ইন্দিরা গান্ধীর আয়োজিত ভোজসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
কোলকাতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আয়োজিত ভোজসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন তার পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো: মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আজকের সন্ধ্যায় এখানে আপনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে আমি নিজেকে সত্যিই অনেক ভাগ্যবান মনে করছি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরূপে এই প্রথমবার আমি সীমান্তের ওপার থেকে মৈত্রী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে কোলকাতা মহানগরীতে এসেছি। ইতিহাসের এ এক নজিরবিহীন মুহূর্ত। এই মহানগরীর সাথে আমার ব্যক্তিগত জীবনের বহু মধুর স্মৃতি বিজরিত। আমার ছাত্র-জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলোর বেশীর ভাগ এখানেই অতিবাহিত হয়েছে। সেই অমূল্য দিনগুলোতেই গড়ে উঠেছিল আমার জীবন। কোলকাতার নাগরিকরা যে আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, আমি তা কখনো ভুলবো না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংকটময় অথচ বীরত্বপূর্ণ দিনগুলোতে সাময়িক আশ্রয় লাভের আশায় এখানে ছুটে এসে আমার সহকর্মী এবং স্বদেশবাসীরা যে সাদর সম্বর্ধনা লাভ করেছিলেন, তাঁরাও তা কখনো ভুলবেন না। অনেক রক্ত, ত্যাগ এবং তিতিক্ষার বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, শোষণ ও ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে ছিনিয়ে এনেছি আমাদের মুক্তি। আমাদের এই মুক্তি সংগ্রামে ভারতের স্বাধীনতাপ্রিয় জনসাধারণ যে সমর্থন দান করেছেন, তা আমার দেশবাসী গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, আপনার দেশের জনসাধারণ যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং ভারতের নির্ভীক সশস্ত্রবাহিনী যেভাবে জীবন দিয়েছেন, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সে কথা স্মরণ করে আমাদের সংকটকালে আপনি যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, এখানে তারও উল্লেখ না করে পারছি না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভারত তথা বিশ্বের সকল দেশে জনমত সংগঠন করে আপনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এক দুর্বার গতি সঞ্চার করেন। তারই ফলে বাংলাদেশকে যারা গ্রাস করতে চেয়েছিল, সেই অশুভ শক্তিগুলি আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়। ভারত এবং বাংলাদেশের মৈত্রীর সম্পর্ক চিরকাল দৃঢ় এবং অবিচ্ছেদ্য থাকবে। কারণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য আমরা একই ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছি এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ সৌহার্দ্য, অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা এবং সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নীতি অনুসরণ করে আমরা এই দুটি দেশ সদ্ভাব বজায় রেখে চললে আমরা সবদিক থেকে লাভবান হবো। ভৌগলিক অবস্থানের বিচারেও দেখা যায়, জনসাধারণের স্বার্থে সম্ভাব্য সকল বিষয়ে এ দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। আমাদের নির্ভীক দেশবাসীর সংগ্রাম এবং আপনার সরকার ও ভারতের জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থনের ফলেই বাংলাদেশে শোষণ এবং অবিচারের একটি যুগের অবসান ঘটেছে। আজ বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে এক নতুন যুগের সূচনা। যে-যুগ পুনর্গঠনের, যে-যুগ অর্থনৈতিক উন্নয়নের, যে-যুগ সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর গতিশীল নেতৃত্বে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গৌরবময় অগ্রগতি সাধন করবে, সে-বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমরা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের একই আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোট-নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে চলেছি। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, এই উপমহাদেশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা অবশ্যই আসবে। প্রতিবেশীদের প্রতি বিরোধ সৃষ্টির বন্ধ্যানীতি অনুসরণের দিন এখানেই শেষ হোক। তেমন দিন যেন আর কখনও না আসে। আমরা যেন আর কখনও আমাদের জাতীয় সম্পদের অবচয় না করি। সে সম্পদ যেন আমাদের জনসাধারণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্যই ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গেই আমরা সবসময় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকবো। এ অঞ্চলের জনসাধারণের কল্যাণের জন্য সৎ প্রতিবেশীর মত সহ-অবস্থান এবং গঠনমূলক নীতি অনুসরণ করাই আমাদের প্রয়োজন। এই বিরাট দায়িত্ব পালনে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। বিরোধ ও অবিশ্বাস-দীর্ণ পৃথিবীতে আমাদের এ অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতা অন্যান্য জাতির নিকট আদর্শস্বরূপ হতে পারে। ভারত এবং বাংলাদেশের মৈত্রী যে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে, সে বিষয়ে আমাদের কিছু মাত্র সন্দেহ নেই। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আসুন এবার আমরা ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য এবং এ দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মহান জনগণের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করি। ২৩
রেফারেন্স: ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