কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির ভাষণ
কুমিল্লা: রাষ্ট্রপতি মােহাম্মদ উল্লা জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষার আলােকে আলােকিত করার উপর গুরুত্ব আরাপ করেছেন। রাষ্ট্রপতি রবিবার কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়ােজিত এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দান করছিলেন। জনাব মােহাম্মদ উল্লা বলেন, উন্নত দেশসমূহ শিক্ষার কারণেই সমাজ ও দেশের কল্যাণে যথােপযুক্ত আত্মনিয়ােগের সুযােগ লাভ করে। কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিরক্ষর দেশগুলাের অন্যতম বিধায় আমাদের জনসমষ্টি উৎপাদনশীল জনশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযােগ লাভ করেনি। রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশ আজ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জাতি আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করে। জনাব মােহাম্মদ উল্লা নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সকল দুর্যোগ মােকাবেলার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জনান।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের পূর্ণ বিবরণ: আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের এই অনুষ্ঠানে আপনাদের সাথে মিলিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করছি। জাতিসংঘের আহ্বানে পৃথিবীর সকল দেশে এই দিনটি পালনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে বাংলাদেশের মতাে উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষরতা দিবস উদযাপন এবং এর মর্মবাণী জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করার প্রয়ােজন সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নাই। আপনাদের এই মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করতে পেরে আমি গৌরবান্বিত বােধ করছি। নিরক্ষরতা জাতির পক্ষে একটি অভিশাপস্বরূপ। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে দেশকে সুষ্ঠুভাবে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। নিরক্ষর মানুষ তাদের সঠিক কর্তব্য নির্ধারণের প্রশ্নে নানারূপ বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত হতে পারে। এজন্য সাক্ষরতার অভিযানকে জাতির অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে প্রথম পদক্ষেপ বললে অত্যুক্তি হয় না। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণ জাতির পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। শিক্ষা ও সাক্ষরতা জীবন সংগ্রামের একটি প্রধান অবলম্বন। শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদানই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। দেশের বাস্তব অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে পেশায় ও দক্ষতা অর্জনের জন্য কর্মপন্থা অবলম্বন একান্ত বাঞ্ছনীয়। সুখী ও সমুদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে সাক্ষরতার মাধ্যমে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির ব্যবহারিক জীবনের সাফল্যের জন্য সাক্ষরতার প্রয়ােজনীয়তা সর্বাধিক। বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বপেক্ষা নিরক্ষর দেশগুলাের অন্যতম। ১৯৬১ সালে আদমশুমারিতে দেশের শিক্ষিতের হার ২১৫ দেখানাে হয়েছে। অবশ্য কেবল যারা কোন প্রকারে নাম সই করতে পারেন, তাদের সবাইকে এই হিসেবে ধরা হয়েছে। ১৯৭৪ সালেও এই অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নাই। বাংলাদেশ ৬ষ্ঠ শ্রেণির ঊর্ধ্বে লেখাপড়া জানা লােকের সংখ্যা শতকরা ৪৩ জন। আমাদের দেশে বয়স্কদের সাক্ষরতার হার আরও শােচনীয়। এজন্য সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বয়স্ক শিক্ষার প্রতিও আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। নিরক্ষরতা দূরীকরণের অভিযানে সরকারি পর্যায়ের যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে প্রয়ােজনের তুলনায় তা অপ্রতুল হলেও গণমনে এর। প্রভাব কম নয়। কাল থেকে আমাদের দেশে পরিকল্পিত উপায়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণের অভিযান শুরু হয়। এ ব্যাপারে কুমিল্লা একাডেমী পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি থানায় যে কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে তা সত্যই প্রশংসার যােগ্য। কুমিল্লা বয়স্ক শিক্ষার প্রশিক্ষণালয় ও সুষ্ঠু শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজে যথেষ্ট সাহায্য করছে। এছাড়া কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এবং দেশি-বিদেশি সংস্থার অর্থানুকূলে দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও, রাজশাহীর গুরুদাসপুর, রংপুরের রৌমারী, ফরিদপুরের রাজৈর, সিলেটের শাল্লা, নােয়াখালীর বেগমগঞ্জ, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া এবং আরাে অন্যান্য স্থানে বয়স্ক শিক্ষার যে কাজ চলছে তা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। জাতীয় জীবনের সর্বপ্রকার আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্য সম্মুখে রেখেইে আমাদের বর্তমান শিক্ষা নীতি গড়ে ওঠেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ ব্যয়ে, শিক্ষার প্রতি সরকারের বিশেষ গুরুত্ব ও মনােযােগ প্রদর্শনেরই প্রমাণ। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় বয়স্ক শিক্ষার ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ৪০ কোটি টাকার একটি স্কীম অনুমােদন করা হয়েছিল। শিক্ষা কমিশনের রিপাের্টে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপিত হয়েছে। এই রিপাের্টে বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপারে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় সাধন এবং নীতি নির্ধারণের জন্য একটি বয়স্ক শিক্ষা কাউন্সিল গঠনেরও সুপারিশ রয়েছে। দেশের বাস্তব প্রয়ােজনের দিকে লক্ষ্য রেখে সাক্ষরতার অভিযান পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ, মহিলাদের গার্হস্থ্য অর্থনীতি, যুব ও বয়স্কদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা চালু করার ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারি প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। সমাজের কল্যাণকর সকল প্রতিষ্ঠানকেই এ কাজে সর্বাত্মক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আমাদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। এখন পর্যন্ত প্রাচীন কৃষিব্যবস্থাই আমাদেও দেশে চালু রয়েছে। এতে করে সীমিত কৃষি জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব না। দেশের জনসংখ্যাকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে এই প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি পরিবর্তন সহজতর হবে। আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্যের কথা মনে রেখে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। কৃষকের শ্রমের মর্যাদা দান ও কর্মের দক্ষতা বৃদ্ধি, জমির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারের পদ্ধতি প্রয়ােগ, প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের মােকাবেলা ইত্যাদির ওপর দেশের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। কৃষক ও শ্রমিকের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নে শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে সহায়ক হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। আজ তাই প্রয়ােজন সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সাক্ষরতার আন্দোলনকে সফল করে দেশের আপামর জনসাধারণকে শিক্ষিত করে গড়ে তােলা। জনসংখ্যা আজ বাংলাদেশের গুরুতর সমস্যা। এর কারণ আমাদের জনসমষ্টি উৎপাদনশীল জনশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযােগ লাভ করে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিটি মানুষের ভূমিকা আছে। শিক্ষার কারণেই উন্নত দেশের মানুষ সমাজ ও দেশের কল্যাণে যথােপযুক্ত আত্মনিয়ােগের সুযােগ লাভ করে। জাতীয় জীবনের অগ্রগতির স্বার্থে আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষার আলােকে আলােকিত করতে হবে। শিক্ষার দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি বাঙালির জীবনে। বাংলাদেশ আজ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে। সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জাতি আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করে। নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সকল দুর্যোগ আমরা অতিক্রম করতে সমর্থ হব, এই বিশ্বাস আমাদের আছে। আপনাদের কাছে আমার আবেদন, নিরক্ষরতা ও কুসংস্কার দূর করে জনগণের কল্যাণে এগিয়ে আসুন এবং সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে কঠোর সংগ্রামে আত্মনিয়ােগ করুন। সমাবেত সুধীবৃন্দ আমি আশা করি বাংলাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় সাক্ষরতার অভিযান সাফল্য লাভ করবে। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের এই শুভলগ্নে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাগণকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। সাক্ষরতার আন্দোলনে নিয়ােজিত সকলের প্রতি আমার অকৃত্রিম শুভেচ্ছা রইলাে।২১
রেফারেন্স: ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত