বিলেতে বাংলার যুদ্ধ একজন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ মার্চ ১৯৮৯
মজনূ-নুল-হক
নর্দান লাইন, কালিয়ারস উড – শব্দগুলি মনে মনে আওড়ালাম পুনরায়। নর্দান লাইনের পাতাল রেলের আমি একজন যাত্রী। গন্তব্য কলিয়ারস উড স্টেশন। পাতাল রেল বালহাম স্টেশন ছাড়ল। জার্নি প্লানার লিফলেটে দেখে নিলাম মাঝে আর দুটি মাত্র স্টেশন। মনে হয় আর পাঁচ ছয় মিনিট লাগবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে। ঘড়ি দেখলাম। বিকাল পাঁচটা বাজতে এখনও বারো মিনিট। কখা আছে পাঁচটায় আমাকে স্টেশনে পৌছে ফোন করতে হবে ব্যারিস্টার শামসুদ্দিন চৌধুরীকে, তখন উনি এসে উনার বাসায় নিয়ে যাবেন।
নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে পড়লাম গাড়ী থেকে। স্কেলেটর দিয়ে উপরে উঠলাম, তারপর সিড়ি পেরিয়ে বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে। রাস্তার ওপারেই ফোন বুথ কয়েন ও ফোনকার্ড উভয় প্রকার ফোনের ব্যবস্থা।
রাস্তা পেরিয়ে ফোন বুথে ঢুকলাম, ফোন কার্ড ঢুকিয়ে ডায়াল করলাম। কিন্তু ওপার থেকে সাড়া নেই। বাইরে বেরিয়ে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভাবলাম কি করি। ইচ্ছে ছিল হেঁটেই জনাব চৌধুরীর বাসায় পৌছাব। তাই ফোনে উনার বাসায় কিভাবে পৌঁছাতে হবে জানতে চেয়েছিলাম কয়েকদিন আগে। কিন্তু উনার এক কথা – “হেঁটে আসার দরকার নেই – বাড়িতে ফোন করলেই আমি গাড়ী করে নিয়ে আসব।”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। পাঁচটা বেজে পনের, পুনরায় ফোন করলাম। নো রিপ্লাই। ফিরে যাব কিনা ভাবলাম।
এদিকে লোকজনের তেমন ভীড় নেই, শহরতলীর অনেকটা। ‘এ টু জেড’ বইটি বের করলাম, লন্ডন শহরের রাস্তাঘাটের ম্যাপ বই। আর বইটি বের করে করলেই আমার “স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙ্গালীর লেখক আবদুল মতিনের কথা মনে পড়ে। তারই উপদেশ মতন বইটি কেনা। লন্ডনে ঠিকানা সন্ধানের সহায়ক। আজকে শামসুদ্দিন চৌধুরীর সংগে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারটাও তারই সৌজন্যে।
জনাব চৌধুরীর বাড়ীর ঠিকানা ছয় নম্বর রাসকিন ওয়ে। ম্যাপ দেখে জায়গাটা বের করলাম। কিন্তু দিক নির্ণয় করতে পারছিলাম না। কোন দিকে রওনা দিব। সামনে না পিছনে? কাউকে একটু জিজ্ঞেস করে নিই।
এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি আমারই মত এক কালো মানুষ ফোন বুথ থেকে দ্রুত হেঁটে গাড়ীতে উঠতে যাচ্ছেন। বয়সে তরুণ – বোধহয় ভারতীয় কিংবা সিংহলীজ। ” এক্সকিউজ মি” – বিলাতে এই শব্দগুলির আশ্রয় নিয়ে বললাম – “আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।”
তা ভদ্রলোক সাহায্য করলেন। তারই নির্দেশিত পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম দ্রুত গতিতে।
কিছুদূর এগুই আর ম্যাপ দেখে আশে পাশের রাস্তার নামগুলি মিলাই ঠিক পথে চলছি কিনা। গন্তব্যস্থলের অদূরে অর্ধচন্দ্রাকার রাস্তার নির্দেশনা ম্যাপে। মনে হয় এখনও ঠিক পথে চলছি।
আকাশে এখনও দিনের আলো, তবে অন্ধকার নামতে খুব একটা দেরী আছে বলে মনে হয় না।
ঘড়ির কাঁটা ছয়টা ছুঁইছুঁই করছে, পাশ দিয়ে এক জোড়া সাহেব মেম জগিং করতে করতে চলে গেল।
আরও কিছু দূর এগুতে নজরে এল রাসকিন ওয়ে গলির নাম ফলক। উদ্বেগ অনেকটা কমে গেল। এখন শুধু নির্দিষ্ট বাড়ীর নাম্বার আর বাড়ীর মালিককে পেলেই হয়।
একসময় নির্দিষ্ট বাড়ীর দরজায় এগিয়ে বেল টিপলাম। অল্পক্ষণ পরে দরজা খুলে আমারই মতন এক কালো মানুষকে দেখে নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম – “শামসুদ্দীন চৌধুরী? “
– “জ্বী হ্যাঁ। “
– নিজের পরিচয় দিলাম।
– “আরে আসুন, আসুন, ” উনি সাদরে আহবান জানালেন।
মনে হল উনি এতক্ষণ বাড়ীতে ছিলেন না। বাড়ীতে আর কেউ আছে বলেও মনে হয় না।
– “একদম একা মনে হচ্ছে?” সোফায় বসতে জিজ্ঞেস করলাম।
– “হ্যাঁ একাই বলতে পারেন। গিন্নী বাংলাদেশে। অবশ্য এখানে ছোট মেয়ে আছে। তবে এই মুহূর্তে সে পাশের বাড়ীতে বেড়াতে গেছে। “
টিভিতে কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। শব্দটি কমিয়ে দিয়ে শামসুদ্দিন বললেন- “চা না কফি?”
– “আবার ঝামেলা” – আমি মৃদু আপত্তি করি।
– “ঝামেলা কি – আমি নিজেও তো খাব।”
কফি বানাতে পাশের রান্নাঘরে ঢুকলেন শামসুদ্দিন। আমি ভাবলাম এই সেই শামসুদ্দিন।
যিনি একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবীতে বিলেতের শীতকে অগ্রাহ্য করে তিনদিন অনশন পালন করেছিলেন। ছাত্র ছিলেন তখন তিনি। আইন পড়তেন। – “এ দেশে ১৯৬৮ সন হতেই আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা চেতনা কাজ করে যে আজ হোক কাল হোক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমাদেরকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। তখন এখানে হাইবারীহিলে একটি পাকিস্তান হাউস প্রতিষ্ঠা করা হয়। অনেকের জনাব মিনহাজউদ্দিন এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। মওদুদ আহমেদ, আলমগীর কবির এরাও তখন মিনহাজউদ্দিনের সঙ্গে কাজ করে গেছেন এই চেতনায়। দেশে উনসত্তরের আন্দোলনের পর হতেই আমরা বাঙ্গালীরা বিলাতে বসে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলাম এখন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে হবে। সত্তরের নির্বাচনের পর বাংগালী ও বাংগালী ছাত্রদের মধ্যে বিভেদটা ক্রমেই জোরালো হল। “অল পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশন ” হতে বাংগালী ছাত্ররা বেরিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করলো “বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি” বা বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তেইশে মার্চের আগে পর্যন্ত আমাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল প্রচারণা, বিশেষ করে সংসদ সদস্যদেরকে বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত করা। তাদের সমর্থন লাভের জন্য আমরা চেষ্টা করতাম। আমরা পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করতাম। উদ্দেশ্য ছিল এদের পত্র পত্রিকায় আমাদের দাবী দাওয়া সম্মন্ধে লেখা হোক, এদেশের জনগণ জানুক বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা। তখন এমপি’ দের মধ্যে এর সমর্থন খুবই কম ছিল।”
-“এইসব আন্দোলন কি একাত্তরের এপ্রিল বা মে মাসের দিকে? ” আমি নিশ্চিত হবার জন্য প্রশ্ন করি।
– না না মার্চের আর্মি ক্রাক ডাউন হবার আগেই। কেননা দেশের বিভিন্ন খবর থেকে আমরা তখন বুঝতে পারছিলাম মর্মান্তিক কিছু একটা হতে যাচ্ছে দেশে। তাই ঢাকায় ২৫ শে মার্চে গণহত্যা শুরু হবার পরপরই আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে সিদ্ধান্ত নিই আমরা এর প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করব। আমি এবং আফরোজ আফগান স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অনশন করতে রাজী হয়ে যাই। “
– “অনশন ধর্মঘট ২৬ শে মার্চ সকাল হতে শুরু করলেন?”
– হ্যাঁ। আমরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে অনশন আরম্ভ করি। বুঝতেই পারছেন জায়গাটা খুব সেনসিটিভ ছিল। সাংবাদিক, বিদেশী লোকজন, এম, পি এদের দৃষ্টিতে পড়লাম। তারা জানতে চাইলেন কেন আমরা অনশন করছি। – আমরা বিভিন্ন প্রচার পত্র দিতাম, বলতাম বাংলাদেশের উপর দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের কথা।
– হ্যাংগ ইয়াহিয়া, রিকগনাইজ বাংলাদেশ, স্টপ জেনোসাইড ইত্যাদি। আমাদের সেই অনশন বেশ সাড়া জাগাতে পেরেছিল সে সময়। আজকে এতদিন পর যদি আমাকে মূল্যায়ন করতে বলেন তাহলে আমি বলব ইট ওয়াজ এ গুড বিগিনিং। আমাদের দু’জনার আশে পাশে প্রায় পঞ্চাশ হতে শ’ খানেক বাংগালী সব সময় পর্যায়ক্রমে সমবেত থাকত। রাত দিন বলে আলাদা কিছু ছিল না। যদিও তখন প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল। এ দেশের পুলিশের কাছ হতেও আমরা বেশ সহযোগিতা পেয়েছি। পুলিশ আমাদের সব সময় পাহাড়া দিত যাতে পাকিস্তানীরা আমাদেরকে আক্রমণ করতে না পারে। সে সময় বাংগালীরা অনেকটা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না তারা কি করবে – পাকিস্তান সমর্থন করবে না বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের অনশন অনেকটা দিক নির্দেশনার কাজ করেছিল। সেই কয়দিন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট বাংগালীদের পূণ্য স্থানে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছিল।”
– একাত্তরের আঠাশে মার্চ আপনারা অনশন ভাংগেন?
– হ্যাঁ। পুলিশের ডাক্তার আমাদের রোজ পরীক্ষা করতেন। তৃতীয় দিনে ডাক্তার বললেন তোমাদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে, পালস্ রেট কমে গেছে কাজেই তোমারা যদি অনশন না ভাংগ তাহলে তোমাদেরকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাব। এ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছাত্ররা আলোচনা শুরু করল এখন কি করা যায়। কেননা আমাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত ছিল যে যতদিন হানাদার পাকিস্তানীরা বাংলাদেশ না ছেড়ে যায় ততদিন আমরা অনশন করে যাব। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের উপর বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে – এবং প্রতিদিনই এম পি’ দের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন বাড়ছিল। যা হোক অবশেষে এম পি পিটার শোর অনুরোধক্রমে আমরা ২৮ তারিখের বিকাল তিনটা চারটার দিকে অনশন ভাঙি। ইতিমধ্যে টেলিভিশনে, পত্র-পত্রিকায় আমাদের ছবিসহ সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল। কার্যকারিতার দিক দিয়ে আমাদের অনশন কর্মসূচী বেশ সফল হয়েছিল। “
আপনাদের মূল কর্মসূচী ছিল বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করা – এম, পি, সাংবাদিক, রাষ্ট্রসংঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন রাষ্ট্রকে জানিয়ে দেয়া পাকিস্তানীদের অত্যাচারের কথা এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করা – তাই তো? “
– হ্যাঁ। সেটা আমাদের মূল কর্মসূচী ছিল। এবং একই সংগে আমরা চিন্তা করতে লাগলাম শুধু বাংগালীদের মধ্যেই এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না – ইংরেজদেরকেও এর মধ্যে জড়াতে হবে। আকস্মিকভাবে একটা সুযোগ এসে গেল। পিস নিউজ পত্রিকার উদ্যোগে ইন্টারন্যাশনাল কনসেনস ইন এ্যাকশন, পিস প্লেস ইউনিয়ন, থার্ড ওয়ার্ল্ড রিভিয়্যু, বাংলাদেশ নিউজ লেটার, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি এবং আরও কয়েকটি সংস্থা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে এপ্রিল মাসে একটি সভা হয়। এই সভায় সিদ্ধান্ত অনুসারে পল কনেটকে প্রধান করে এবং ম্যারিয়েটাকে সাধারণ সম্পাদক করে “এ্যাকশন বাংলাদেশ ” নামে একটি সংস্থার জন্ম হয়।
