কোনো কোনো সরকার বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে না নিলেও বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছে- সিনেটর কেনেডী
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী সোমবার ঘোষণা করেন যে, কোনো কোনো সরকার বাংলাদেশেকে মেনে না নিলেও বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বলেন যে, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে দুদিনের সফরে রাজধানীতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে মার্কিন সিনেটর শরণার্থী সংক্রান্ত উপপরিষদের চেয়ারম্যান মি. কেনেডি একথা বলেন। পত্নী মিসেস জোয়ান কেনেডি ও ভাই-এর ছেলে জেএফ কেনেডি তার সাথে ঢাকায় এসেছেন। ঢাকা অবস্থানকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আজাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া হেলিকপ্টার যোগে কুষ্টিয়ার বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : মার্কিন ডেমোক্রেট দলের নেতা। এবং বিখ্যাত কেনেডি পরিবারের পরলোকগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির ছোট ভাই সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক সমাবেশে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এক নয়া অধ্যায় সংযোজন করেছে। নবজাত রাষ্ট্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে সিনেটর কেনেডি বলেন, এ শিশু রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আপনাদের ওপরই। বাংলাদেশি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যারা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিতে বিশ্বাস করেন না বাংলাদেশের নজরে তাদেরকে শিক্ষা দেবে।
সরকার ছিল না জনগণ ছিল : মার্কিন সরকার যদিও বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করেনি তথাপি মার্কিন জনগণ এদেশের সংগ্রামী মানুষের দোসর ছিল। মানুষের মহান মূল্যবোধের মর্যাদা দিয়েই তারা বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে সিনেটর কেনেডি ঘোষণা করেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণের জন্য মার্কিন জনগণের শুভেচ্ছাবাণী নিয়ে এসেছি।’ তিনি আরো বলেন যে, আমেরিকানরা পরম আগ্রহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ যুদ্ধে সবাই অংশগ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই বাঙালি’ আমরা সবাই আমেরিকান, আমরা সবাই মানুষ। আমরা মানুষ্যত্বে বিশ্বাস করি।’ সভা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জয়বাংলা, জয় কেনেডি, কেনেডি তোমায় ভালোবাসি এসব স্লোগান করেন।
বিমানবন্দরে : সকালে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বিমান বন্দরে পৌঁছালে আন্তরিক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বিমান বন্দরে বাংলার তরুণ সমাজ সিনেটর কেনেডিকে এক নজর দেখার জন্য এতো পাগলপারা হয়ে পড়ে যে, সরকারি নিয়ম শৃঙ্খলা পর্যন্ত বিকল হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে এক প্রকার ঘিরে রাখে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এম আর সিদ্দিকী যথাসময়ে তাঁকে স্বাগত জানাতে পারেনি। বহু কষ্টে তরুন তরুণীদের ভিড়ের মধ্যে থেকে কোনো রকম বের করে আনলে প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী তাঁকে বাংলার মাটিতে সু-স্বাগতম জানান। এরপরই আওয়ামী লীগের পক্ষে জনাব আবদুর রাজ্জাক এবং ন্যাপ নেতা জনাব মহিউদ্দিন তাঁকে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। তারা কিছুক্ষণ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সিনেটর কেনেডিকে অভিনন্দন জানাতে পেরেছিলেন। বিমান বন্দরে সিনেটর কেনেডির জন্য একটি লালগালিচা বিছানো হয়েছিল। অনেক হতাস তরুণ তরুণী মালা দিতে না পেরে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করেন। বলাবাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় একই দৃশ্যের অবতারণা হয়।
আজকের কর্মসূচি : আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ থাকাকালে সিনেটর অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটাবেন। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সিনেটর কেনেডি এবারই প্রথম ঢাকায় এলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ তা নাকচ করে দেন।
রেফারেন্স: ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