You dont have javascript enabled! Please enable it! 1981.01.02 | সমগ্র জাতিই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২ জানুয়ারি ১৯৮১ - সংগ্রামের নোটবুক

সমগ্র জাতিই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২ জানুয়ারি ১৯৮১

—————————-
কর্ণেল (অবঃ) কিউ, এন জামান
কর্ণেল কিউ, এন জামান মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংবিধানিক কমিটির চেয়ারম্যান। জন্ম যশোরে ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ। কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষা গ্রহণ করেন। বি,এস,সি পাঠরত থাকাকালে ১৯৪৩ সালে কমিশন নিয়ে নৌ-বাহিনীতে যোগ দেন। তখন সারা ভারতে ভারত ছাড়ো, আন্দোলন ভাষণ জোরদার। তাদের প্রায়ই ব্রিটিশ অফিসারদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি মারামারি হতো। শেষ পর্যন্ত নৌবাহিনী ছেড়ে দিয়ে সেনা বাহিনীতে যোগ দেন। যখন ন্যাশনাল আর্মি গঠন করা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পিএসসি হওয়ার পর মতবিরোধের জন্য সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে শিল্প উন্নয়ন সংস্থায় পরিকল্পনা বিভাগে যোগ দেন। নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্লান্ট প্রভৃতির পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ১৯৬৫ সালে সাময়িকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে শিল্প উন্নয়ন সংস্থা ছেড়ে দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এবং ৭ নং সেক্টরের অধিনায়ক এর দায়িত্ব পালন করেন।
প্রশ্ন -মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা কি, তারা কেমন আছেন?
উত্তর -অবস্থা কত খারাপ তা আমি ঠিক উপলব্ধি করে উঠতে পারছি না। তবে বুঝতে পারছি মুক্তিযোদ্ধাদের দারুন সম্মানহানী হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ করলে, সোচ্চার হলেই তাদের উপর হুমকি হামলা আসছে। আমি একবার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম আপনারা যখন তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জেলে ঢুকিয়ে দেবেন না -আপনাদের কথা একবার শুনুন মন দিয়ে। কিন্তু সে অনুরোধ রক্ষা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি মনে করি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা হলে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।
প্রশ্ন -মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এ তালিকা কিসের ভিত্তিতে করা হচ্ছে?
উত্তর -মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের প্রচেষ্টা আগেও চালানো হয়েছিলো। কিন্তু ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কাদের অভিহিত করা হবে সে ব্যাপারে কোনো গ্রহণযোগ্য সর্বজনসম্মত সংজ্ঞা আসেনি একেকজন একেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরা যেভাবে তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করছি তা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আমরা সুনির্দিষ্ট ধরণ অনুযায়ী তালিকাভুক্তি করতে চাই। যেমন ধরুন কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া বাংলাদেশের সবাই এই যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। তারা আমাদের আশ্রয় না দিলে, পথ না দেখালে, খবর না দিলে আমাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বাড়তো। তাই বলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সাড়ে আট কোটি নাম ভুক্ত করা যায় না। সমগ্র জাতিই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যারা সহায়ক ছিল এবং যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের পৃথক পৃথক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি কিন্তু রণাঙ্গনের পাশেই অবস্থান করেছেন। অনেকে আবার মুজিবনগর থেকে যোগাযোগ রক্ষা এবং রসদ সরবরাহ করেছেন। তারাও মুক্তিযোদ্ধা। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে যে যেখানে যেভাবে অংশগ্রহণ করেন তাকে সেই পৃথক ক্যাটাগরি অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমরা এখন দেখছি যে এভাবে যদি তালিকা প্রণয়ন করা যায় তবেই সম্পূর্ণ তালিকা পাওয়া যেতে পারে। তা না হলে প্রত্যেক বাঙালির নামই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। যেমন কেউ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন -কেউ আবার দান করে মুক্তিযুদ্ধে নিজস্ব ভূমিকা পালন করেন। এ অবস্থায় সহায়ক এবং যোদ্ধার পৃথক তালিকা প্রণয়ন আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন -যারা যুদ্ধ করেন নি কিন্তু সহায়তা করেছেন তাদের আপনারা কীভাবে দেখছেন?
উত্তর -প্রশ্নটিই অনেকবার উঠেছে। একটি উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সমগ্র ব্রিটিশ জাতীয় জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সে সময় লোকের অভাব হওয়ায় ৭০ বছরের বুড়োও কারখানায় যোগ দিয়েছে উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার জন্য। অনেকে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এখন আমরা বলতে পারি -অন্যেরা মুক্তিযোদ্ধা নয়, তা নয়। আমি সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুত ছিলাম, তিনি ছিলেন না। নানা কারণে তিনি যেতে পারেননি। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাটাগরি না করতে পারলে সমরাঙ্গনে যে মুক্তিযোদ্ধা বুলেটের মুখোমুখি হয়েছেন তাকে আলাদাভাবে না তুলে ধরলে তার অবদানের হিসাব রাখা সম্ভব নয়। বৃটেনেও যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যায় তারা পায় একরকম মেডেল – আর সহায়করা পায় অন্যরকম মেডেল। সৈন্যরা পেয়েছেন সর্বোচ্চ ‘ভিক্টোরিয়া ক্রশ’, সহায়ক যারা ছিলেন তারা পেয়েছেন জর্জ ক্রশ। তালিকা প্রত্যেক দেশেই হয়, কিন্তু তা হয় ক্যাটাগরি অনুযায়ী।
প্রশ্ন -রাজাকারদের আপনারা কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
উত্তর -চট করে কোন জনগোষ্ঠী সম্পর্কে মন্তব্য করা মুশকিল। আমার সেক্টরে দুটো কোম্পানি রাজাকার ছিল। এসব ছেলেরা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে আত্মসমর্পণ শুরু করে। আমরা প্রথমে বন্দী করে রাখতাম। তারপর ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম তারা অনেকেই ইচ্ছে করে রাজাকার হয়নি, ওদের জোর করে রাজাকার হতে বাধ্য করা হয়। ওদের বাপ মা ওদের বলেছে যে যদি পারিস পালিয়ে যাস। ওরা প্রথম প্রথম খালি হাতে পাঁচজন দশজন করে চলে আসতো। তখন ওদের বললাম যে খালি হাতে আসলে চলবে না -অস্ত্র নিয়ে আসতে হবে। তারপর তারা অস্ত্র নিয়ে আসতে শুরু করল। পরবর্তীকালে ওরা পাকিস্তানি মেশিনগান পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। ওদের ট্রেনিং হয়ে যাওয়ার পর ওরা আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। সুতরাং সব রাজাকারকে একভাবে দেখা চলবে না। আরেকটা ঘটনার কথা আমি বলতে পারি। একদিন ভোরবেলা আমরা একটি সার্থক অভিযান শেষ করে যখন ফিরছি। একটি খাল যখন পার হচ্ছিলাম আমাদের কেউ চিৎকার করে বললো আপনারা এদিক দিয়ে যাবেন না। অনুনয় করে বললো আপনাদের ঘুরে যেতে হবে। কি ব্যাপার? গিয়ে দেখি ওখানে রাজাকাররা একশ গজের মধ্যে গুলি নিয়ে বসে আছে। ওরা বলল আপনারা একটু ঘুরে যান। কারণ ওরা যদি জানতে পারে আপনারা আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেছেন আর আমরা গুলি করিনি তাহলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। আমরা বললাম তোমাদের ধন্যবাদ -আমরা ঘুরেই যাচ্ছি। তাই সব রাজাকারদের এক দৃষ্টিতে দেখা চলবে না। রাজাকারদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ আছে। এটা বিশেষ করে বলতে পারবে স্থানীয় লোকেরা। যারা গণহত্যা, নির্যাতন করেছে, যারা সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছে তারা রাজাকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যারা বাধ্যতামূলকভাবে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল তারা রাজাকার নয়। আবার বলা যায় যারা রাজনীতি সচেতন হয়ে রাজাকারদের সংগঠিত করে তাদের অস্ত্র হাতে নিতে প্ররোচিত করেছিল তারাই রাজাকার। স্বাধীনতার পরপর চিকন আলীকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির মঞ্চে চিকন আলী বলে গেছে আমাকে যারা রাজাকার বানিয়েছে তারা এখন বহাল তবিয়তে আছে। চিকন আলী কে রাজাকার বানিয়ে ছিলেন যারা মূলতঃ তারাই রাজাকার।
প্রশ্ন -গোলাম আযম প্রমুখদের আপনারা কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
উত্তর -এটা একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। তবু বলা যায় বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিকরা গোলাম আযমকে যে দৃষ্টিতে দেখেন আমরাও সেই দৃষ্টিতে দেখি।
প্রশ্ন -কিছুদিন আগে জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা কিছু বক্তব্য বলেন সাংবাদিক সম্মেলনে। তার কয়েকদিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি পত্রিকায় দেখা যায়। এ ধরনের বিবৃতি লড়াই কতদিন চলবে?
উত্তর -প্রথম কথা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী আর যে রাজনীতি করছে, রাজনীতি করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দল নই। আমাদের পক্ষে বাঁধা দেয়া সম্ভব নয়। সরকার তাদের রাজনীতি করতে দিচ্ছে। তাদের বাঁধাও দিতে পারে সরকার। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও দেশ প্রেমিকদের গালিগালাজ করে যখন তারা বলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে জনগণের সমর্থন ছিল না, যখন বলে তারাই জনগণের পক্ষে লড়াই করেছে, যখন দাবি করে তারাই হচ্ছে জনগণের বন্ধু , আমরা দুষ্কৃতকারী তখন আমরা তা মেনে নিতে পারি না। দেশের কেউই এটা গ্রহণ করবে না। এতে পরোক্ষ ভাবে বলা যায়, ওদের যুক্তি অনুসারে দেশে একজন দেশদ্রোহী প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। কারণ বর্তমান প্রেসিডেন্টও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে আমরা রাজনীতিগতভাবে তাদের বাঁধা দেই নি। প্রতিবাদ করেছে এধরনের বক্তব্যের। রাজনীতি যেভাবে কোথায় তারা করুন। আমরা বাঁধা দেবো না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননাকর কোন বক্তব্য দিলে আমরা তো প্রতিবাদ করবোই। শুধু জামায়াতে ইসলাম বলে নয় -এ ধরনের মন্তব্য যে বলবে আমরা তাদেরই প্রতিবাদ করবো।
প্রশ্ন -মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য কি? আপনারা কি কোন সামাজিক সুবিধা দাবি করবেন?
উত্তর -আসলে তা নয়। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেড় থেকে দুই লাখ কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ২০ লাখ সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এধরনের অপ্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যখন সে সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরি পায় না তখন তারা অনেকসময় দুর্ব্যবহার করে।। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অসম্মান হয়ে যাচ্ছে। এতে জনগণের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকাশ্যে সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের আকাঙ্ক্ষা এই সম্মানটুকুর সঠিক তালিকা না থাকায় আমরা এ সম্মানটুকুও পাচ্ছিনা। যুগোস্লাভিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনেছি যে তারা যখন রাস্তা দিয়ে যান তখন ছেলে মেয়েরা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। কেউ এসে একটা ফুল, কেউ এসে একটা চকলেট দেয়, কেউবা হাত ছুঁয়ে দেয়। আমরাও সম্মানটুকু স্বীকৃতিটুকু বেশি চাই, পূনর্বাসনের চেয়ে। আমরা খেতে না পাই ছেঁড়া কাপড়ের থাকি আপত্তি নেই কিন্তু সম্মানে আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
প্রশ্ন -আপনাদের উপরে তিনটি দায়িত্ব পালনের ভার দেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে তালিকা প্রণয়নের কাজ আপনারা করছেন। সম্মেলন করার জন্য আপনারা কি কোন তারিখ বা সময় নির্দিষ্ট করেছেন?
উত্তর -তালিকা প্রনয়ন গঠনতন্ত্র এবং সম্মেলন অনুষ্ঠানের ভার দেওয়া হয়। এরমধ্যে তালিকা প্রণয়নের মূল দায়িত্ব সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তার সহযোগী। এক্ষেত্রে একটু বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। সংসদের পক্ষে এককভাবে এ কাজ করা সম্ভবও নয় উচিতও নয়। এ কাজটি করার জন্য জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় কমিটির যতদিনই লাগুক এ কাজটি সম্পন্ন করবে। সম্মেলনের ব্যাপারে প্রত্যেক ইউনিট কমান্ডার কে মাসের ১০/১১ তারিখে এক সভায় ডেকেছি। সেখানে প্রাথমিকভাবে গঠনতন্ত্র উপস্থাপন করা হবে এবং সভায় তাদের মতানুসারেই সম্মেলনের তারিখ ও সময় নির্ধারণ করা হবে। আমরা সংবিধান কমিটি থেকে মনে করছি গঠনতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া উচিত।
প্রশ্ন -আপনি একটি সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের দশ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাদের দেশপ্রেম ও শক্তিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়।
উত্তর -আমি মনে করি তালিকা প্রনয়নের পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সুষ্ঠু সংগঠন গড়ে তোলা সম্ভব। সে সংগঠনের কাউন্সিলই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি কাজ তারা করতে পারেন। কাউন্সিল ছাড়া এ সিদ্ধান্ত নেয়া যায়না। কারণ একেকজনের একেক রকম মত থাকে। তা কেবল কাউন্সিলেই গৃহীত হতে পারে। তবে আমি মনে করি তাদের দেশপ্রেম ও শক্তিকে জাতীয় পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কাজে লাগানো যায়।
প্রশ্ন -আপনাকে একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কিভাবে দেখেন?
