পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালির অবস্থান
১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১৩ মাস আওয়ামী লীগের সঙ্গে রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশনের সুবাদে আওয়ামী লীগের প্রধান হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই সময়ে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালি কোটা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এ পদক্ষেপ পশ্চিম পাকিস্তানিদের খুবই অপছন্দ হয়েছিল। বাঙালির বর্ধিত কোটাবিষয়ক সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বেসামরিক ক্ষেত্রের চাকরির মতাে সশস্ত্র বাহিনীতেও পাঞ্জাবিদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য ও বিপুল সংখ্যাধিক্য। অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে কিন্তু খুবই গর্বের সঙ্গে তারা মনে করত, এটা তাদের অধিকার এবং এ রকমই হওয়া উচিত। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠানেরা শৌর্য-সাহসিকতার জন্য ঐতিহাসিকভাবে সুপরিচিত ছিল এবং যুদ্ধবিগ্রহে দীর্ঘ ঐতিহ্যের অধিকারী ছিল। তারাও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীতে সংখ্যার দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বহীন অবস্থানে ছিল। বাঙালিদের মতােই সিন্ধি ও বেলুচদেরও সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় দেখাই যেত না। ইনফেন্ট্রি বা পদাতিক বাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও বেলুচ রেজিমেন্টে প্রায় সমানসংখ্যক ব্যাটালিয়ন ছিল, কিন্তু বেলুচ রেজিমেন্ট বেলুচদের রেজিমেন্ট ছিল না। বেলুচ রেজিমেন্টের শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ জুনিয়র কমিশন অফিসার (জেসিও) অর্থাৎ সুবেদার মেজর, সুবেদার ও নায়েব সুবেদার, নন-কমিশন অফিসার (এনসিও) অর্থাৎ হাবিলদার ও নায়েক এবং আদার র্যাংক (ওআর) অর্থাৎ ল্যান্স নায়েক ও সৈনিক এবং শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ কমিশন অফিসার পাঞ্জাবি ছিলেন। এমনকি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ পাঞ্জাবি ছিল। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে মাত্র দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল। সম্ভবত তখন পাঞ্জাব ও বেলুচ রেজিমেন্টে ৩০টি করে ব্যাটালিয়ন এবং সম্ভবত ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে ২০টি ব্যাটালিয়ন ছিল। বাঙালির জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যে দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল, সেখানেও শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ পাঞ্জাবি ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশ ইনফেন্ট্রি বা পদাতিক বাহিনীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বের এই চিত্র থেকে গােটা সেনাবাহিনী এবং নৌ ও বিমানবাহিনীসহ গােটা সশস্ত্র বাহিনীতে অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ধারণা পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে গােটা সশস্ত্র বাহিনীতে পাঞ্জাবিদের সংখ্যা ছিল শতকরা প্রায় ৮০ ভাগের বেশি এবং বাঙালিদের সংখ্যা ছিল শতকরা দুই ভাগের কাছাকাছি। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর স্বল্পকালীন পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির ফলে বাঙালির মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। তারা আরও আশান্বিত ছিল যে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের পর হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পুনরায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব তখন আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ৮ অক্টোবর ১৯৫৮ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারির মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের ফলে বাঙালির, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিদের সব আশাআকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।
সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কোয়েটার অর্ডন্যান্স ডেপােতে আমার যােগদানে ওই ইউনিটের মুষ্টিমেয় বাঙালি সৈনিকের মধ্যে উৎফুল্লতার সৃষ্টি হয়েছিল। আমার ব্যাটম্যানের মাধ্যমে আমি এ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলাম। অর্ডন্যান্স কোরের একজন সিপাহি, আমার ব্যাটম্যানের বাড়ি ছিল বরিশাল জেলায়। ছেলেটি বয়সে খুবই তরুণ ও লাজুক প্রকৃতির ছিল। তার নামটি কিছুতেই এখন মনে করতে পারছি না। আমার ইউনিটের অন্যান্য বাঙালি সৈনিকের সঙ্গে আমার তখনাে দেখা হয়নি বা তারা আমাকে জানারও সুযােগ পায়নি। কিন্তু আমি বাঙালি এবং একজন অফিসার, এ খবরই বাঙালি সৈনিকদের উল্লসিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে এবং খুব সহজে বাঙালি সৈনিকদের নিকটজন হয়ে গিয়েছিলাম। বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় আচরণ সম্পর্কে আমি ধীরে ধীরে জানতে শুরু করেছিলাম। আমি ধীরে ধীরে আরও উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলাম যে, বাঙালি সৈনিকেরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে প্রচণ্ডভাবে আগ্রহী। পশ্চিম পাকিস্তানিদের তারা পাঞ্জাবি বলেই জানত এবং জাতশত্রু মনে করত। বাঙালিদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সুবিধার জন্য পাকিস্তানিদের তারা ‘পাইয়া’ বলে উল্লেখ করত। পাইয়া শব্দটি কোনাে এক দেশপ্রেমিক বাঙালি সৈনিক শত্রুকে চিহ্নিত করার জন্য সাংকেতিক শব্দ হিসেবে উদ্ভাবন করেছিল, যা কালক্রমে সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। পক্ষান্তরে বাঙালি সৈনিকেরা অফিসারসহ সব বাঙালি সৈনিকের সাংকেতিক নাম দিয়েছিল ‘মুসলমান’।
বাঙালি সৈনিকদের চোখেমুখে আমি দেখতাম পাইয়াদের প্রতি তীব্র ঘৃণা। তারা বাঙালি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্ব বােধ করত। পাকিস্তানিদের বা পাঞ্জাবি ভাষায় গালাগাল বা অপমানসূচক কথাবার্তার উত্তর বাঙালিরা বাংলা ভাষায়ই দিত, যা পাকিস্তানিরা বুঝতে পারত না। কিন্তু বাঙালিরা উর্দু বা পাঞ্জাবি ভাষা তত দিনে কিছু কিছু রপ্ত করে ফেলেছিল। সেনাবাহিনীতে অফিসার ব্যতীত অন্যদের প্রশিক্ষণের ভাষা উর্দু ছিল বলে বাঙালিদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও উর্দু ভাষা সামান্য হলেও তারা বােঝার সুযােগ পেত। প্রশিক্ষণের সময় উর্দুর সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবি প্রশিক্ষকেরা কিছু কিছু পাঞ্জাবি শব্দ ও অপভাষা ব্যবহার করত। তাই বাঙালিরা উর্দুর সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবি ভাষা কিছুটা হলেও বুঝত। পাইয়ারা প্রশিক্ষণের সময় বা অন্য কোনাে অজুহাতে বাঙালিদের যতই গালাগালি দিত, বাঙালিদের মন ততই বিদ্রোহী হয়ে উঠত এবং নিজেদের বাঙালি পরিচয় অক্ষুন্ন রাখতে যে যেভাবে পারত, চেষ্টা করত। বাঙালিদের পাকিস্তানীকরণ-প্রক্রিয়া সশস্ত্র বাহিনীতে এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
