নির্বাচন বানচালের জন্য কোন কোন দল অপপ্রচার চালাচ্ছে- বঙ্গবন্ধু
পিরােজপুর। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ এখানে ঘােষণা করেন যে, আগামী নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে কোন কোন দল দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই সব দল আগামী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন হবে বলে এ ধরনের বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি পিরােজপুর সরকারি হাইস্কুল ময়দানে অনুষ্ঠিত বৃহত্তম জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণকে এসব দলের চক্রান্ত নস্যাৎ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এসব লােক বিশ্বের সামনে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার সমালােচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত কোটি কোটি মানুষের কষ্ট লাঘব ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনকল্পে জরুরি প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক সাহায্য লাভের জন্য প্রধানমন্ত্রী যেসব চেষ্টা চালাচ্ছেন বিরােধী দলসমূহ তা বানচাল করার উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের কুৎসা রটনা শুরু করেছে।
দুষ্কৃতিকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যারা নিরীহ মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে সে সব দুষ্কৃতিকারীকে প্রতিহত করার। জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। আজ বরিশালে বঙ্গবন্ধু পার্কে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় ভাষণদানকালে তিনি উপরােক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, জনগণ আমার শক্তি, বন্দুকের নল আমার। শক্তির উৎস নয়। তিনি জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তাদের অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও তারা হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, যারা তাকে ভালবাসে তারা তার আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্র শস্ত্র জমা দিয়েছে, কিন্তু রাজাকার আলবদররা অস্ত্র শস্ত্র জমা না দিয়ে চুরি ডাকাতি এবং বিভিন্ন ধরনের সমাজ বিরােধী কাজে লিপ্ত রয়েছে। যে ব্যক্তি দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। আগামী ৭ই মার্চ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ক্ষতিকর ব্যক্তি দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, তিনি আরও ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্বে অভিলাসী তিনি নন। তবে পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে আসার পর জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের তাগিদেই তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমেই তিনি জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নেবেন। জনগণ যদি তাকে না চায়, তাহলে তিনি আনন্দের সাথে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন। তবে তার একটি মাত্র দুর্বলতা রয়েছে, তাহল জনগণকে তিনি ভালবাসেন। জনগণের তার প্রতি আস্থা আছে কি না জানতে চাইলে সভায় উপস্থিত শত-সহস্র মানুষ হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের প্রাণঢালা আস্থা প্রকাশ করেন। দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তারা জানেন যে জনগণ আমাকে ভালবাসে তাদের ব্যালট বাক্স খালি যাবে। বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িকতার উস্কানির চেষ্টা সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক থাকতে বলেন। এধরনের চেষ্টা চালানাে হলে তা বাংলাদেশের মাটি থেকে সমূলে উৎখাত করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান চক্রান্তকারীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্য এসেছে। পাকিস্তান আর ফিরে আসবে না। বাংলাদেশ চিরকাল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবেই টিকে থাকবে ইনশাল্লাহ। যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধপরাধীদের বিচার অবশ্যই বাংলাদেশের মাটিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইয়ুব ইয়াহিয়া ইস্কান্দার মির্জা কারই বন্দুকের হুমকির কাছে নতি স্বীকার করেন নাই। তিনি শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে নতি স্বীকার করেন। কাজেই কোন ষড়যন্ত্রই তাঁর দৃঢ় সংকল্প থেকে তাকে পরিবর্তন করতে পারবে না। পাকিস্তানে আটক ৪ লাখ বাঙালির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের আটক রাখার আইনগত কোন অধিকার ভুট্টোর নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি বিশ্ব বিবেকের সাহায্য কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, জনগণ যে সব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, সেই সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছেন এবং তা সমাধান করার চেষ্টা করছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের জনগণ ও ভারত সরকার আমাদের এক কোটি মানুষকে শুধু আশ্রয় দেয় নাই, আমাদের মুক্তি বাহিনীকে ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থাও করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু দেশে শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, দেশের ব্যাংক, বীমা, বড় বড় শিল্প-কারখানা, পাটকল, চিনি ও বস্ত্র কল জাতীয়করণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, যে সব সরকারি কর্মচারী এখনও তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করে নাই, অবিলম্বে তাদের মনােভাব পরিবর্তন করা উচিত। অন্যথায় তাদের এক ভয়াবহ ঝড়ের মােকাবেলা করতে হবে। তিনি সকলকে কঠোর পরিশ্রম করে যাওয়ার আহ্বান জানান। অন্যথায় দেশ নানা সমস্যার সম্মুখীন হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ছাত্র সমাজের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে সমাজের যােগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তােলার আহ্বান জানান।১০
রেফারেন্স: ২ জানুয়ারি ১৯৭৩, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