উত্তর -২৬ মার্চের আগে আমার কোনো রাজনীতি ছিল না কিন্তু ২৬ শে মার্চের রাতের বর্বরতা দেখে ভাবতে থাকি কিভাবে প্রতিশোধ নেয়া যায়। তারপর ক্ষীণধ্বনি শুনলাম রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেই। পরে সেক্টর কমান্ডার থাকাকালে দেখেছি গ্রামের কৃষকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে এই আশা করে যে, আওয়ামী লীগ তাদের বলেছে পাকিস্থানীদের তাড়াতে পারলেই তাদের মুক্তি আসবে। তাই পাকিস্তানিদের তাড়াও। তারা বিশ্বাস করেছিল পাকিস্তানীদের তাড়াতে পারলেই তারা শোষণমুক্ত হতে পারবে। একটি শিক্ষিত ছেলেরা ভাবতো দেশটাকে কিভাবে করা যাবে। তারা বলতো এখন তো দেশটা আমাদের হবে। প্রয়োজন হলে পড়াশোনা না হয় কিছুকাল বন্ধই থাকবে। আমরা দু’বছর সময়সীমা বাড়িয়ে নিয়ে চাকরি করতে পারবো। কল-কারখানা যেগুলো ওরা ফেলে যাবে সেগুলো আমরাই চালাবো। রাস্তা, ব্রীজ আমরা যুদ্ধে প্রয়োজনে ভেঙেছি, সেই ব্রীজ, সেই রাস্তা আমরাই নির্মাণ করবো। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম বিদেশীদের হাত থেকে আমরা দেশীয় শোষকদের হাতে পড়লাম। এটার মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
প্রশ্ন -এই ট্রাজেডি দেখার পর আপনার মধ্যে কি কোনো অনুশোচনা আছে?
উত্তর -অনুশোচনা মোটেই নেই তা নয়। তা দুই কারণে। প্রথমতঃ আমরা আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ করে ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে যুদ্ধটা যদি আর একটু দীর্ঘস্থায়ী হতো তাহলে আমরা আরও সচেতন হতে পারতাম। যে রাজনৈতিক দল তখন নেতৃত্ব দিয়েছিল তার প্রকৃত চরিত্র আমাদের সামনে ধরা পড়লে আমরা ছেলেদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণও দিতে পারতাম। কিছু কিছু ধরা পড়েও ছিল। অনুশোচনা এজন্য যে আমরা বুঝতে পারতাম এটা ক্ষমতার লড়াই, জনগণের লড়াই নয়, জনগণ ব্যবহৃত হয়েছে। তখন এই কথাটা মনে হলেও করার কিছুই ছিল না। আমাদের সময় অত্যন্ত কম ছিল। আমার মনে হয় আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছিল। তা যদি নাও পেরে থাকে তবে ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তা বুঝতে পেরেছিল। সে জন্যে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে ফিরতে বলা হয়েছে।
প্রশ্ন -মুক্তিযুদ্ধ কি আপনার কাছে সম্পদ -না তা স্মৃতিতে পর্যবসিত?
উত্তর -স্মৃতি অনেক জিনিসের আছে। কিন্তু প্রত্যেক স্মৃতির পার্থক্য আছে। এ হচ্ছে জীবন প্রাণ রক্তের স্মৃতি। যখনই কোন দুর্ঘটনা ঘটে খারাপ কিছু হয় তখন যেসব ছেলেরা প্রাণ দিয়েছে তাদের কথা দারুণভাবে মনে হয়। তারা যে লড়াই করতে দেশ গড়তে জীবন দিতে এসেছিল -বাঙালী ছেলেরাও যে দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত এটা আমার কাছে সম্পদ, শুধু স্মৃতি নয়। সম্পদের জন্য যে এখন আমি একটা থেকে প্রেরণা পাই। ভাবতে পারি প্রয়োজন হলে দেশের ছেলেরাই আবারও জীবন দেবে রক্ত দেবে, দেশ গড়ার চেষ্টা চালাবে।
সাক্ষাৎকার -কাজী জাওয়াদ