শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
মিস ফাতেমা জিন্নাহকে ভোটদানের জন্য কৃষক-জনতার প্রতি মাওলানা ভাসানীর আবেদন | পূর্ব-পাকিস্তান কৃষক – সমিতির প্রচার পত্র | নভেম্বর,১৯৬৪ |
কৃষক-জনতার প্রতি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহবান
ভাইসব,
নির্বাচনের প্রথম পর্ব শেষ হইয়া গিয়াছে । আপনারা নির্বাচনী সংস্থার সভ্য তথা ইউনিয়ন কাউন্সিলের সভা নির্বাচন করিয়াই আপনাদের সরাসরি ভোটের অ্ধিকার পরিসমাপ্ত করিয়াছেন। এখন আবার নির্বাচনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ আগামী ১৯৬৫ সনের ২রা জানুয়ারি ধার্য্য হইয়াছে। একমাত্র আপনাদের নবনির্বাচিত সভ্যদের ভোটেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইবেন। এই প্রেসিডেন্ট হইলেন এমন এক ব্যাক্তি যাহার হাতে থাকিবে পাকিস্তানের প্রশাসনিক যন্ত্র পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা। তাহারই উপর নির্ভর করিবে এদেশের সুখ , শান্তি ও সমৃদ্ধি। আপনাদের ভাগ্য নির্ধারনের কলাকৌশল তিনিই উদ্ভাবন করিবেন। এই প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দিতা করিতেছেন জনাব আইয়ুব খান ও মিস ফাতেমা জিন্নাহ। একজন অগণতান্ত্রিক একনায়কত্বের ও শোষন-উৎপীড়নের উলঙ্গ প্রতিভূ আরেকজন গণতন্ত্র ও প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্টারি সরকারে বিশ্বাসী। পূর্ণ গণতন্ত্র ব্যবস্থায় আপনাদের ভোটাধিকারসহ সমস্ত মৌলিক অধিকারেরই স্বীকৃতি থাকিবে। আপনাদের দাবি আদায়ের পথকেও সুগম ও সহজ করিবে। আপনারা প্রতিমূহুর্তেই অনুভব করিতেছেন আইয়ুব সরকারের শাসনের স্বাদই এই সরকারের পুলিশের পুলিশের গুলিতে সম্প্রতি কুমিল্লার বাতাকান্দি গ্রামে নিরীহ কৃষান/কৃষাণীর জীবন দিতে হইয়াছে এই প্রকার কত মর্মান্তিক ঘটনাই না রহিয়াছে।
কাজেই আপনাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনেই আপনাদিগকে এখন এমন সচেতন ও সক্রিয় হইয়া উঠিতে হইবে যাহাতে আপনাদের কাছে ওয়াদাবদ্ধ আপনাদেরই নির্বাচিত সভ্যরা প্রেসিডেন্ট পদে মিস জিন্নাহকে ভোট দিয়া তাহাদের ওয়াদা পালন করেন। একদিকে যেমন মিস জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য আপনাদিগকে অনলস প্রচেষ্টা চালাইতে হইবে অপরদিকে তেমনই আপনাদের দাবী আদায়ের আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য কৃষক শক্তিসালী করিয়া ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়িয়া তুলিতে হইবে। এই নির্বাচনে আপনাদের ঐক্যে ফাটল ধরাইতে প্রয়াসী হইয়াছে। যেখানে যেখানে নাই সেইখানে কৃষক সমিতি গঠন করিয়া দুর্বার কৃষক ঐক্য গড়িয়া তুলিতে হইবে। এই নির্বাচনে আপনাদের ঐক্যর শক্তিতে ভয় পাইয়াই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নানাভাবে আতংক সৃষ্টি করিয়া এই ঐক্যে ফাটল ধরাইতে প্রয়াসী হইয়াছে। যেখানে যেখানে কৃষক সমিতি কৃষক সমিতি আছে সেইগুলিকে শক্তিসালী করিয়া এবং যেখানে যেখানে নাই সেইখানে কৃষক সমিতি গঠন করিয়া দুর্বার কৃষক ঐক্য গড়িয়াই এই শয়তানের শয়তানীর সম্যক ও সঠিক উত্তর দিতে হইবে। ঐক্যবদ্ধ সংগঠনই আপনাদের শক্তি।
আপনাদের দাবীর আন্দোলনকে জনপ্রিয় ও শক্তিসালী করিয়া তোলার জন্য এখন হইতেই এখন হইতেই প্রতি ইউনিয়নে , থানায় ও জিলায় মিছিল ও সভা প্রভৃতি গড়িয়া তুলুন এবং ঐ সমস্তে আপনাদের নির্বাচিত সভ্যকেও অংশীদার করুন। ছাত্র মেহনতি জনতাসহ রাজনৈতিক সংযুক্ত বিরোধীদলের সক্রিয় সহযোগিতায় এই আন্দোলনকে দুর্বার করিয়া তোলার জন্য কৃষক কর্মী ও দরদীদের সর্বোতভাবে চেষ্টা করিতে হইবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখে ও সময়ে মিছিল করিয়া আপনাদের নির্বাচিত সভ্যকে ভোটকেন্দ্রে নিয়া মিস জিন্নাহকে ভোট দেওয়ানও আপনাদের অবশ্য করণীয় কাজ। আমি বিশ্বাস করি তাহাঁরা দেশ ও সমাজের কাজের জন্য তাহাদের এই গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করিবেন। সংযুক্ত বিরোধী দলের গৃহীত কর্মসূচীতে কৃষকের মৌলিক দাবীর স্বীকৃতি আছে বলিয়াই কৃষক সমাজকে সংযুক্ত বিরোধীদলের সহিত সক্রিয়ভাবে সহযোগীতা করিতেই হইবে। এইরুপ মিথ্যা জনরব উঠিয়াছে যে মিস জিন্নাহ এই নির্বাচনে সাফল্য লাভ করিলে মৌলিক গণতন্ত্র সংস্থা ভাঙ্গিয়া দেবে এবং পুনঃনির্বাচনের ব্যবস্থা করিবেন। এই মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করিবেন। মাদারে মিল্লাত ঘোষনা করিয়াছেন যে, মৌকিক গণতন্ত্র সংস্থাকে আরও ক্ষ্মতা দিয়া শক্তিসালী করিবেন।
পথ-ঘাটে-বাজারে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলুন
১) পূর্ণ গণতন্ত্র ও সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটসহ সর্বপ্রকার মৌলিক অধিকার কায়েম কর।
২) সমস্ত প্রকার নিবর্তনমূলক আইন বাতিল, সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি, গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বাতিল ও বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি প্রত্যার্পন করিতে হইবে।
৩)সার্টিফিকেট প্রথাসহ নতুন রাজস্ব আদায়ের বিল বাতিল করুন।
৪) ৯৩ কোটি টাকা ঋণ হইতে কৃষককে রেহাই দিতে হইবে।
৫) ভূল রেন্ট রোল সংশোধন ও এজমালি খতিয়ান পরিনত করিতে হইবে।
৬) বর্ধিত খাজনা ও ট্যাক্স কমাইতে হইবে এবং নগর শুল্ক বাতিল করিতে হইবে, খাজনার সুদ নেওয়া চলিবে না।
৭) উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্তে উপর হারাহারি খাজনা ও কর ধার্যেও প্রথা চালু করিতে হইবে। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা ধার্য চলিবে না। ১০০ বিঘার উপর কাহাকেও জমি রাখিতে দেওয়া চলিবে না।
৮) অল্প জমির মালিক ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সরকারী খাস জমি ও উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করিতে হইবে।
৯) মোহাজীরদের নামে যে ট্যাক্স আদায় হইতেছে তাহা দিয়া অচিরে তাহাদের পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা হইবে।
১০) হাট-বাজারের ও জলার ইজারা প্রথা বাতিল করিয়া সরাসরি খাজনা আদায়ের ব্যাবস্থা করা হউক।
১১) পাটের নিম্ন দর চল্লিশ টাকা, আখের নিম্ন দর ৪ টাকা ধার্য করিয়া কৃষকের অন্যান্য অর্থকরী ফসলের ন্যায্যমূল্য বাধিয়া দেওয়া হউক।
১২) শিক্ষার ব্যায়ভার কমান হউক, শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দেওয়া হউক।
১৩) ক্রুগ-মিশনের সুপারিশ মোতাবেক বন্যা নিয়ন্ত্রন করা হউক।
১৪) বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য শিল্প বিস্তারের ব্যাবস্থাসহ দিনমজুরদের পল্লী উন্নয়নের কাজে নিযুক্ত করিয়া দৈনিক ৩ টাকা হইতে ৩ টাকা আট আনা দেওয়া হউক, কৃষি সমস্যার সমাধান করিয়া ফসল উৎপাদনে কৃষককে সাহায্য ও সক্রিয়ভাবে উৎসাহ দিতে হইবে।
১৫) নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কমাইতে হইবে।
১৬) সংখ্যালঘুদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের অধিকার দিতে হইবে।
১৭) সমস্ত প্রকার পুলিশী জুলুম বন্ধ করিতে হইবে।
১৮) পল্লী উন্নয়নের নামে বিনা ক্ষতিপূরণে কৃষকের জমি কাটা বন্ধ করিতে হইবে। সমস্ত রাষ্ট্রের সহিত সম্মানজন শর্তে বন্ধুত্ব ও ব্যাবসা করিতে হইবে।
১৯) সাম্প্রদায়িকতার মূলোচ্ছেদ করিতে হইবে।
২০) ধ্বংসের মুখ হইতে কুটির শিল্পকে রক্ষা করিতে হইবে।