You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.07.04 | বর্তমান বাজেট সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ করেছে | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

বর্তমান বাজেট সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ করেছে

সংসদ ভবন: জাতীয় সংসদ অধিবেশনে স্বতন্ত্র সদস্য জনাব আবদুল্লাহ সরকার ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তীব্র সমালােচনা করে বলেন, এ বাজেট দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটে মিশ্র অর্থনীতির প্রতিফলন ঘটেছে। অপরদিকে সরকার দলীয় দুই সদস্য ড. মইনউদ্দিন আহমদ, এবং জনাব আমান উল্লা খান বাজেটের প্রশংসা করে বলেন, এ বাজেট কার্যকরী করার ফলে সাধারণ মানুষের সুখ সমৃদ্ধি হবেই। ১৯৭৪ সালের প্রস্তাবিত বাজেটের উপর জাতীয় সংসদে সাধারণ আলােচনার তৃতীয় দিনে অংশগ্রহণ করে সংসদ সদস্যগণ একথা বলেন।
আবদুল্লাহ সরকার: স্বতন্ত্র সদস্য জনাব আবদুল্লাহ সরকার অভিযােগ করেন, সরকার একদিকে চোরাকারবারী, মুনাফাখাের এবং মজুতদারদের মানুষের উপর করের বােঝা চাপাচ্ছেন। তিনি বলেন, বাজেট দেখে মনে হচ্ছে যে দেশের উন্নয়ন আগামীতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। বিদেশ থেকে ধার করে টাকা এনে এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব সমতাসূচক বাজেট প্রণয়নে কোন কৃতিত্ব নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে শর্তহীন ঋণ আনা যেতে পারে। তবে তার দ্বারা উৎপাদন খাতে ব্যয় করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। তিনি সরকারের তীব্র সমালােচনা করে বলেন, সরকার দেশের মূল সমস্যাসমূহ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তার পাশাপাশি নিজেদের ভােগবিলাস এবং আরাম-আয়াসে ব্যস্ত রয়েছেন। তিনি বলেন, এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষ শ্রমবিমুখ হয়ে পড়েছে যা একটি জাতির পক্ষে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। তিনি শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে বলেন, সরকারের ব্যর্থতা এবং ক্রটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার। জন্যই মানুষ শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে ছাত্র-ছাত্রীদের দেশ সেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার দাবী জানান। জনাব আবদুল্লাহ সরকার দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের মতাে অন্য কোন দেশে এক সাথে এত দরিদ্র নেই। তিনি বলেন, একদিকে দেশের কোটি কোটি মানুষ অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা হতে বঞ্চিত হচ্ছে আবার অন্যদিকে এক শ্রেণির মানুষ নিজেদের আরাম ও বিলাসিতার প্রতিযােগিতায় মত্ত হয়েছে। তিনি বলেন, তাছাড়া খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিলােপ হওয়ার পথে। জনাব সরকার বলেন, একদিকে সমাজতন্ত্রের কথা জোর গলায় প্রচার করা হচ্ছে আর অন্যদিকে শােষিতের উপর শােষকদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার শােষণের মানসিকতা পরিহার করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি অভিযােগ করেন, সরকার দলীয় লােকদের হাজার হাজার পারমিট দিচ্ছে। যার ফলে পারমিটবাজদের অত্যাচারের ফলে জনগণ শােষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, সুখী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার জন্য জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে। এই প্রসঙ্গে তিনি শহরের ভােগবিলাসের উপর কঠোর আঘাত করে গ্রামকে উন্নতি করে তােলার দাবী জানান। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে অভিযােগ করেন, অর্থাভাবে সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা পাচ্ছে না। অথচ ৩৬ জন মন্ত্রীর তনয়-তনয়া বিদেশে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে শিক্ষা লাভ করছে। তিনি প্রশ্ন করেন মাসে দেড় হাজার টাকা বেতন দিয়ে মন্ত্রী কি করে তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াতে পারেন? এই প্রসঙ্গে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ করেন। জনাব আবদুল্লাহ সরকার দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব আরােপ করে বলেন, এই বিভাগে কর্মচারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে প্রচার অভিযান চালাতে হবে। এই প্রসঙ্গে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ছাত্রীদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা প্রদানের সুপারিশ করেন। দেশের হাসপাতালগুলােতে ‘ব্লাড ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচার অভিযান চালাতে হবে। তিনি দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ রক্তের দাম বৃদ্ধি পায়নি। তিনি এই প্রসঙ্গে ব্লাড ব্যাংকে যারা রক্ত বিক্রি করে তাদের প্রতি বােতল রক্তের দাম ৪০-১০০ টাকায় বৃদ্ধি করার পক্ষে মতাে প্রকাশ করেন।
পাট প্রসঙ্গ: দেশের পাটসম্পদের ওপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যকালে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তান পাট সম্পদকে শােষণ করেছে আর স্বাধীনতার পর ভারত আমাদের পাটসম্পদ শােষণ করেছে।
ফারাক্কা বাঁধ প্রসঙ্গ: জনাব সরকার ফারাক্কা বাঁধের ওপর আলােচনা করে বলেন, গঙ্গার পানির সুষম বন্টনের নিশ্চয়তা অবশ্যই করতে হবে।
আরাে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের দাবী: তিনি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে দেশে আরাে মেডিকেল কলেজ স্থাপন এবং বর্তমান মেডিকেল কলেজগুলােতে আসন সংখ্যা বৃদ্ধির দাবী জানান।
জমির উপর কৃষকদের যৌথ মালিকানা দাবী: তিনি দেশের নব্য ধনী কৃষকদের দমনের জন্য ব্যক্তিমালিকানার সরকারি জমিদান বন্ধ করে কৃষকদের যৌথ মালিকানা প্রদানের দাবী জানান। এই প্রসঙ্গে তিনি ভবিষ্যৎ কৃষি ভূমি জাতীয়করণ করার জন্য সরকারকে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করার আহ্বান জানান। তিনি সবুজ বিপ্লব সার্থক করার জন্য কৃষকদের সময়মতাে কৃষি ঋণ, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং কীটনাশক ঔষধ সরবরাহ করার দাবী জানান।
ডা. মইনউদ্দিন আহমেদ: সরকার দলীয় সদস্য জনাব মইনউদ্দিন আহমেদ বাজেটকে অভিনন্দিত করে বলেন, এ বাজেটে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের প্রতিফলন রয়েছে। তিনি যেসব রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানায় লােকসান হচ্ছে সেগুলাে শ্রমিক সমবায় সমিতির কাছে হস্তান্তর করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। জনাব সরকার দেশের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির ওপর মন্তব্যকালে বলেন, সম্পদের পাচারের ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে শুধু কাগজের টাকা আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জনাব সরকার দেশের বর্তমান রেশনিং ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ও অপ্রতুল বলে মন্তব্য করে বলেন, শহরে বিত্তশালীদের রেশন দান বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ তারা রেশনের জিনিসপত্র বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে খােলাবাজার থেকে আরাে উচ্চমূল্যে জিনিসপত্র ক্রয় করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বাজেট কার্যকরী হলে সাধারণ মানুষের সুখ সমৃদ্ধি হবে। তিনি চিনিকল কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় এবং কৃষি ব্যাংকের সদর দফতর উত্তরবঙ্গে স্থানান্তরের দাবী জানান। এছাড়া তিনি উত্তরবঙ্গে পর্যাপ্ত পাওয়ার পাম্প ও স্প্রে মেশিন সরবরাহ করার দাবী জানান। জনাব আমানউল্লাহ অত্যন্ত জোরের সাথে বলেন, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ মাসের মধ্যে সংবাদপত্রের সাথে জড়িত কর্মচারীদের বেতন বাের্ড এবং প্রেস কাউন্সিল গঠিত হবে।১০

রেফারেন্স: ৪ জুলাই ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত