সংসদে তীব্র বিতর্ক, সরকারি সদস্যদের গভীর ক্ষোভ
সংসদ ভবন: মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর চলাকালে শিশুখাদ্য আমদানির ব্যাপারে এক ব্যাপক কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ে। এ সময়ে সংসদে সভাপতিত্ব করেছিলেন।
স্পীকার জনাব আবদুল মালেক উকিল। সরকার দলীয় সদস্য অধ্যক্ষ শেখ আবদুর রহমানের এক প্রশ্নে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জনাব আবদুল মােমিন তালুকদার টি সি বি সম্পর্ক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। এমন সময় সরকার দলীয় সদস্য শিশুখাদ্য আমদানির ব্যাপারে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি-জুন শিপিং মওসুমে ঢাকা বিভাগের বেসরকারি আমদানিকারকদের নামের তালিকার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তালিকার ১১৩ নম্বরে দেখা যায় ৭০ নং চক সারকুলার রােডে পাকিস্তান হােটেল ও রেস্টুরেন্ট নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে শিশুখাদ্য আমদানির লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। প্রশ্নকর্তা বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে জানতে চান স্বাধীনতার আড়াই বছর পাকিস্তানের নামযুক্ত একটি হােটেলকে কি করে শিশুখাদ্য আমদানির লাইসেন্স দেয়া হলাে। প্রশ্নকর্তার এই প্রশ্নের সাথে সাথে সমগ্র পরিষদে সরকার দলীয় সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যায়। তালিকায় তখন খোঁজ করে দেখা যায় পাকিস্তান নামযুক্ত মােট ৪টি প্রতিষ্ঠানকে আমদানি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জনাব শামসুদ্দিন মােল্লা তালিকার ৯৩, ১৫৭ ও ১৬৩ নম্বর নামের প্রতি স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, শুধু একটি নয় এ ধরনের ৪টি প্রতিষ্ঠানকে এ জাতীয় আমদানি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। জনাব মােল্লা তখন পরিষদে এক জোরালাে ভাষায় বক্তব্য দেন এতে পরিষদের সদস্যদের অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করেন পাকিস্তানের নামযুক্ত ৪টি প্রতিষ্ঠানকে কি করে আমদানি লাইসেন্স দেয়া হলাে। তাছাড়া একটি হােটেল ও রেস্টুরেন্টকে কিভাবে শিশুখাদ্যের আমদানি লাইসেন্স দেয়া যায় তাও জানতে চাওয়া হয়। তিনি এটাকে দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সুগভীর চক্রান্ত বলে উল্লেখ করেন এবং এসব আমদানিকারকদের আমদানি লাইসেন্স বাতিল করে তাদের শাস্তি বিধানের দাবী জানান। এসময় সরকার দলীয় সদস্য বেগম আজরা আলী তালিকার ২১৬ নম্বর নামের প্রতি স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, রংপুর টোবাকো কোম্পানি নামক একটি তামাকের প্রতিষ্ঠান কি করে শিশুখাদ্য আমদানির লাইসেন্স পায়। এরপর পরিষদে রীতিমত হট্টগােল পড়ে যায়। সরকার দলীয় সদস্যরা প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। যে কারণে স্পীকারকে ‘অর্ডার’ বলতে হয়। বিভিন্ন সদস্য হাউজের বিভিন্ন দিকে থেকে পয়েন্ট অব অর্ডার’ বলে স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। সকলেই তখন তালিকার ভুলভ্রান্তির দিকে স্পীকার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অধ্যাপিকা ফরিদা রহমান তালিকার ১৪৪ নম্বর নামের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন দীন ইলেকট্রিক এন্ড কোং নামক বৈদ্যুতিক প্রতিষ্ঠানকে কি করে শিশুখাদ্য আমদানির লাইসেন্স দেয়া হলাে? এভাবে সদস্যদের অনেকেই তালিকার বিভিন্ন নম্বরের প্রতি স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কেউ বলেন, অটো মােবাইল কারখানাকে শিশুখাদ্য আমদানি ও লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তালিকার ১৮৩ নম্বরে তার প্রমাণ রয়েছে। কেউ বলেন, ১৮৮নম্বরে একটি ঘড়ির দোকানকে এবং ২০৩ নম্বরে একটি বিড়ি ফ্যাক্টরীকে শিশুখাদ্য আমদানির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এভাবে বিষয়টি যখন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছিল স্পীকার তখন বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেন এবং তাকে এই সম্পর্কে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানান। বাণিজ্যমন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমাদ তখন বলেন, পরিষদে শিশুখাদ্য আমদানির জন্য ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি-জুন শিপিং মৌসুমে যে লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় পরিবেশন করা হয়েছে। তিনি জানান যে, তিনি ইচ্ছে করলে উল্লেখিত তালিকা থেকে পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু তা করতে হলে সত্যের অপলাপ করা হয় এবং পরিষদ সদস্যদের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় সে কারণেই তিনি তালিকাটি সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় পরিবেশন করেছেন। তিনি জানান, ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি-জুন শিপিং মৌসুমে এইসব লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছিল। জনাব মােশতাক আহমদ বলেন, তার আগে যা করা হয়েছিল তিনি তা অস্বীকার করতে পারেন না। তিনি অবশ্য আশ্বাস দেন যে, ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভুল যাতে না হয় তা লক্ষ্য রাখতে হবে।
বেগম তসলিমা বাণিজ্যমন্ত্রীর জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে ঐসব লাইসেন্স অবিলম্বে বাতিলের দাবী জানান। জনাব নুরুল হক একই দাবী তােলেন। জনাব শামসুদ্দিন মােল্লা তখন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জনাব মােশতাক আহমদ তার পূর্বেকার মন্ত্রীদের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করতে যাচ্ছেন। সরকার দলীয় তরুণ সদস্য জনাব আবদুল কুদুস মাখন অভিযােগ করেন, বাণিজ্যমন্ত্রী একটি খারাপ নজিরকে সমর্থন করছেন। তিনি এসব লাইসেন্সধারীর দ্রুত শাস্তির দাবী করেন। স্পীকার জনাব আবদুল মালেক উকিল তখন বলেন, বাংলাদেশের সার্বভৌম মাটিতে এখনও যারা পাকিস্তানের নাম নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সদস্যদের ক্ষোভ জাগা স্বাভাবিক। স্পীকার বুঝিয়ে বলেন, সদস্যদের এই ক্ষোভ পাকিস্তান শব্দটির বিরুদ্ধে নয়, কারা এই নামে ব্যবসা চালাচ্ছেন এবং কারা তাদের লাইসেন্স প্রদান করছেন তাদের বিরুদ্ধে। স্পীকার বাণিজ্য মন্ত্রী এর উপর বক্তব্য রাখতে বলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তখন স্পীকারকে আশ্বাস দেন, তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন এবং দায়ী বেব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।৩৩
রেফারেন্স: ১১ জুন, ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত