You dont have javascript enabled! Please enable it! 1980.03.26 | এ লাশ রাখবো কোথায় | কাভী জাওয়াদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

এ লাশ রাখবো কোথায়
কাভী জাওয়াদ

ইতিহাসে কিছু কিছু নাম লেখা থাকে না
কতগুলো নাম নিয়ে আমরা আলোচনা করি, গর্বিত হই, স্ফিতবক্ষ হই। কিন্তু কত নাম মুছে যায় কত প্রাণ চলে যায় তার খবর কে রাখে। নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসের সাহস কি আছে সে নাম বুকে নেয়ার ? আজকের যে নাম ইতিহাসের উপাদান হওয়ার লক্ষ্যে অতীত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে বর্তমানের চক্রান্তে সে বাদ পড়ে যাচ্ছে ইতিহাস থেকে। আবার কখনো কখনো ইতিহাসের দৃষ্টি বড় একপেশে, স্মরণশক্তি ভোতা। মোটাবুদ্ধির এই ইতিহাস কিছু নাম মনে রাখতে পারেনা। সে নাম দরিদ্রর। সে নাম অভিমানীর। বিবেকের কাছে সেসব নামগুলো খুজে ….. হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিবেকের কাছে কর্তব্যবোধের শিক্ষা নেব এ উপলধি কি আমাদের আছে ?
০ ০ ০ ০ ০
নোয়াখালীর সেনবাগ থানার জুটখোলা গ্রামের লাল মিয়া পাটোয়ারী পাঁচ ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার করছিল। লাল মিয়ার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে বছর পনেরো আগে। পাঁচ সন্তানের জনক লাল মিয়ার যৌবন যেন ফুরিয়ে ফরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের কোঠায় চলে এসেছে। কোলের মেয়েটির মুখে তখন কথা ফটেছে মাথায় বুদ্ধি তো আসেনি। আধো আধো স্বরে বাবাকে ডাকতো। তারই মুখের দিকে চেয়ে লালমিয়া দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। বিয়ের সাধও হয়নি, সাধ্যও ছিল না। ৬ বিঘা জমি যার সম্বল সে কবার বিয়ে করতে পারে ? তার উপর পাঁচটি মুখের খাবার জোটানোর দায় তো আছেই। ছেলে দু’একজন গায়ে খাটতে সমর্থ হয়েছিল কিন্তু উপার্জনের সামর্থ কেউ পায়নি। লাল মিয়ার সংসার চলছিল । একে কি চলা বলে ? আজন্ম লালিত শিক্ষাহীনতায় লাল মিয়া একই সংসার করা বলে জেনেছিল। গ্রামের সামাজিক ব্যবস্থায় লালমিয়া বড় হয়েছিল বলে সে তার অধিকার বুঝে নিতে শেখেনি। যেটুকু পেয়েছ তাকেই পাওয়া বলে ধরে নিয়েছে। রুগ্ন ক্লিষ্ট বলদে হাল জুড়ে শুষ্ক জমিকে চাষেছে—মাটির বুক খড়ে বলেছে—’ভাত দে’। ভাত লাল মিয়া পায়নি। কৃপনা ধরিত্রীর কাছে উদার হয়নি। তাতে লাল মিয়া দুঃখিতও হয়নি। কারণ তার কাছে দুঃখের পরিধি আরও বহত্তর ছিল।
তবু লাল মিয়ার বুকে আশা ছিল। বংশানুক্রমের পরবর্তী পর্যায় সুখ আসবে।’ ছেলেদের মুখের দিকে চেয়ে সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নকে গেথে গেথে আশা করেছিল সুখকে ঘরে আনবে—বেধে রাখবে। কিন্তু আশাপুর্ণ হওয়ার আশা তার কোন দিনই ছিল না। ক্রমে ক্রমে লাল মিয়ার সমাজে তার জীবনধারার চতুরপার্শ্বে সচেতনতা আসছিল। কিন্তু লালমিয়া তার খেই খুজে পায়নি।