কোয়েটা সেনানিবাসে খুব কমসংখ্যক বাঙালি অফিসার ছিলেন। আমাদের ইউনিট অর্থাৎ অর্ডন্যান্স ডেপােতে আমরা দুজন বাঙালি অফিসার ছিলাম । অপরজন ছিলেন আমার সিনিয়র, লেফটন্যান্ট মােসলেহ উদ্দীন আহমেদ (পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক)। অন্যান্য ইউনিটে আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। প্রায় সবার সঙ্গেই ধীরে ধীরে আমার পরিচয় হতে লাগল । কোয়েটা শহরে কয়েকজন বাঙালি বেসামরিক কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়েছিল । কুমিল্লার ডা. মহিউদ্দীন আহমেদ কোয়েটার বেসামরিক হাসপাতালে চাকরি করতেন। কোয়েটা শহরে তাঁর বাসায় প্রায়ই সামরিক-বেসামরিক বাঙালিদের আড্ডা জমতো। ডা. মহিউদ্দীনের স্ত্রীর গান শােনা, তার হাতে রান্না করা ভাত মাছ খাওয়া, কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলা ইত্যাদি ছাড়াও এসব আড্ডার মূল আকর্ষণ ছিল বাঙালদের এক আসরে একত্র হওয়া। কোয়েটা সেনানিবাসে বিবাহিত বাঙালি অফিসারদের বাসায় আমরা অবিবাহিতরা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতাম। বিশেষ করে ছুটির দিনে আমরা বাঙালি অফিসারদের বাসায় বাঙালি খাবার ছাড়াও বাংলা গান উপভােগ করতাম।
ক্যাপ্টেন ডা. শরফউদ্দীন আহমেদ (এস ডি আহমেদ, পরবর্তীকালে কর্নেল) তখন কোয়েটা সিএমএইচে প্যাথলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন এবং মহান ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি কয়েক বছর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েছিলেন এবং ডিপ্লোমা গ্রহণ করে তৎকালীন পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকরি করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি এলএল ডিগ্রি লাভ করেন। সেনাবাহিনী থেকে কর্নেল পদে অবসর গ্রহণের পর তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন। বৈচিত্র্যময় শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রতিভার অধিকারী এস ডি আহমেদ কোয়েটাতে এক দিন; আরেকজন অবিবাহিত সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন (পরবর্তীকালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ডা. শফিকুল কাদের এবং আমাকে তার বাসায় দুপুরে খেতে বললেন। তার বাসায় খাওয়া শেষে আমরা আড্ডায় বসলাম এবং তিনজনই বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঔপনিবেশিক শাসন ও অর্থনৈতিক শােষণের বিষয় আলােচনা করে পাকিস্তান নামক দেশটি বাঙালিদের দেশ নয় বলে সিদ্ধান্তে পৌছালাম এবং বাঙালিদের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা প্রয়ােজন বলে আমরা ঐকমত্য পােষণ করলাম। এস ডি আহমেদ আমাদের দুজনের চেয়ে সিনিয়র ছিলেন এবং আলােচনায় তার অংশগ্রহণই প্রাধান্য পেয়েছিল। তার কথা শুনে আমাদের মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সময় যেসব বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানে আটক থাকবে, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশে আটক পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিনিময় কীভাবে হবে, তাও তিনি চিন্তা করে রেখেছিলেন। সে ক্ষেত্রে নৌপথে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বাে বন্দরে বিনিময়ের কাজ সম্পন্ন হতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কীভাবে অর্জিত হবে, সে সম্পর্কে তার বা আমাদের দুজনের কারােরই অবশ্য তখন কোনাে স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
স্বাধীনতা অর্জন করা প্রয়ােজন—এ বিষয়ে আমার চিন্তার সংগে এস ডি আহমেদ ও শফিকুল কাদেরের চিন্তার মিল দেখে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। ১৯৬০ সালের কোনাে এক সময়ে আমাদের তিনজনের এই আলােচনার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এস ডি আহমেদ ও শফিকুল কাদের দুজনই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে আটক ছিলেন কিন্তু নৌপথে কলম্বো হয়ে তাঁরা বাংলাদেশে ফেরত আসতে পারেননি। এসেছিলেন আকাশ পথে। এস ডি আহমেদ ও আমি ঢাকার উত্তরা মডেল টাউনে কাছাকাছি থাকি। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন। মাঝে মাঝে কথা হয় আমাদের দুজনের । বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা পুনরুদ্ধার করে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশকে উন্নত করতে পারবে বলে আমরা দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করি। তিনি দেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শফিকুল কাদেরের সঙ্গে এখন আমার যােগাযােগ নেই বললেই চলে।
কোয়েটায় পারুল ভাবি ও রব ভাইয়ের (ক্যাপ্টেন এ এফ এম আবদুর রব) সঙ্গে আমি খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। রব ভাই প্রথমে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং পরে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ছিলেন। কোয়েটাতে তিনি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইএমই) সেন্টার ও স্কুলের কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে এক্সট্রা রেজিমেন্টাল এমপ্লয়মেন্ট (ইআরই) পােস্টিং পেয়েছিলেন। রব ভাইয়ের বাসায় প্রায় নিয়মিতভাবে ছুটির দিনে বাঙালিদের আড্ডা এবং কন্ট্রাক্ট ব্রিজের আসর বসত। তাঁর স্নেহময়ী স্ত্রী পারুল ভাবি বাঙালিদের উপাদেয় ভাত-মাছ খাওয়াতেন এবং আমাদের আদর-আপ্যায়ন করতে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যস্ত থাকতেন। পারুল ভাবি আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তার কাছে আমি যে স্নেহ-মমতা পেয়েছি, তা কোনাে দিন ভুলতে পারব না।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আলােচনা হতাে। কিন্তু তখন কোনাে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। আমার মনে হয়েছিল, সবকিছুর আগে আমাদের পেশাগত মান বৃদ্ধি করা প্রয়ােজন, যাতে আমরা সামরিক পেশার সব শাখায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারি। বাঙালিদের আত্মপ্রত্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরা মার্শাল রেস নয়–পশ্চিম পাকিস্তানিদের এ রকম বক্তব্যকে ভ্রান্ত প্রমাণ করাও আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করলাম, অন্যান্য বাঙালি অফিসার ও সৈনিকও একইভাবে কঠোর অনুশীলন করে পেশাগত মান উন্নয়ন করতে তৎপর হয়েছেন। যদি এ বিষয়ে আমি তখনাে কারও সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনাে আলােচনা করিনি, কিন্তু আমার মনে হতাে যে অলিখিত চুক্তি হিসেবে একটি অভিন্ন লক্ষ্য আমরা সবাই মনে মনে স্থির করে নিয়েছি। তাই কোনাে সলাপরামর্শ বা আনুষ্ঠানিক আলােচনা ছাড়াই সবার করণীয় সম্পর্কে অভিন্ন সিদ্ধান্ত নিজেরাই গ্রহণ করেছিলাম। এর ব্যতিক্রম একেবারেই যে ছিল না এমন নয়। বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ খাটি পাকিস্তানি হওয়ার চেষ্টায়ও রত ছিল। যদিও তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। প্রায় সব বাঙালি সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানিদের থেকে নিজেদের পৃথক একটি জাতি বা বাঙালি জাতি হিসেবেই মনে করতে শুরু করেছিল। নৌ ও বিমানবাহিনীতেও একইভাবে বাঙালিরা নিজেদের বাঙালি বলে ভাবতে এবং পরিচয় দিতে গর্ব বােধ করত। বেসামরিক বাঙালিদের মতােই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ধীরে ধীরে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিদেরও স্পর্শ করতে থাকে। বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের মধ্যে আমার মতাে অনেকেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার বা সৈনিক না হয়েও বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে গর্বিত ছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন যেকোনাে ক্যান্টনমেন্টেই খেলাধুলা, শারীরিক যােগ্যতা, সামরিক মহড়া ইত্যাদিতে অধিকাংশ সময়ই চ্যাম্পিয়ন হতাে। একইভাবে যেকোনাে বাঙালি যেকোনাে বিষয়ে পারদর্শিতা প্রদর্শন করে কোনাে পুরস্কার পেলে বা সুনাম অর্জন করলে তা সব বাঙালির জন্য হতাে অভিন্ন গর্বের বিষয়। বাঙালিরা সংস্কৃতিগতভাবে পৃথক ঐতিহ্য ও পরিচয় বহন করত। সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও কতিপয় বাঙালি অফিসার নিজেদের পরিবারের মধ্যে উর্দু ভাষায় কথা বলত । বাঙালি ছেলেমেয়েদের উর্দু ভাষায় কথা বলতে শুনলে আমি খুবই কষ্ট পেতাম। বাংলা ভাষার পরিবর্তে কেন বাঙালিরা উর্দু ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলত, তা আমার বােধগম্য হয়নি। হয়তাে তারা পাকিস্তান নামক দেশকে নিজেদের দেশ বলে মেনে নিতে পেরেছিল । অথবা পাকিস্তানিদের খুশি করার জন্য তারা এ রকম করত।
সশস্ত্র বাহিনীতে আমরা অফিসাররা প্রাক-কমিশন থেকে শুরু করে সব। প্রশিক্ষণ কোর্সে ইংরেজিতে কথা বলতাম। তখন বলা হতাে, No Vernacular অর্থাৎ ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলা যাবে না। যখন জেসিও এবং এনসিওরা ক্লাস নিতেন, তখন অবশ্য প্রশিক্ষণের মাধ্যম হিসেবে উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হতাে। তাতে বাঙালিদের অসুবিধা হলেও তাদের কিছুই করার ছিল না। ১৯৬৩ সালের প্রথমার্ধে আমি যখন কোয়েটাস্থ স্কুল অব ইনফেন্ট্রি এন্ড ট্যাকটিক্স (School of Infantry and Tactics) এ অফিসার্স উইপনস এন্ড জুনিয়র নকটিকস কোর্স (Officers Weapons and Junior Tactics Course- OWJTC) করতে গেলাম তখন দেখলাম, অফিসাররাও উর্দু ভাষায় ক্লাস নিচ্ছেন। মজার ব্যপার হয়েছিল দুজন বাঙালি ইনস্ট্রাক্টরকে নিয়ে। তাদের একজন ক্যাপ্টেন আমজাদ হোসেন চৌধুরী (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এবং ব্যবসায়ী, প্রাণ গ্রুপের স্বত্বাধিকারী) এবং অপরজন ক্যাপ্টেন আবুল মনজুর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল এবং ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পরপর নিহত)। দুজনই ভালাে অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু উর্দু ভাষায় ক্লাস নিতে কোয়েটার শীতেও তাদের ঘর্মাক্ত হতে হতাে। ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলেও, পাকিস্তানিরা নিজস্ব পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছিল, যেভাবেই সম্ভব উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দিতে। অফিসারদের ক্লাসে অফিসাররা ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে উর্দু ভাষায় বক্তৃতা দিলে এ কথারই প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাঙালিদের মধ্যে যারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের উর্দু ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত করত, আমি তাদের সংস্পর্শে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম হলেও তাদের হীনম্মন্যতা আমাকে পীড়া দিত। সে কারণে আমি খাঁটি বাঙালি অর্থাৎ মনে, প্রাণে, কথায়, আচরণে, সংস্কৃতিতে যারা বাঙালি তাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতাম। বাঙালি খাবার, বাংলা গানের আসর যেখানেই হতাে আমি সেখানে যেতাম। বাঙালি হয়েও যে দু-একজন বাঙালি অবাঙালিদের মতাে আচরণ করত, তারা বাঙালিদের সংস্কৃতিতে চিড় ধরাতে পারেনি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রতচারী নৃত্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি সংস্কৃতি সমৃদ্ধির পথ তাতে প্রসারিত হয়। পাকিস্তানিদের মধ্যেও ব্রতচারী নৃত্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর এই তুলনাহীন কাজটির পরিকল্পনায় ছিলেন মরহুম কর্নেল এম এ জি ওসমানী।১ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ ঘটানাের ক্ষেত্রে জেনারেল ওসমানীর অবদান অনস্বীকার্য। সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা জেনারেল ওসমানীকে আদর ও সম্মান করে ‘চাচা’ নাম দিয়েছিল । সেপাই থেকে শুরু করে সব পদের বাঙালিরাই তাকে ‘চাচা’ বলে উল্লেখ করত। চাচার সঙ্গে অনেকেরই দেখা-সাক্ষাৎ না থাকলেও তিনি সবার চাচা এবং নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন সব বাঙালির অভিভাবক। ওসমানী ছিলেন চিরকুমার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাঁর সর্বশেষ নিয়োগ ছিল জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে ডেপুটি ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস হিসেবে। রাওয়ালপিন্ডি ক্লাবের ৫নং রুমে তিনি থাকতেন। আমরা যখনই সুযোগ ও সময় পেতাম, রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম। সেনাবাহিনীর নিয়মবিধির মধ্যে থেকে তিনি যতটা সম্ভব, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। কখনাে কখনাে তিনি নিয়মের বাইরেও বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের পক্ষে কথা বলতেন। সে জন্য তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছে প্রচণ্ড। তার মতাে মেধাসম্পন্ন এবং পেশাগত দিক দিয়ে প্রশ্নাতীতভাবে দক্ষ একজন সিনিয়র অফিসারকে সে জন্যই কর্নেল পদের উর্ধ্বে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। সবকিছু মিলে তিনি সামরিক- বেসামরিক মহলে জীবন্ত ইতিহাস হয়ে ওঠেন। তার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও সামরিক প্রজ্ঞার কারণেই বাঙালি-সম্পর্কিত যেকোনাে বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও তিনি সশস্ত্র বাহিনীর, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর বাঙালিবিষয়ক উপদেষ্টার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি সশস্ত্র বাহিনীতে একটি প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউশনে রূপান্তরিত হয়ে যান। আমি নিজে সেনাবাহিনীতে যােগদানের আগেই ওসমানীর নাম শুনেছি। তখনাে তিনি কর্নেল ছিলেন। অবসরও গ্রহণ করেছেন কর্নেল পদে। তার পদোন্নতি না হওয়ার বিষয়টি বাঙালি সামরিক-বেসামরিক মহলে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আমার চাকরি জীবনের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করার মতাে। ১৯৬২ সালে আমি রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডেপোতে চাকরিরত ছিলাম। কঙ্গো তখন গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে কঙ্গোতে সামরিক কন্টিনজেন্ট পাঠানাে হয়েছিল। এই কন্টিনজেন্টে মূলত অর্ডন্যান্স কোরের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের নেতৃত্বে কয়েকজন অফিসার এবং অন্যান্য পদের বেশ কিছুসংখ্যক জেসিও/এনসিও/ওআর ছিলেন। সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডেপো রাওয়ালপিন্ডি থেকে অর্ডন্যান্স কোরের কয়েকজন সিপাহি নির্বাচন করার দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছিল। কিন্তু দায়িত্ব আমার থাকলেও ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হলাে এমন একটি তালিকা, যাতে একজন বাঙালির নামও ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদ করে খুব সুবিধা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চাচার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। চাচা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মােহাম্মদ মুসাকে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত আমি সম্ভবত পাঁচজন বাঙালি সিপাহিকে কঙ্গো পাঠাতে পেরেছিলাম।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পেশাগত মান উন্নত ছিল না। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, তা অতিরঞ্জিত ছিল। বলা হতাে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পৃথিবীর অদ্বিতীয় সেনাবাহিনী। কমিশন প্রাপ্তির পরই আমার মনে হতে লাগল, ওই রকম কথা ছিল নিছকই ফাঁকা বুলি। বাঙালিরা পাকিস্তানিদের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী বলে আমার বিশ্বাস জন্মেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের ভিন্ন পরিচিতি ছিল এবং তা ছিল অতিশয় গর্বের। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের টাইগার নামটি সব বাঙালিকে উজ্জীবিত করত।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দলাদলি বা পৃথক গ্রুপ ছিল। পাকিস্তান সষ্টির পর যারা ভারত থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল তাদের রিফিউজি বা মােহাজের বলা হতাে। বাংলাদেশেও যারা ভারত থেকে এসেছিল তাদের জন্য রিফিউজি বা মােহাজের শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার বা হতাে। কিন্তু রিফিউজি বলে কাউকে ছােট করে দেখা বা নিন্দা করা খুবই গর্হিত বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। যারা ভারত থেকে এসেছে তারা ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পত্তি এমনকি অনেকে খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ছেড়ে চলে এসেছে। তাদের নিজেদের কোনাে ত্রুটির কারণে এ রকম ঘটেনি। ভারতবিভক্তিই এ জন্য দায়ী। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে যারা ভারত থেকে বিভক্তির কারণে চলে এসেছিল, তাদের রিফিউজি বা মােহাজের হিসেবে পরিচিতি বহন করতে হতাে বলে স্বাভাবিকভাবে তারা হীনম্মন্যতায় ভুগত এবং তাদের অজান্তেই তারা নিজেরা পৃথক একটি গােষ্ঠী বা গােত্রে পরিণত হয়েছিল। তারা সংগত কারণেই দাবি করত যে পাকিস্তান সৃষ্টির কারণেই তারা দেশছাড়া, গৃহহারা হয়েছে। কেউ কেউ আবার তাদের হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য বলত যে তারাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে এবং সে কারণেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে সব ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। যদিও তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল এবং চাকরির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতাে কিন্তু তারাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে—এ কথা পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ মেনে নিতে পারেনি। বাস্তবতা ছিল এই, পাকিস্তান সৃষ্টির কারণে তারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল, যা তাদের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট বয়ে এনেছিল। কিন্তু তারাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে—এ কথা নিঃসন্দেহে সত্যের অপলাপ ছিল এবং উভয় পাকিস্তানে মোহাজেরদের বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে এ সমস্যা আরও প্রকট হয় যখন তারা রাজনৈতিকভাবে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তারা নগ্নভাবে বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলে ধিক্কার দিয়ে বাঙালিদের রাষ্ট্রভাষার দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। তকালীন শাসককূল এ সুযােগ গ্রহণ করে মােহাজেরদের বাঙালিদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। বাঙালিদের অন্যান্য দাবির ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটতে থাকে । এভাবেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি-বিহারি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, যা কোন কোন সময় সহিংস রূপ ধারণ করে। ভারত বিভক্তির পর পশ্চিম বাংলা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক মুসলমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। কিন্তু কালক্রমে সব অবাঙালি মােহাজের ‘বিহারী’ বলে পরিচিত হতে থাকে। বিহারি শব্দটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি গালি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সব অবাঙালি মােহাজের পাকিস্তানিদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ঢাকার মিরপর- মােহাম্মদপুর এলাকা এবং ঢাকার বাইরে খালিশপুর, সৈয়দপুর ইত্যাদি বিহারি-অধ্যুষিত ছিল। এসব এলাকায় বাঙালি-বিহারি দাঙ্গায় অনেক রক্তপাত হয়েছিল। এখনাে কয়েক হাজার মােহাজের পাকিস্তানে প্রত্যাগমনের জন্য ঢাকার জেনেভা ক্যাম্পে অপেক্ষা করছে।
পশ্চিম পাকিস্তানে সংগত কারণেই মােহাজের সমস্যা থেকেই গেছে। হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান এই ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব উপমহাদেশে যে অশান্তির বীজ বপন করেছিল, তা থেকে কোনাে দিন উপমহাদেশের মানুষ মুক্ত হতে পারবে কি না, নিশ্চিত করে বলা যায় না। পশ্চিম পাকিস্তানে মােহাজের কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)। একপর্যায়ে সহিংস এবং সশস্ত্র রূপ ধারণ করে। বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি শহরে এমকিউএম এখনাে নানাভাবে সহিংস বিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে। মােহাজের বা রিফিউজিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এর জন্য দায়ী বলে অনেকেই মনে করে। পক্ষান্তরে স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করে, ভারত থেকে আগত মােহাজেরদের অনেক সুযােগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও তাদের দাবির কোনাে শেষ নেই। ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্ব পাকিস্তান নামক দেশে অশান্তি ও স্থায়ী অব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। অথচ দ্বিজাতিতত্ত্ব বলেছিল, মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রয়ােজন, আর সেই রাষ্ট্র হবে মুসলমানদের জন্য স্বর্গরাষ্ট্র। বাস্তবে সেই রাষ্ট্রে যে নরকের স্বাদ স্থায়ী হয়ে থাকবে, যার ফলে মুসলমান-মুসলমান দাঙ্গা রূপ ধারণ করবে, তা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেবের কল্পনায়ও আসেনি। তা ছাড়া শিয়া- সুন্নি, মুসলমান-কাদিয়ানি ইত্যাদি সমস্যা পাকিস্তানকে কুরে করে খাচ্ছে। অথচ শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানি সবাই মুসলমান। পাকিস্তানে ইতিমধ্যে উগ্র মৌলবাদীদের চাপে কাদিয়ানিদের অমুসলমান ঘােষণা করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ধর্মের নামে এর চেয়ে বর্বরতা আর কিছু হতে পারে না। হয়তাে একসময় শােনা যাবে যে শিয়াদেরও অমুসলমান ঘােষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশেও ধর্মের নামে এই বর্বরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কাদিয়ানীদের অমুসলমান ঘােষণার দাবি করছে কতিপয় ধর্মান্ধ গােষ্ঠী। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অসাম্প্রদায়িক ভিত্তির কারণে এই ধর্মান্ধ গােষ্ঠী তাদের দাবির পেছনে এখনাে জনমত সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির সাম্প্রদায়িক ভিত্তির কারণে ধর্মান্ধ গােষ্ঠী পাকিস্তানে ইতিমধ্যে সফল হয়েছে। বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের মসজিদ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গবেষণা কেন্দ্রে হামলা করেও ধর্মান্ধ গােষ্ঠী বেশি দূর এগােতে পারেনি। কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে ফতােয়া জারি এবং সহিংস আক্রমণের পেছনে যে মানসিকতা কাজ করে, তার সঙ্গে প্রকৃত ধর্মীয় চিন্তা কাজ করে না। কাজ করে ধর্মের নামে রাজনীতি বা ব্যবসা করার মানসিকতা। মানুষের মঙ্গলের জন্যই ধর্ম এসেছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ কবি চণ্ডীদাসের এই উক্তি কোনাে ধর্মই অস্বীকার করে না। পশ্চিম পাকিস্তানে কাদিয়ানিদের অমুসলমান ঘােষণা করার ফলে অ-কাদিয়ানি মুসলমানদের কী লাভ হয়েছে, তা কেউ বলতে পারবে না।
স্থানীয় মােহাজের, শিয়া, সুন্নি ও কাদিয়ানি সমস্যা ছাড়াও পাকিস্তানে নানা ধরনের দলাদলি বা মানবিক মূল্যবােধহীন কোন্দল খুবই প্রকট। পাঞ্জাবি, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ, হাজারা উপজাতি ইত্যাদি সমাজের সর্বস্তরে দৃশ্যমান। জেলাভিত্তিক দলাদলি যেমন ঝেলামি, গুজরাটি অনেক অনর্থের সৃষ্টি করে থাকে। তা ছাড়া গােত্রগত সমস্যা তাে আছেই। সর্বোপরি বৃহৎ ভূস্বামী জোতদার, জমিদার তথা সামন্ত প্রভুরা দীর্ঘকাল ধরে সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার মালিকেরা এখন অনেকাংশে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণশক্তির অংশীদার। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সামরিক-বেসামরিক আমলারা দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার ফলে সে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সে দেশের মানুষ পূর্বের মতােই ক্ষমতার পূজারি হয়ে। নিজেদের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে নির্বিকার।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ২৪ জানুয়ারি ১৯৫৯ তারিখে কমিশন প্রাপ্তির পর সেনাবাহিনীর পেশাগত মান দেখে আমি হতাশ হই। ছােটবেলা থেকে শুনে এসেছিলাম যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী। কিন্তু তা যে শুধু ফাকা বুলি, তা আমি উপলব্ধি করা শুরু করলাম। পরবর্তীকালে অবশ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে যে তারা নিজেদের দেশের নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে এবং দেশের শাসনক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে খুবই দক্ষ।
১৯৭১ সালে বাংলদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর তারা যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা তাদের পেশাগত মানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেনি । প্রমান করেছে তাদের বর্বরতা, হিংস্রতা ও কাপুরুষতা। তার আগে ও পরে পাকিস্তানিদেরই বিরুদ্ধে, বিশেষ করে বেলুচিস্তানে তাদের বর্বরতা ইতিহাস হয়ে আছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের ঘােষিত শত্রু ভারতের সঙ্গে কোনাে যুদ্ধে অদ্যাবধি তারা জয়লাভ করতে পারেনি।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাজ-সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র খুব নিম্নমানের ছিল । ১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সামরিক চুক্তি Mutual Defence Aid Pact (MDAP) 915 Mutual Aid Pact (MAP) এর আওতায় পাকিস্তান যে সাজ-সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র পায়, তা মূলত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এবং পরে কোরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে সেগুলােকে রিকন্ডিশন করে চুক্তির আওতায় পাকিস্তানে সরবরাহ করা হয়। এগুলাের খুচরা যন্ত্রাংশ যা সরবরাহ করা হয়েছিল, তা ছিল খুবই অপ্রতুল। মার্কিনদের সরবরাহ করা যানবাহন প্রায়শই অকেজো হয়ে পড়ত। মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত United States Military Assistance Advisory Group (USMAAG) পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তরে এবং বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বসে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মনিবসুলভ আচরণ করত এবং বিভিন্ন শর্ত আরােপ করে নির্দেশ জারি করত। মার্কিনদের সাহায্য প্রকৃত অর্থে তেমন কোনাে কাজে আসেনি। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে সামরিক ঘাটি স্থাপন করে তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গােয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা। মার্কিনদের রণনীতি ছিল পাকিস্তান এবং রেজা শাহ পাহলভীর ইরানের মতাে তাদের অনুগত রাষ্ট্রে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের চারপাশে আক্রমণাত্মক বৃত্ত তৈরি করা। এই রণনীতির অংশ হিসেবে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের রাজধানী পেশােয়ারের কাছে একটি বিমানঘাটি মার্কিন গােয়েন্দা বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য ব্যবহার করত। গােয়েন্দা বিমানগুলাের নাম ছিল U2 বিমান। এ রকম একটি বিমান ১৯৬০ সালের মে মাসে সােভিয়েত ভূখণ্ডের আকাশসীমার মধ্যে সােভিয়েত বিমানবাহিনী গুলি করে ভূপাতিত করছিল। বিষয়টি নিয়ে তখন পৃথিবীব্যাপী উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকা দেখা দিয়েছিল। তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতা নিকিতা ক্রুশচেভ পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীকে কঠোর ভাষায় সমালােচনা করেছিলেন এবং ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে এ ধরনের কোনাে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। আমি তখন অর্ডন্যান্স ডেপাে, কোয়েটায় কর্মরত ছিলাম। নিকিতা ক্রুশচেভের উক্তি ‘পাকিস্তানলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে’ আমার অনেক পাঞ্জাবি সহকর্মীর বুকে কম্পন সৃষ্টি করেছিল। অতঃপর পাকিস্তান সরকার সতর্কতা অবলম্বন করে এবং আর কোনাে গােয়েন্দা বিমান পাকিস্তানের মাটি থেকে উড্ডয়ন বা অবতরণ করেনি।
পাকিস্তান বৈদেশিক নীতিতে বরাবরই মার্কিন ঘেঁষা ছিল। পাকিস্তানের ভৌগােলিক অবস্থানের সঙ্গে এই নীতি সংগতিপূর্ণ ছিল না। তা ছাড়া, ধর্মীয় রাষ্ট্র ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান বিবেচনায় অর্থাৎ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মার্কিনঘেঁষা বৈদেশিক নীতি খুব অযৌক্তিক ছিল। মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে প্যালেস্টাইন প্রশ্নে মার্কিন নীতি কোনাে মুসলমান-অধ্যুষিত রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযােগ্য হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় তথা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যারা ব্যবহার করে, তাদের নীতি-অবস্থান যুক্তিগ্রাহ্য না হওয়ারই কথা। ধর্মও রাষ্ট্রদুটি একেবারেই পৃথক বিষয়। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এ রকমই হওয়া উচিত সব রাষ্ট্রের মৌল নীতি। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ এই কালজয়ী উচ্চারণ সব ধর্মের মানুষের কাছেই গ্রহণযােগ্য হওয়া উচিত।
ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের শুরুই হয়েছিল ভ্রান্ত নীতির ভিত্তিতে। তাই পরবর্তীকালে পদে পদে পাকিস্তানি নেতারা ভুল করে চলেন। আইয়ুব খানের মতাে লৌহমানবও তাই ভ্ৰান্ত বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন। তাদের ভারতবিরােধী অবস্থান সাম্প্রদায়িক মানসিকতারই নামান্তর। আর এই মানসিকতার উৎপত্তি হয়েছিল তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ভারত বিভক্তির পর তাই নব্য স্বাধীন দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বৈরী সম্পর্ক ক্রমে ক্রমে দূর হতে পারত যদি সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করা যেত। দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভাবক কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তান সৃষ্টির পরপর তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম বৈঠকে নীতিনির্ধারণী বক্তব্যে তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিসমাপ্তি টেনে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে নাগরিক হিসেবে সকলেই পাকিস্তানি, কেউ মুসলমান বা কেউ হিন্দু থাকবে না’। কিন্তু জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের নেতারা তার নীতিনির্ধারণী বক্তব্য ভুলে গিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালু করেন। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নিজেদের ভােটে নিজ নিজ ধর্মের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, চালু করে তারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গােড়াপত্তন করে। মুসলমানদের ভাষা উর্দু আর হিন্দুদের ভাষা বাংলাএ রকম ঘোষণা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে খােলাখুলিভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। পাকিস্তানের নামকরণ ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান এবং মুসলমান ছাড়া অন্য কোনাে ধর্মের লােক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে না এ রকম সাংবিধানিক বিধান পাকিস্তানকে চূড়ান্তভাবে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে। পাকিস্তানের নেতারা গর্বের সঙ্গে বলতেন, ‘পাকিস্তান একটি ideological state’। সাম্প্রদায়িকতাই ছিল তাদের ideology, এ কথা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি। এভাবেই ভারত বিভক্তির কুফল দুটি দেশকে সংঘাত ও যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। বারবার দুটি দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ভারতও পিছিয়ে থাকেনি। কিন্তু ভারত অন্য কোনাে দেশের সঙ্গে কোনাে সামরিক চুক্তি করেনি। ভারত নিজেদের প্রস্তুত করা সামরিক সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করেছিল এবং কিছু সামরিক সরঞ্জাম তারা তাদের পছন্দমতাে অন্য দেশ থেকে ক্রয় করত। কিন্তু পাকিস্তান নির্ভর করেছিল শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জামের ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তি এই নীতিরই ফল। এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করা হয়েছিল এবং পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছিল। এ ছাড়া পাকিস্তান মার্কিনদের উদ্যোগে গঠিত দুটি সামরিক জোটের জুনিয়র পার্টনার হয়েছিল। এর একটি SEATO (South East Asia Treaty Organization) অপরটি CENTO (Centra Treaty Organization)। এভাবেই পাকিস্তান তার ভূ-প্রাকৃতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিলে তা কত ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে, ভারত বিভক্তির আগে ও পরে তা প্রত্যক্ষ করা গেছে। ১৯৪০ সাল থেকে অবিভক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় এবং ১৯৪৬ সালে তা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। হাজার হাজার মুসলমান, হিন্দু, শিখ এবং অন্য ধর্মাবলম্বী একে অপরের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিহত ও আহত হয়। নারী ও শিশুরাও এই খুন-জখম থেকে বাদ যায়নি। লাখ লাখ মানুষ হয় গৃহহারা, সর্বহারা। আজও ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রেশ চলছে। ভ্রন্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতা এভাবেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশে মানবজাতির অকল্যাণ সাধন করে চলছে।
সামরিক বাহিনীতে ও বেসামরিক অঙ্গনে আমি পশ্চিম পাকিস্তানিদের গভীরভাবে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করি। বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে মেলামেশা করে আমার মনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন পরিচ্ছন্ন হয়ে ফুটে ওঠে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আমার বিশ্বাস আরও গভীর হয়। পশ্চিম পাকিস্তান এবং এর অধিবাসীদের সঙ্গে বাংলাদেশ ও বাঙালিদের কোনাে মিল আমি খুঁজে পাইনি। আধুনিক রাষ্ট্রের কোনাে শর্তই পাকিস্তান পূরণ করেনি। ভূখণ্ডগত অভিন্ন সীমানা ছিল না, মানুষের ভাষা ভিন্ন, সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি ভিন্ন। সামাজিক রীতিনীতি পৃথক। এসব কারণে পাকিস্তান ছিল বহুজাতিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানি জাতি সৃষ্টি হওয়ার কোনাে সম্ভাবনাই ছিল না। ফরমান বা ডিক্রি জারি করে জাতি গঠন সম্ভব নয়। তা ছাড়া পাকিস্তানে প্রথম থেকেই পাঞ্জাবিদের আধিপত্য পাকিস্তানি জাতি গঠনে সহায়ক ছিল না। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ছিল একেবারেই অলীক চিন্তা। তাই রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান টেকেনি। পাকিস্তানের এখন যা অবশিষ্ট আছে, তাও একই কারণে ভেঙে টুকরা টুকরা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একই অফিসার্স মেসে থেকে এবং একই ইউনিটে কর্তব্য পালন করে, একই সামরিক শৃঙ্খলা মেনে চলেও পশ্চিম পাকিস্তানি সহকর্মীদের কাছ থেকে আমি মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন বােধ করতাম। মনে হতাে কিছুদিনের জন্য অন্য দেশে এসেছি। শিগগিরই দেশে, স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যাব। তবু জীবনযাপনের স্বাভাবিক নিয়মেই পশ্চিম পাকিস্তানি সহকর্মীদের সঙ্গে ইউনিটে কাজ করতাম, অফিসার্স মেসে আড্ডা জমাতাম। কন্ট্রাক্ট ব্রিজ, বিলিয়ার্ডস, টেবিল টেনিস ইত্যাদি ইনডাের খেলা ভালাে খেলতাম। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, স্কোয়াশ র্যাকেট, বাস্কেট বল, বেস বল ইত্যাদি আউটডাের খেলায়ও পিছিয়ে ছিলাম না। ব্যাচেলর জীবন কাটিয়েছিলাম মােটামুটি আনন্দ-উৎফুল্লতার মধ্য দিয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানি সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল । কয়েকজনের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কও ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ সহকর্মীর ছিল বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে করুণা, যা আমাকে মনে মনে বিদ্রোহী করে তুলত। অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল (OTS), কোহাটে প্রশিক্ষণের সময় একদিন রাইফেল শ্যুটিংয়ে আমি সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়ার পর উইপনস ট্রেনিং অফিসার (WTO) আমাকে উচ্ছ্বসিতভাবে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল, ‘সাবাস। ইতিপূর্বে কোনাে বাঙালিকে এত ভালাে শ্যুট করতে আমি দেখিনি।’ এই প্রশংসার মধ্যে বাঙালি জাতির প্রতি যে প্রচ্ছন্ন নিন্দা জড়িয়ে ছিল, তা আমাকে ক্ষিপ্ত করে। যদিও WTO একজন পাঠান ক্যাপ্টেন ছিল। বাঙালিদের নিন্দা করতে কোনাে পশ্চিম পাকিস্তানিই পিছিয়ে ছিল না। ভালাে শ্যুটিংয়ের জন্য প্রশংসা করলে আমার খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু অন্যান্য বাঙালিদের নিন্দা করে আমার প্রশংসা আমার নিজের নিন্দা বলে আমি মনে করেছিলাম। অন্যান্য বাঙালির কথা না বলে শুধু আমার প্রশংসা করলেই শােভনীয় হতো। কিন্তু কারণে-অকারণে বাঙালি জাতিকে হেয় করে কথা বলা পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। তারা সবাই বাঙালি জাতিকে নিম্নশ্রেণীর জাতি বলে মনে করত, যা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের Friends Not Masters বইতে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছিলেন, Bengalees have all the inhibitions of a down trodden nation’ অর্থাৎ একটি অধঃপতিত জাতির সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাঙালি জাতির আছে। বাঙালি জাতির প্রতি অপমানসূচক কথা প্রায়ই আমাকে শুনতে হতাে এবং প্রায়ই আমাকে তাতে তিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হতাে। কখনাে কখনাে পশ্চিম পাকিস্তানি উর্ধ্বতন অফিসারদের বাঙালি জাতি সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদ করতাম। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেউ কেউ আমার প্রতিক্রিয়া শুনে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আবার কেউ কেউ হাসি-ঠাট্টা করে মন্তব্য করতেন যে আমি অতিশয় আবেগপ্রবণ। হ্যা, বাঙালি জাতির প্রতি কোনাে অশােভন মন্তব্যের ব্যাপারে আমি অবশ্যই আবেগপ্রবণ ছিলাম এবং এখনাে আছি। সব বাঙালিরই তা হওয়া উচিত। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বাঙালিরা অপাঙক্তেয় বা বড়জোর করুণার পাত্র ছিল। প্রতিনিয়ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের এ রকম ধারণা দিতে কোনাে রাখঢাক করত না। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের এ রকম আচরণই প্রাপ্য ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রশংসা করার মধ্যে আমি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা অনুভব করতাম। পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করত, সাধারণভাবে বাঙালিরা কোনাে প্রশংসা পাওয়ার যােগ্য নয়। আমার মতাে দু-একজন ব্যতিক্রম বলে তারা মনে করত। কখনাে কখনাে তারা আমার শরীরের উচ্চতা ও রং সম্পর্কে বলত যে আমি বাঙালিদের মতাে নই। তারা আরও বলত যে আমার মতাে মেধাবী খুব কম বাঙালিই আছে। এসব মন্তব্য বাঙালি জাতির প্রতি চরম অবমাননা বলে আমি মনে করতাম। শুধু বাঙালিরাই বুঝত, তাদের পায়ের জুতা কোথায় কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা তা বুঝতে চাইত না। কেউ কেউ মন্তব্য করত, ‘বাঙালিরা ভালােভাবে কাপড় পরে না, বেশির ভাগই ন্যাংটো থাকে।’ আরও বলত, ‘বাঙালি মুসলমানরা হিন্দুদের পীরের মতাে ভক্তি করে’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাঙালিরা কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে বড় কবি মনে করে’ ইত্যাদি। ওটিএসে ক্যাডেট থাকার সময় একদিন আমার সঙ্গে আসিফ নামে একজন পাঞ্জাবি ক্যাডেটের বাঙালি জাতি প্রশ্নে বচসা হয়। একপর্যায়ে সে আমাকে বলল, তুমি জানাে, কোথায় দাড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছ? এটা আমাদের দেশ । তুমি তাে বাঙালি। করাচির অদূরে অবস্থিত ‘মালির কান্টনমেন্টে’ আমাকে বহুবার যেতে হয়েছে। কারণ সেখানে ছিল অর্ডন্যান্স সেন্টার ও স্কুল। একজন অর্ডন্যান্স অফিসার হিসেবে অনেকবার ট্রেনিং কোর্সে আমাকে সেখানে যেতে হয়। একবার অফিসার্স মেসে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ টুর্নামেন্টে আমার অংশগ্রহণের সুযােগ হয়েছিল। আমার পার্টনার ছিলেন একজন বাঙালি ডাক্তার। তিনি ছিলেন অর্ডন্যান্স সেন্টার ও স্কুলের আরএমও বা রেজিমেন্টাল মেডিকেল অফিসার মেজর মােহাম্মদ হােসেন। আমরা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। কিন্তু খেলায় চ্যাম্পিয়ন হলেও আমরা চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি বা পুরস্কার পাইনি। বলা হলাে, যারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যােগ্যতা রাখে না। কাজেই টুর্নামেন্টটি পুনরায় অনুষ্ঠিত হবে। আমরা পুনরায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করিনি। এ রকম অসংখ্য ঘটনা আমাকে রাগে-ক্ষোভে জর্জরিত করত।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বসে নিজেকে প্রশ্ন করতাম, এটা কোন পাকিস্তান এবং আমার দেশ ‘বাংলাদেশ’ কোন পাকিস্তান? পাকিস্তানের দুই অংশে এত বৈষম্য কেন? দুই অংশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থায় এত পার্থক্য কেন? দুই অংশের এক অংশ অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কেন্দ্রীভূত কেন? পূর্ব পাকিস্তানের লােকসংখ্যা বেশি হলেও পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে কেন ইত্যাদি নানা প্রশ্ন।
সময় যত পার হতে লাগল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর আমার আস্থা বাড়তে লাগল। তার সঙ্গে কোনাে আলােচনা না হলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ চান। ছাত্রজীবনে পল্টন ময়দানে এবং দুএকবার আরমানিটোলা মাঠে মুজিব ভাইয়ের জ্বালাময়ী বক্তৃতার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ত। বাঙালি জাতির অধিকারের প্রশ্নে তার যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য আমার মনে চিরদিনের জন্য দাগ কেটে রেখেছিল। আমার বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে একমাত্র মুজিব ভাই-ই পারবেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। তিনি বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে আমার চিন্তায় দৃশ্যমান হয়েছিলেন। অন্যান্য বাঙালি নেতাকে মনে হতাে আপসকামী।
১৯৬২ সালে আমি সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপাে রাওয়ালপিন্ডিতে বদলী হয়ে আসি। তখন আমি ক্যাপ্টেন। আইয়ুব খানের প্রথম জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তখন আইয়ুব হলে বসত। আইয়ুব হল আর আমার মেস (অর্ডন্যান্স অফিসার্স মেস) কাছাকাছি ছিল। আমি প্রায়ই অধিবেশন দেখতে যেতাম। জাতীয় পরিষদ গঠিত হয়েছিল বিডি (বেসিক ডেমোক্রামটস) বা মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচিত ৮০ জন এমএনএ দ্বারা। এর মধ্যে ৪০ জন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ৪০ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সংখ্যাসাম্য বা প্যারিটির কল্যাণে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘিষ্ঠতা সমসংখ্যা প্রতিনিধিতে পরিণত হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৭ এপ্রিল ১৯৬২ তারিখে নির্দলীয় ভিত্তিতে। নির্বাচনের পর আইয়ুব খান দল গঠন করেন। একটি কনভেনশনের মাধ্যমে মুসলিম লীগকে বিভক্ত করেছিলেন বলে আইয়ুব খানের দল কনভেনশন মুসলিম লীগ নামে পরিচিত হয়। মুসলিম লীগের অপর অংশ মনে করেছিল, কাউন্সিল অধিবেশন ছাড়া দলীয় কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা নেতৃত্ব পরিবর্তন গণতন্ত্রসম্মত নয়। তাই তারা কনভেনশনের বিপরীতে কাউন্সিল অধিবেশন ডেকে মিঞা মােমতাজ খান দৌলতানাকে প্রধান করে কাউন্সিল মুসলিম লীগ গঠন করে। জাতীয় পরিষদে কনভেনশন মুসলিম লীগ সরকারি দলে পরিণত হয়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য ছােট দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা বিরােধী দলে অবস্থান গ্রহণ করে। আইয়ুব খানের বড় ভাই সরদার বাহাদুর খান কাউন্সিল মুসলিম লীগে যােগদান করেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত অন্যান্য এমএনএ প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, সর্বজনীন ভােটাধিকার, সামরিক বাহিনীসহ কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে বাঙালিদের কোটা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রভাষা ইত্যাদি প্রশ্নে কিছুটা মতৈক্য প্রদর্শন করলেও পদের লােভে বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল মােনেম খান, খান এ সবুর, মৌলভী তমিজউদ্দীন খান প্রমুখ আইয়ুব খানের দলে যােগ দেন। মৌলভী তমিজউদ্দীন খান জাতীয় পরিষদের স্পিকারের পদ গ্রহণ করেন এবং অন্যরা আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম দিকে বাঙালি এমএনএদের ঐক্য আমাদের অনেককে উৎসাহিত করে। আমরা আশা করেছিলাম, বাঙালি এমএনএদের সঙ্গে আইয়ুব খানের মুখোমুখি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে এবং বাঙালিদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার একটা সুরাহা হবে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি গােটা বাঙালি জাতি, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিদের সব আশা-ভরসা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় । আওয়ামী লীগের সদস্যরা বাঙালিদের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে কোনাে আপস করেননি। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ তারা ঘটাতে পারেননি। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে নেতা তখনকার জাতীয় পরিষদে ছিলেন না। যারা ছিলেন, তারা তাদের মেধা ও যােগ্যতা দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে একটি ইস্যু হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইস্যু সৃষ্টির জন্য বাঙালি জাতিকে ১৯৬৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল, যখন বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন এবং বাঙালি জাতি স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল। তখনকার জাতীয় পরিষদের দুজন বেলুচ সদস্য খায়ের বক্স মারী ও আতাউল্লাহ খান মঙ্গল তাঁদের বেলুচ জাতীয়তাবাদী চেতনাসমৃদ্ধ জ্বালাময়ী বক্তব্য দ্বারা আমাকে দারুণভাবে আলােড়িত করেন।
Ref: সত্য মামলা আগরতলা কর্নেল শওকত আলী, pp 51-69