এ্যাকশন বাংলাদেশ আমাদের স্বাধীনতায় যথেষ্ট অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছিল। একাত্তরে ২৮ এপ্রিল বিলেতে যখন পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয় তখন এই সংস্থা এক বিক্ষোভের আয়োজন করে – যার শ্লোগান ছিল – খেলা শুরু করো না – আগে যুদ্ধ থামাও।
১৩ ই মে দি টাইমস পত্রিকায় এই সংস্থা যে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে তা নিম্নরূপ –
এই মুহূর্তে যখন দেখানো যেতে পারে যে মানুষ অভ্যন্তরীণ সমস্যার চাইতে বেশী মূল্যবান।
উল্লেখ্য যে হাউজ অব কমনস – এ বিতর্কের দিন ছিল ১৪ ই মে।
৭ ই জুন এই সংস্থা অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতায় অপারেশন ওমেগা চালু করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণের কাছে খাদ্য ও চিকিৎসা সাহায্য সরাসরি পৌছে দেয়া।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল জুন মাসে দশটি বিক্ষোভ – এর অনুষ্ঠান করা – যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে যেন সাহায্য না দেয়া হয়।
পাকিস্তান এইড কনসরটিয়ামে সংশ্লিষ্ট দশটি দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে স্ব স্ব রাষ্ট্রের প্রধানকে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ পত্র দেয়া হয়। এই বিক্ষোভ – এর প্রধান শ্লোগান ছিল – পাকিস্তানে আর্থিক সাহায্য দেয়ার অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করা।
– আপনি যদি এ্যাকশন বাংলাদেশ – এর মধ্যমণি ম্যারিয়েটা সম্মন্ধে কিছু বলেন?
– ম্যারিয়েটা এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। তেইশ চব্বিশ বছরের এই মহিলা জীবিকার জন্য শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু এ্যাকশন বাংলাদেশের দায়িত্ব পাওয়ার পর এটা তার সার্বক্ষনিক কাজ হয়ে পড়ল। তার নিজের বাড়িতেই এই সংস্থার অফিস। রাত দিন তিনি কাজ করে গেছেন – নিজের দিকে দৃষ্টি দেবার কোন সময় তিনি পান নি। এতই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। এই সংস্থার কার্যক্রম আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। এই সংস্থার উদ্যোগে ১ লা আগস্ট ১৯৭১ – এ ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক বিশাল জনসভা আয়োজিত হয়।
– আপনি কি ম্যারিয়েটাকে কখনও জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিন কেন বাংগালীদের ন্যায্য দাবীকে নিজের দাবী বলে গ্রহণ করেছিলেন?
– হ্যাঁ, তার সঙ্গে আলাপের প্রথম দিনই। আমি বলেছিলাম আমরা বাংগালী – আমাদের নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের সমর্থনে কাজ করছি কিন্তু আপনার দর্শন কি? এর জবাবে ম্যারিয়েটা বলেছিলেন – মানুষকে যখন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন শুধু এক জাতি বা দেশ এর ব্যাপারে থাকে না – সমগ্র মানবজাতির প্রতিবাদ করা উচিত। তিনি আরো বলেছিলেন এত অল্প সংখ্যক ইংরেজরা এতে জড়িত কেন? শুধু ইংরেজ নয় সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরই উচিৎ এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা – এমন দর্শনে ম্যারিয়েটা বিশ্বাসী ছিলেন।
ট্রাফেলগার স্কোয়ারের ১ লা আগস্ট – এর সভা নানাদিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল৷ ইতিপূর্বে বিলেতে বাংগালীদের এর চেয়ে বড় জনসমাবেশ আর হয়নি। বিলেতের বিভিন্ন শহর হতে হাজার হাজার জনগণ এতে যোগ দেন৷ এই সভা পাঁচ ঘন্টা স্থায়ী হয় এবং সভা শেষে একটি শোভাযাত্রা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করে।
এই সভা থেকেই অপারেশন ওসেগার উদ্যোগে ওষুধপত্র ও অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী নিয়ে এ্যাকশন বাংলাদেশের সভাপতি পল কনেট, কনেটের স্ত্রী ও আরও একজন মহিলা গাড়ীতে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন৷
