বগুড়ায় খানসেনাদের নৃশংস বর্বরতা
বগুড়া। বিগত ৯ মাসে বর্বর পাকিস্তানিবাহিনীর দালালরা একমাত্র বগুরা জেলায় বিশ সহস্রাধিক নারী পুরুষ ও শিশু হত্যা করেছে। তারা আরাই হাজার নারী ধর্ষণ করেছে এবং ৮০ হাজার বাড়ি ধ্বংস করেছে অথবা পুড়িয়ে দিয়েছে। দখলদারী সেনাবাহিনী কোটি কোটি টাকার ধনসম্পত্তি লণ্ঠন। করেছে। বি এস এস এর ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি মি. রমেশ মিত্র উক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। চাঁদমারি ঘাটে, বগুরা বুরিংঘাট, সেনগাড়ি, ফৌজদারি ঘাট, ডিগ্রি কলেজ, মাটিডালি ব্রিকফিলড, অবাঙালি কলােনী, চেতগাড়া, বগুরা এতিমখানা, ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ, আরিয়ার বাজার, ফটকি ব্রিজের নিকটতিতখুড়, মাঝিরাসহ বহু স্থান গণহত্যার কেন্দ্র হিসেবে বর্বর পাকিস্তান সেনারা ব্যবহার করে। এসব স্থানে বহু সংখ্যক পাইকারী কবর আবিষ্কৃত হয়েছে এবং শত শত নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া শিবগঞ্জ, আতাপাড়া, ফুলবাড়ি, বিন্দাবনপাড়া, চন্দন বাইশা, মুরােইল, মালগ্রাম, ঠনঠনিয়া, কোহিতকুল, পাকিতাপাড়া, রামশহর, বাঘাপাড়া, মাতলা, নরুলি, চলােপাড়া, আকাশতারাম, ইছাইদহ, বুজরুকধাম, ক্ষিত্রিয়াধাম, মালতিনগর, সুত্রাপুর, জলেশ্বরীতলা, বাদুরতলা, কালিতলা, শিব্বাতি, লতিপুর, চকলােকমান দড়ামারা, রশিদপুর, বেজোয়ারা, কোরপুর সুখানপুকুর, ভেলুপাড়া এবং গাবতলীতে হাজার হাজার লােককে হত্যা করা হয়েছে এবং লুণ্ঠন , নারী ধর্ষণ, ও গৃহ ভষ্মীভুত করা হয়েছে। জানা গেছে যে, পাকিস্তান সেনারা ওয়াপদা রেষ্টহাউজ, এতিমখানা, মালাগ্রাম, মুররালী, বিন্দাবনপাড়া, ফুলবাড়ি প্রভৃতি স্থানে অগণিত বিবাহিত নারী ও কুমারীর ওপর পাষবিক অত্যাচার করে। বগুড়ার এডভােকেট গােলাম মােস্তফা এই প্রতিনিধিকে জানান যে, চন্দনবাইশার জনৈক কৃষককে খানসেনারা হত্যা করে। উক্ত কৃষকের সম্মুখে খানসেনারা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে তিনি বাধা প্রদান করেন। ফলে খানসেনারা তাকে হত্যা করে। অপর একটি ঘটনার কথা তিনি এক প্রতিনিধিকে অবহিত করেন। ঘটনাটি হলাে সিগতয়া গ্রামের জনৈক বিবাহিত যুবতিকে খানসেনারা অপহরণ করে এবং বগুড়া ক্যাম্পে ৩ দিন আটকে রেখে অবিরত ধর্ষণ করে। অপর একটি ছাত্রী প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য বগুড়া শহরে আগমন করে। বর্বরসেনারা পথিমধ্যেই তাকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে ধর্ষণ করে। পরদিন অসুস্থঅবস্থায় ছাত্রীটিকে ছেড়ে
দেওয়া হয়। বগুড়া শহরের একটি মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের তিন জন যুবতিকে (এর মধ্যে দুই জন বিবাহিতা) সেনাবাহিনী পাকড়াও করে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে ধর্ষণের পর ২৪ ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয়। এখানকার সুলতানগঞ্জের কুখ্যাত দালাল লিয়াকত আলী মেরিনা নামক ১৭ বছর বয়স্ক জনৈকা বিবাহিত যুবতিকে ধরে নিয়ে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে দিয়ে দেয়। তথা দেড় মাস আটক রেখে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানাে হয়। দেড় মাস পর পাকিস্তান সেনারা মেরিনাকে উক্ত দালালের কাছে ফেরত পাঠায়। উক্ত দালাল মেরিনাকে বলপূর্বক আটক রেখে তার যৌন লালসা চরিতার্থ করে। খানসেনারা আত্মসমর্পণ করলে উক্ত দালাল আত্মগােপন করে। মেরিনা জীবিত আছে সত্য, কিন্তু বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ বলে প্রকাশ। ধুপচাচিয়ার ফটিককুন্ডুর পরিবারের প্রায় সকলকেই পাকিস্তান সৈন্যরা হত্যা করে। তার যুবতি দৌহিত্রীকে মজিদ নামক জনৈক অবাঙালি দালাল বলপূর্বক বিয়ে করে। পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনী উক্ত দালালকে খতম করে। রামশহরের পীর পরিবারের সবাইকে খানসেনারা হত্যা করে। পীরের দুই পুত্র মুক্তিবাহিনীতে থাকায় বেঁচে আছে। সেনাবাহিনী জেলার বহু সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিয়েছে অথবা ধ্বংস করেছে। পাবলিক লাইব্রেরির মূল্যবান পুস্তকাদি জ্বালিয়ে দিয়েছে। বহু সংখ্যক শিক্ষক, ডাক্তার, পুলিশ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারিকে খানসেনারা পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বগুড়া শহরের দেড় হাজারের অধিক কাঁচা বাড়ি খানসেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
রেফারেন্স: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