You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | শেখ মুজিবের ২৫ লাখ টাকার মালামাল ফেরত | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৯ জুন ১৯৮১ - সংগ্রামের নোটবুক

শেখ মুজিবের ২৫ লাখ টাকার মালামাল ফেরত | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৯ জুন ১৯৮১

সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের ধানমন্ডিস্থ বাসভবন এবং বাসভবনে প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পত্তি ১২ জুন তার উত্তরাধিকারি শেখ হাসিনা ওয়াজেদের কাছে সরকারিভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর থেকে বাড়ীটি সরকারের হেফাজতে ছিলো। শেখ মুজিবের কোনো ওয়ারিশ বাসভবনটি চাইলে তাকে হস্তান্তর করা হবে, সরকার শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের আগেই ঘোষণা করেছিলেন। ১৬ মার্চ দিল্লীতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বসবাসরত মরহুমের জ্যেষ্ঠা কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে (৩৩) তার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের (হা) সভানেত্রী নির্বাচিত করার পর একথা শোনা যায় যে, হাসিনা দেশে ফিরে এসে তাঁর পিতার সম্পত্তি ফেরত চাইবেন। ১৭ মে শেখ হাসিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। প্রথমে তাকে টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাসভবন ফেরত দেয়া হয়। তার আসার নয়দিন পর থেকে ধানমন্ডির বাসভবনে অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা তৈরি শুরু হয় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে। কারণ বাসভবনটি পুলিশের হেফাজতে ছিলো। নিয়ম অনুযায়ী বাসভবনে প্রাপ্ত মালামালের পূর্ণ তালিকাসহ মালামাল উত্তরাধিকারীকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে এ কাজ শুরু হয়। তালিকা প্রণয়নের কাজ ২৯ জুন বন্ধ হয়ে যায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে। ৭ জুন আবার তালিকা প্রণয়নশুরু হয়ে পরদিন শেষ হয়। ৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম তালিকা তৈরী হয়েছিলো।
তালিকায় বাড়ীতে প্রাপ্ত কোনো বস্তুই বাদ পড়েনি। এমনকি সেফটিপিন পর্যন্ত ফুলস্কেপ কাগজের ৭১ পৃষ্ঠা দীর্ঘ তালিকায় স্থান পেয়েছে। ৯ জন সাক্ষীর সামনে ঢাকা জেলার এডিসি (উন্নয়ন)এ বি এম আবদুল লতিফ বাড়ী ও বাড়ীর মালামাল বুঝিয়ে দেন। সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন হাসিনার ফুফা এ টি এম সৈয়দ হোসেন, ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম, আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম সাজেদা চৌধুরী পিডাব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলী মনসুর আহমদ, পুলিশের এ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার আবদুস সাত্তার শাহ, নাজ জুয়েলার্সের ম্যানেজার মইজুদ্দিন আহমদ, মীরপুর ক্যান্টনমেন্টের এম এ বাশার, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত মহকুমা হাকিম মোঃ নূরুল আমীন ও পুলিশের এ্যাসিট্যান্ট কমিশনার তাহেরুল আহসান। প্রতি পৃষ্ঠায় শেখ হাসিনা সাক্ষর গ্রহণ করেন। কোথাও তিনি লেখেন ‘রিসিভড’ বা ‘বুঝে পেয়েছি’, কোথাও ‘রিসিভড এ্যাকসেপ্ট ফায়ার আর্মস’ অর্থাৎ ‘আগ্নেয়াস্ত্র বাদে বুঝে পেয়েছি’। আগ্নেয়াস্ত্রগুলো শেখ হাসিনাকে বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়া হয়। সেগুলো মোহাম্মদপুর থানার হেফাজতে রয়েছে। এছাড়া, নগদ টাকা স্বর্ণ ও রৌপ্য অলঙ্কার কাপড়-চোপড় ফার্নিচার তৈজসপত্র সহ সকল অস্থাবর সম্পত্তি শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তাকে বুঝিয়ে দেয়া মালামালের মধ্যে রয়েছে — ৫০৩ ভরি স্বর্ণালংকার, ৪০৫৪ ভরি রুপোর অলংকার ও জিনিসপত্র, নগদ বাংলাদেশী ১ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৯ টাকা, ভারতীয় প্রায় ৯ হাজার টাকা এবং বেশ কিছু পাউন্ড ও ডলার। নগদ টাকাসহ স্বর্ণালংকার ও রৌপ্য দ্রব্যাদির বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ২৫ লাখ টাকা। পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে কয়েকটি চলতি ও সেভিংস একাউন্ট। পরিবারের একজন সদস্যের নামেও ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একাউন্ট বই রয়েছে।
৭১ পৃষ্ঠা তালিকাতে বিভিন্ন শয়নকক্ষে ও স্টোর রুমে প্রাপ্ত অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে— পয়েন্ট থার্টি টু বোরের ২টি রিভলবার, ম্যাগাজিনসহ ১টি এসএলআর, ২টি ম্যাগাজিন ও ৭৮ রাউন্ড গুলিসহ দুটি এসএমজি, ১টি চাইনিজ রাইফেল, পয়েন্ট ২২ বোরের ১টি রাইফেল, ম্যাগাজিনসহ ১টি ব্রেটা গান, ২৩৭টি গুলিসহ ১টি জিও থ্রি রাইফেল, ৩টি মার্ক ফোর রাইফেল, ১টি মার্ক থ্রি রাইফেল, থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ দু’বাক্স গুলি। ১টি বাক্স খোলা, কিছু গুলি নেই। তাতে ২টি গ্রেনেড, ১টি এয়ার গান, ইত্যাদি।
অলংকারের মধ্যে হীরা, প্ল্যাটিনাম ইত্যাদি মহামূল্যবান প্রস্তর খচিত স্বর্ণ ও রৌপ্য অলংকার রয়েছে। অভিজ্ঞ জহুরী দিয়ে যাচাই করিয়ে শেখ হাসিনার হাতে অলংকারগুলো হস্তান্তর করা হয়। তালিকায় পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব। মালিকানায় যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বই পাওয়া গেছে তাতে কত টাকা জমা ছিল বা আছে তার উল্লেখ করা হয়নি সকল ক্ষেত্রে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের বাড়ীর অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রতিবেদন প্রকাশের পর। জাতীয় সংসদেও মরহুম শেখ মুজিবের অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ নিয়ে কথা ওঠে। সংসদে আওয়ামী লীগ সদস্য প্রফুল্ল কুমার শীল বলেন যে, স্বর্ণালঙ্কারসহ সকল স্থাবর-অস্থাবর পৈতৃক সম্পত্তি শেখ হাসিনা কোন অন্যায় করেননি। শেখ হাসিনা ভিখেরীর কন্যা নন, সাবেক প্রেসিডেন্টের কন্যা। ১৫ জুন শেখ হাসিনা একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠান।
সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলোয় অসৎ উদ্দেশ্যে ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উক্ত তথ্য পরিবেশিত হয়েছে বলে বিবৃতিতে শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন। শেখ হাসিনা বলেন ৭৫- এর ১৫ই আগস্ট থেকে ৮১-এর ১২ই জুন পর্যন্ত এই ছয় বছর উক্ত বাড়ী কিই অবস্থা ছিলো তা তার জানা নেই। সুতরাং এ বাড়ীতে প্রাপ্ত মালামাল সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন বলে জানান। প্রতিবেদনে স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকারাদি সম্পর্কে তিনি বলেন যে বাড়ীতে চার-পাঁচটি পরিবারের অলংকারাদি ও দ্রব্যসামগ্রী ছিলো। এছাড়া সেখানে বিভিন্ন সংগঠনের উপহার হিসেবে দেয়া সোনা-রূপোর নৌকোর বহু প্রতীকও ছিলো।
