You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.02.23 | ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর দ্ব্যর্থহীন ঘােষণা | দৈনিক বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর দ্ব্যর্থহীন ঘােষণা

লাহাের: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ঘােষণা করেন যে, ‘আরব ভাইদের’ হৃভূমি পুনরুদ্ধার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ সর্বতােভাবে সমর্থন করবে। আরবদের সমর্থনের এই দ্ব্যর্থহীন ঘােষণার পর সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বিপুল করতালির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন করেন। ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ পাকিস্তান বেতার সরাসরি সম্মেলন কক্ষ থেকে প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন আল্লাহর রহমতে আমরা সাফল্য অর্জন করার মতাে অবস্থায় পৌঁছেছি। বঙ্গবন্ধু মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে ঘােষণা করেন যে ইসরাইলকে অবৈধভাবে দখলকৃত আরব ভূমি অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, অধিকৃত আরব ভূমি থেকে সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অবিলম্বে প্যালেস্টাইনিদের ন্যায্য অধিকার প্রদানের জন্য তিনি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে বলেন যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রদানের ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সুচনা হলাে। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের পথ প্রশস্ত করেছি। এই ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরােপ করেন এবং সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দকে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় খোঁজার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বের শান্তি ও প্রগতির শক্তিসমূহ এবং উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ও নির্যাতিত জনগণের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এইখানে সমবেত ভাইদের সাথে একাত্মতার প্রকাশ আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে তাদের সমর্থন ঘােষণার জন্য এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারায় আমরা খুবই আনন্দিত। সেক্রেটারি জেঃ সহ অন্যান্য যারা আমাদের ভাইদের পাশে আজ আমাদের উপস্থিতির আয়ােজন করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন, আমি তাদের সকলের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যে মহামান্য নেতৃবৃন্দ আজ আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন, আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আর ধন্যবাদ জানাই আমাদের মেজবান ও সম্মেলনের চেয়ারম্যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে। আমি বলতে চাই সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় উন্মােচিত হয়েছে। আমরা এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুগপৎ অবদান রাখার পথ উন্মুক্ত করছি। আজকের মতাে মানব জাতি ইতােপূর্বে কখনও এত বড় কঠোর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। এক দিকে ভয়াবহ বিপদ আর এক দিকে জীবনের মনােন্নয়নের সৃজনশীল বিপুল সম্ভাবনা। বিশ্বের মানুষ এমন পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় নাই। মানুষ যখন বস্তুগত দিক থেকে বৃহত্তর শক্তি অর্জন করেছে, যা সে কখনও পারে নাই। সে পৃথিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা যুদ্ধের জন্য শক্তি অপব্যবহার করে দেখেছি। জনগণকে নিপীড়ন করতে দেখেছি। আমরা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অস্বীকার করতে দেখেছি। অকথ্য দুর্ভোগের মাঝে তাদের ঠেলে দিতেও দেখেছি। আর এই সব অবর্ণনীয় যাতনার চূড়ান্ত নিদের্শন হয়ে রয়েছেন আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা। আর এই জন্যই অতীতের তুলনায় আজ এই শক্তিকে প্রজ্ঞার সাথে কাজে লাগানাের প্রয়ােজন বেশি। ধ্বংস নয় সৃষ্টি, যুদ্ধ নয় শান্তি, দুর্ভোগ নয়, মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি মহানবী প্রচারিত মানব প্রেম ও মর্যাদা শাশ্বত মূল্যবােধ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারি, তা থেকে বর্তমান কালের সমস্যা সমাধানে মুসলিম জনসাধারণ সুস্পষ্ট অবদান রাখতে হবে। এইসব মূল্যবোেধ উদ্দীপিত হয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আমরা একটি নতুন আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি। এই সম্মেলন শুধুমাত্র আরব ভাইদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থনে আমাদের ঐক্য সংহতি করার জন্য নয় বরং জোটনিরেপেক্ষ দেশগুলাের সাথে বিশ্বব্যাপী শান্তি ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সাথে আমাদের একাত্মতা ঘােষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও সকল প্রকার শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মতার উপর জোর দিতে হবে। আমাদের ভাইদের উপর যে নিদারুণ অবিচার হয়েছে অবশ্যই তার অবসান ঘটাতে হবে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরব ভূখণ্ড অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে জেরুজালেমের উপর।
ঢাকায় বিদায় অভ্যর্থনা: ইতােপূর্বে ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে আন্তরিক বিদায় জ্ঞাপন করা হয়। লাহাের যাত্রার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানের স্বীকৃতির মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে। সত্যের জয় সব সময়ই হয় এবং এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই সফরে তার সঙ্গে গিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামাল হােসেন, তথ্য ও বেতার মন্ত্রী জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব জনাব তােফায়েল আহমেদ এবং আরও ১৮ জন সদস্য। সর্বমােট ১২ জন হলেন প্রতিনিধি। একই বিমানে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে শুভেচ্ছা মিশনের প্রতিনিধিরা ঢাকা ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটিকে লাহাের নিয়ে যাওয়ার জন্য আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদীন তার নিজস্ব একটি বিমান পাঠিয়েছিলেন। বিমান বন্দরে তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান এবং মন্ত্রী সভার সদস্যবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের দূতেরা এবং সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর নেতৃবৃন্দ।৭৮

রেফারেন্স: ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত