্ছে। কাউকে জেলের দিকে, কাউকে থানার দিকে, কাউকে বা দূরবর্তী টঙ্গী এলাকায়।
ফয়েজ আহমদ : প্রথম ব্যাচে কি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাবীবুর রহমান শেলী ছিলেন?
মোহাম্মদ সুলতান : প্রথম ব্যাচের প্রথম ব্যক্তিই তিনি ছিলেন। এভাবে আট-দশটা ছেলেদের মিছিল বের হবার পর মেয়েদের মিছিল শুরু হয়।
ফয়েজ আহমদ : মেয়েদের প্রথক মিছিলে কারা ছিলেন?
মোহাম্মদ সুলতান : তাদের সবার নাম এখন আর মনে নেই। তবে সুফিয়া ইব্রাহীম (ডঃ মিসেস সুফিয়া ইসতিয়াক), ডঃ হালিমা খাতুন, রওশনারা বাচ্চু ও শাফিয়া খাতুনের নাম মনে পড়ে। দেখা গেল, পুলিশ মেয়েদের গাড়িতে তুলতে চেষ্টা করছে না। কিন্তু মেয়েদের মিছিলের উপর পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে দিয়েছে এবং বহু মেয়ে সেদিন এই মিছিল করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। এই বিরতিহীন মিছিল ঠেকাতে পরে শেষ পর্যন্ত পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছাড়তে শুরু করে। অসংখ্য টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ এলাকা ধোঁয়ায় অন্ধকার করে ফেলে।
ফয়েজ আহমদ : ক’টা হবে তখন?
মোহাম্মদ সুলতান : সাড়ে ১২টা থেকে ১টা হবে। গ্যাসে টিকতে না পেরে বিক্ষোভকারী ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ মিটিং করেন এবং তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে মুনীর চৌধুরী, অজিত গুহ (জগন্নাথ কলেজের), মুজাফফর আহমদ চৌধুরী সেখানে আগমন করেন। ছাত্র, শিক্ষক, বয়, বেয়ারা সবাই সংগ্রামে জড়িত হয়ে পড়েন।
ফয়েজ আহমদ : শেখ মুজিব কি এই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হতে পেরেছিলেন?
মোহাম্মদ সুলতান : তিনি জড়িত হতে পারেননি। একথা সঠিক নয় যে, তিনি সেবারের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। ২১শের সাথে কোন মতেই নয়। তার বেশ আগে থেকেই তিনি জেলে ছিলেন। ১৯শে ফেব্রুয়ারী তাঁকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে সরিয়ে অন্যত্র (ফরিদপুর জেলে?) নিয়ে যাওয়া হয়।
২১শের বিকেলে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যার রক্তাক্ত কাহিনী আর এক ইতিহাস।
[রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সুলতানের টেপবদ্ধ অন্যান্য বক্তব্য প্রয়োজনে অন্যত্র বা অন্য কোন সময়ে উপস্থিত করা যেতে পারে। ফয়েজ আহমদ]
০০০