প্রৌঢ় লালমিয়া যে স্রোত ধরতে পারেনি তা কিন্তু ধরা দিয়েছিল তার সবচে’ ছোট ছেলের কাছে। নাম তার আবু তাহের পাটোয়ারী। লাল মিয়া তাকে আদর করে ডাকতো পাটোয়ারী বলে।
চৌদ্দ বছরের কিশোর তাহের তখনই অধিকার সচেতন হয়েছিল। গোপন করতে শিখেছিল মনের ইচ্ছাকে। সমস্ত জাতির সঙ্গে একটি স্বপ্ন দেখায় সেও অংশীদার হয়েছিল।
অন্যান্য সাথীরা যখন ঘুঘুর ডাককে সাথী করে আমগাছ ঢিল ছুড়ে পড়শির বকুনি খাচ্ছে তাহের তখন আত্মগমন স্বদেশ উধবারের চিন্তায়। ‘৭১-এর গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দিনগুলোতে তাহের দেখেছে প্রকতিতে রিক্ততা। মাটিতে কানপেতে শুনেছে লাঞ্ছিতা মায়ের কান্না। শিরায় শিরায় অনুভব করছে বিদ্রোহ। দুর্দান্ত এই দামাল কিশোর শাসনে বশ মানেনি। শিক্ষিত সৈন্যবহিনীর কৃত্রিম দাপটের কাছে মাথা নোয়াতে অস্বীকার করেছে। অসম্ভবের আকর্ষণে এ ছেলে খেলা ভুলেছিল। পড়শীরা কেউ কি বুঝেছিল এ ছেলে, তাদের মুখে রাখবে, বুক ফোলাবে ? বোঝেনি। তাহের কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। শুধু ছেলেবেলার খেলার সাথী ছোট বোনটিকে বলছিল “আমি একটু ঘুরে আসি তুই কাউকে কিছু বলিসনা।’ তাহের মুক্তির আনন্দে সূর্য সোপান বেয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। চোখে স্বপ্ন ছিল এদেশকে সোনার বাংলা বানাবে।
যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সোনার ছেলে তাহের ফিরে এসেছিল বগলে ক্যাচ নিয়ে পঙ্গু হয়ে। পঙ্গু হয়ে তাহেরের অভিমান বেড়েছিল। আশা করেছিল স্বদেশ তাহেরকে অন্ততঃ বুকে করে রাখবে। কিন্তু তাহের বোঝেনি স্বাধীনতা রক্ত চায় কিন্তু রক্ত ধারাকে জিইয়ে রাখতে সাহায্য করেনা। তাহের দেখেছে তার গৌরবকে ছিনিয়ে নিতে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
শহরে সমাজের ষোড়শ বাহিনী বিবেক বিচারকে বন্দী করে তার কণ্ঠরোধ করে দিয়েছিল। তাহের সেখানে হার মেনেছে। মান সম্মান বুকের মধ্যে রেখে তাহের স্বাধীনতা চাইলে, সোনার বাংলা চাইলো রাজনীতি সে পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো। তাহের চীৎকার করে বললো বাঁচতে চাই-অর্থনীতি তখন মুদ্রাস্ফীতির অস্ত্র ছুড়েছে। তাহের উপদেশ পেলো তিন বছর অন্ততঃ কিছু না খেয়ে কাটিয়ে দাও। তাহের এটাও সয়েছিল। তবু তাহের লালমিয়ার স্বপ্নকে সজীব রেখেছিল। দেশের অবস্থা ভাল হবে। অন্ন বস্তু আবার পাওয়া যাবে। তখন কি দেশ তার আদরের ছেলেকে ভুলে থাকতে পারবে? লালমিয়াও সেই একই স্বপ্নকে বুকে ধরে রেখেছিল।
কিন্তু এখন তাহের নেই। তাহের সেদিন ৫ই মার্চ অভিমান করেছিল। অভিমানী তাহের সেদিন মরণকে বুকে বেধে ইটের শহর ঢাকায় পি জি হাসপাতালের তিনতলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। তাহের সেখানে মারা গেছে। তাহের এখন আত্মহন্তা
কেউ কি মৃত তাহেরের কানে কানে একবার জিজ্ঞেস করেছে
“বাছারে তুই কি পাথরের বুকে হৃদয় খুজতে গেছিস?”

৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধার আত্মহন্তা শিরোনামে যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল তা হলো নিম্নরপঃ
“পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পঙ্গু, মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবু তাহের পাটোয়ারী (২৫) গতকাল সকালে হাসপাতালের তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহন্তা করেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা গেছে মুক্তিযুদ্ধে নিজের দু’টি পা হারাবার পর থেকে জনাব পাটোয়ারী মানসিক অশান্তির মধ্যে দিন যাপন করতেন। নানা প্রকার মনস্তাত্তিক অসুখ সর্বদা তাকে দুর্বল করে রাখতো।
পিজি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে তিনি প্রায়শ নানা অসুখের নামে হাসপাতালে ভর্তি হতেন। বেচে থাকার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই নিষ্পৃহ। এর আগেও তিনি কয়েকবার উপর থেকে লাফ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে গতকাল তার চেষ্টা ফল হয়েছে।”
তাহেরের আত্মহন্তার খবরের পর আরও একটি আত্মহন্তার খবর পাওয়া গেছে। ১৭ মার্চের পত্রিকায় তাও এখানে দেয়া হলো। শিরোনাম ছিলঃ “বেকার মুক্তিযোদ্ধা আত্মহন্তা “
‘জামালপুর, ১৬ মার্চ। বেকারত্বের গ্লানি মোচনের জন্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বনাথ দাস (৩২) ট্রেনের চাকার নীচে গত শুক্রবার আত্মহন্তা করেন।
দু’সন্তানের জনক বিশ্বনাথ দাস জামালপুর থানায় নরুন্দি ইউনিয়নের ধীরেন্দ্র দাসের পুত্র। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার কথা সকল সহযোদ্ধই জানেন। ৯/১০ বছর আগে বিশ্বনাথ বিএ পাস করেন। চাকরির খোঁজে তিনি ১৯৭৪ থৈকে ১৯৮০ এই সাত বছর দরখাস্ত করেছেন অসংখ্য, ধর্না দিয়েছেন। অনেকের দুয়ারে, কিন্তু ফল হয়নি। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের ফটোস্ট্যাট কপিই করেন শতাধিক।

সাম্প্রতিককালে তার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া বাধতে থাকতো প্রায় প্রতিদিনই।
জনতা ব্যাঙ্কে অফিসার পদে কেবল মাত্র মুক্তিযোদ্ধ প্রার্থীদের দরখাস্ত গ্রহণ করা হচ্ছে, এ কথা জেনে বিশ্বনাথের স্বী আবার তাকে ঢাকায় যেতে বলেন। কিন্তু বিশ্বনাথ যেতে চায় না। এ থেকে স্বামী-স্ত্রী কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। গত শুক্রবার পিয়ারপুরের কাছে শ্রী বিশ্বনাথ দাস ময়মনসিংহ থেকে আগত একটি ট্রেনের চাকার নীচে পড়ে আত্মহন্তা করেন এ তথ্য বিশ্বনাথের অভিভাবকদের কাছ থেকে পাওয়া।
মুক্তিযোদ্ধা শ্রী বিশ্বনাথ দাসের আত্মহন্তার খবর পাবার পর পরই জামালপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় অবিলম্বে বেকার মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের দাবি জানানো হয়।
তাহেরের মৃত্যুর পর আরও অনেক খবর সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্ক হয়েছে সংসদে। তাহের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীরপ্রতীক উপাধি লাভ করে। স্বাধীনতার পর ৮ ফুটি ১২টি টিন পেয়েছিল রিলিফে তাতে ৪টি ছনের ঘরের একটিতে চাল দেয়া হয়েছে। জীবিত চার ভাই শ্রমিক। রিকশা চালান, সযোগমত অন্যান্য কাজও করেন। সংসারে তাই স্বচছলতা নেই। আবু তাহেরের পিতা লালমিয়া তাহেরের মাসোহারা থেকে পাঠানো কিছু টাকার উপরই নির্ভর করতেন।
তাহের বেচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে পঙ্গু না হলেও খুব স্বচ্ছল সংসার গড়ে তুলতেন একথা নিশ্চিত বলা যায় না। কাল আমাদের অনগ্রসর সমাজের গলি খুজে তাহেরের আয়ত্তে না আসারই কথা। কিন্তু একটি প্রশ্ন বোধ হয়’ করা যেতে পারে।
তাহেরের রক্তের মূল্যে পাওয়া যে স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি তার জন্য কোন কৃতজ্ঞতা কি আমাদের আছে ? উদ্দেশ্য হল দিন রাত্রি যাপন করতে তাহেরের যে ক্ষোভ ছিল আমরা কেউ তা অনুভব করতে পেরেছি ?
তাহেরের মৃত্যুর পর যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা কি আসলেই কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা ? না কি আমাদের দেউলিয়াপনাকে ঢেকে রাখার অপচেষ্টা ? জাতির কি লাভ নিজের মনকে চোখ ঠেরে? তাহেরের পিতা লালমিয়া পাটোয়ারী যখন তার মাথায় হাত দিয়ে বলে বাবা আমার মাথাটা গরম হয়ে গেছে কখন যে কি করি তার দিশ পাই না’ তখন কি তার কথার পরে কথা রাখা যায় ?
তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা কি আছে? পোড় খাওয়া বুকে ভাষার লালিত্য কোন সুষমার বান ডেকে আনতে পারে কি ?
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার প্রচষ্টায় যে কর্মকর্তা সদাসচেষ্ট তার কি শাস্তি হওয়া উচিত নয় ? যে কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধাদের আকুতি অবহেলা করার অভিপ্রায়ে নিজের অফিস কামরাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিশ্ছিদ্র করে ফেলেন তাকে বদলি করে দিলেই কি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে যায় ? এবার কি একবার বিনয় সহকারে মাননীয় ত্রাণমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে পারি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট্রের চুরি নিয়ে বিচিত্রার প্রতিবেদনে প্রকাশিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোন ব্যবস্থা কি গ্রহণ করা হয়েছিল ?
দেশের প্রচলিত আইনের চোখে আবু তাহের আত্মহন্তা।
আইনের চোখে সবাই সমান। আদালতে প্রমাণিত হতে পারে আবু তাহের আত্মহন্তা করেছে। একই অবস্থা বিশ্বনাথের ক্ষেত্রও কিন্তু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কি খুজে বের করবে
তাদের আত্মহন্তার উপযুক্ত(!) পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী কে ?
তাহেররা ভুল করেছে।
যে বীর সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি ধরে, যে যোদ্ধা আপোষের চেয়ে সংগ্রাম পছন্দ করে তার জন্য আত্মসমর্পণ নয়। যদি এখানে এদেশে অবহেলা অবিচার ছিল তবে তার প্রতিবাদ হতে পারতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যদি ন্যায়সঙ্গত তবে এখানে একবার বিপ্লব হতে পারতো। অত্যাচার প্রতিরোধের জন্য পথ আছে। তা আক্ষেপের নয়—বিক্ষোভের।
০ ০ ০
তাহের, বিশ্বনাথ নিরবে প্রতিবাদ করেছে। প্রাণ দিয়েছে আত্মসমর্পণে। সমগ্র জাতি কি একবার ভাববে মৃত্যুহীন এ লাশ রাখবো কোথায়? এ লজ্জা আমরা রাখবো কোথায় ?
এ লাশ আমরা ঢাকবো কি দিয়ে?