এই সভায় সেদিন যারা বক্তৃতা দেন তারা হলেন – বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, গাউস খান, বেগম লুলু বিলকিস বানু, অশোক সেন,মহীউদ্দীন আহম্মেদ, লর্ড ব্রকওয়ে, পিটার শোর, রেজ প্রেন্টিস, ব্রুনো ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউস, লর্ড গিফোর্ড এবং পল কনেট।
এই সভাতেই সর্বপ্রথম বাংগালী কূটনীতিবিদ মহীউদ্দীন আহমেদ পাকিস্তানের সরকারী চাকরী হতে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই সভাতেই বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের তিনটি নির্দেশের কথা ঘোষণা করেন – প্রথম, শীঘ্র লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশন অফিস স্থাপন করা হবে। দ্বিতীয় – পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ওয়েজের বিমানযোগে বাংলাদেশের নাগরিকরা যেন ভ্রমণ না করেন। তৃতীয় – পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারী হিসাবে পাকিস্তানের বিদেশে নিয়োজিত বাংগালীরা অবিলম্বে যেন পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
আমরা বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরণের তথ্য বিজ্ঞপ্তি ও পুস্তিকা প্রকাশ করি। আমরা ‘দি টাইমস, গার্ডিয়ান ” পত্রিকাগুলোতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করি, আমাদের পরিষদের পক্ষ থেকে কয়েকজন সদস্য বিদেশের বিভিন্ন দেশে সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করার চেষ্টা করে।
‘জনাব ওয়ালী আশরাফ বুডাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারপার্লিয়ামেন্টরী ইউনিয়ন ‘ এর সম্মেলনে জনমত গঠনের জন্য ছাত্রদের পক্ষ হতে ডাঃ এ এইচ প্রামানিক, নজরুল ইসলাম ও জেড মোহাম্মদ হোসেনকে পাঠান হয়। আমাদের উদ্যোগে স্ক্যান্ডিনেভিয়া, জার্মানী, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে বাংলাদেশের আন্দোলন সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া আমেরিকা ও আরব রাষ্ট্রগুলিতে বসবাস করা বাংগালীদের সংগে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। মোট কথা বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে তোলার ব্যাপারে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র প্রেরণের প্রতিবাদে আমাদের সদস্য আবদুল হাই খান ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী লন্ডনে আমেরিকার দূতাবাসের সামনে অনশন করেন। আমাদের বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহে বিবিসি ‘র সিরাজুর রহমান, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাংগালীর প্রণেতা আবদুল মতিন বিভিন্ন সময়ে সাহায্য করেছিলেন। তারা আমাদের ব্রেন ট্রাস্ট ছিলেন। বিশেষ করে আমরা যখন জানতে পারলাম ইউ এন আই কমিশন ফর রিফুজিস প্রিন্স সদরউদ্দিন আগা খান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তৃতা রাখতে যাচ্ছেন তখন বিভিন্ন তথ্যাদি দিয়ে মতিন ভাই ও সিরাজ ভাই যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। যার ফলে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারি। আমরা জনমত গড়ার জন্য ইংরেজী ও বাংলা পত্রিকা বের করতাম।
জানলা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিলাম। রাতের অন্ধকার নামতে শুরু করেছে, শীত তেমন এখনও পড়েনি। আমার আপত্তি সত্ত্বেও আর এক কাপ ধূমায়িত কফি বানিয়ে আনলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী। তার স্বাস্থ্যাজ্জল হাসি হাসি মুখে জীবনের ছবি দেখলাম। ব্যারিস্টার হয়েছেন। ইউনাইটেড কিংডম ইমিগ্রেশন সার্ভিস সংস্থার একজন পরামর্শক। অতি সম্প্রতি লন্ডন থেকে প্রকাশিত জনমত পত্রিকার অধিকাংশ অংশ কিনে নিয়েছেন।
ফেরার পথে গাড়িতে লিফট দিলেন। সন্ধা রাতের তরল অন্ধকার ছিঁড়ে গাড়ী এগিয়ে চলল। আমি ভাবতে লাগলাম দেশকে স্বাধীন করার জন্য শামসুদ্দিন চৌধুরীর মতন কত মানুষই না আত্মত্যাগ করেছেন। বিলেতের ভয়ংকর শীতও স্বাধীনতার উত্তাপ কেড়ে নিতে পারেনি।