বাসভবনের প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ১৫ই আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত ঐ বাড়ীতে কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিলো না এটা তিনি জানেন। কিছু আগ্নেয়াস্ত্র মুক্তিযুদ্ধর নিদর্শন স্বরূপ অকেজো করে স্যুভেনির হিসেবে শেখ মুজিবকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়, যা শো-কেসে ছিলো। সেখানে কোন গোলাবারুদ ছিলো না বলে তিনি জানান। ১৫ই আগস্টের পর বাড়ীর মালামালের তালিকা তৈরীর সময় তার পক্ষের কেউ ছিলো না বলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, অতীতের বা বর্তমান সরকারের তৈরী মালামালের তালিকা আমি আজ পর্যন্ত পাইনি।
বাসভবনে প্রাপ্ত মালামালের মূল্য কোন কাগজে ২৫ লাখ টাকা অন্য একটি কাগজে ২৯ লাখ টাকা সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন যে, ৭৫ সালের ৩০শে অক্টোবর মোশতাক সরকারের শ্বেতপত্রের বরাত দিয়ে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার নগদ মুদ্রা, অলংকার ইত্যাদি প্রাপ্তি সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো। বাড়ীতে ৩ টি ব্যক্তিগত মোটর গাড়ীসহ উক্ত মূল্য ধার্য হয়েছিলো।
শেখ হাসিনা বিভ্রান্তমূলক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সচেতন থাকতে এবং সোচ্চার হতে আহ্বান জানান।
সংবাদপত্রে প্রতিবাদ জানালেও শেখ হাসিনা ধানমন্ডিতে পাওয়া বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য অলংকার সকল অস্থাবর সম্পত্তি ‘রিসিভ’ করেছেন। ৭১ পৃষ্ঠা তালিকায় কোথাও শেখ হাসিনা কোন আপত্তি রেকর্ড করেননি বা করাননি। শেখ হাসিনা বাড়ীর মালামাল চার-পাঁচ পরিবারের পক্ষ থেকে বুঝে নিয়েছেন এমন কোন কথাও হস্তান্তর দলিলে উল্লেখ নেই। বিষয়টি জেনে-শুনেই তিনি করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তালিকায় যেসব পাতায় বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন স্থানে পাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র কথা উল্লেখ রয়েছে, সেখানে হাসিনা স্বাক্ষর করেছেন এভাবে— রিসিভড এ্যাকসেপ্ট ফায়ার আর্মস’— আগ্নেয়াস্তে বাদে বুঝে পেলাম। শেখ হাসিনার অভিযোগ অনুযায়ী স্যুভেনির হিসেবে কোন অকেজো অস্ত্রের কথা তালিকায় বর্ণিত নেই।
শেখ হাসিনা বলেছেন— ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ‘৮১ সালের ১২ই জুন পর্যন্ত ছয় বছর বাড়ীটি কি অবস্থায় ছিলো, কি কি ছিলো এবং কি আনা হয়েছে বা নেয়া হয়েছে— তা সম্পর্কে আমি জ্ঞাত নই।’ কিন্তু সকল মালামাল গ্রহণ করার পর শেখ হাসিনার এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। এব্যাপারে তাঁর কোন সন্দেহ থাকলে তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি।
স্বর্ণালঙ্কার ইত্যাদির দাম সম্পর্কে তাঁর অভিযোগ সম্পর্কে বলা যায় যে, প্রতিবেদনে রৌপ্য, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য ধাতুনির্মিত প্রতীক তৈজসপত্রের দাম মোটামুটিভাবে ধার্য হয়েছে বর্তমান বাজার দামে। এর মধ্যে মূল্যবান হীরা-প্লাটিনাম পাথরের অলংকারও রয়েছে।
শেখ হাসিনার পৈতৃক সম্পত্তি গ্রহণ ও সে সম্পর্কে তার প্রিবার রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি করবে। এব্যাপারে হাসিনাকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে ভবিষ্যতে।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1981.06-hasina.pdf” title=”1981.06 hasina”]