দেশ-বিদেশে তরুণেরা বীরাঙ্গণাদের জীবনসঙ্গিনী করতে আগ্রহী
বাংলাদেশ আমাদের কাছে মায়ের মতই। এই বাঙালি মায়েরই কোলে জন্ম নিয়েছি আমরা। এই বাঙালি মায়ের মুখ চেয়ে একদিন আমরাই সংগ্রামী হয়েছিলাম। বাংলার ঘরে ঘরে রয়েছে আমার মা-বোন। হানাদার-বর্বর-পাকিস্তান জঙ্গীশাহী ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে শুধুমাত্র হত্যাযজ্ঞ চালায় নি, আমার মাকে, আমার বোনকে ধর্ষণ করেছে। কচি কিশোর বোন, তরুণী ছাত্রী বোন, বিবাহিত বোন, সন্তানের মা এবং আমার বৃদ্ধ মায়ের ওপরও চালিয়েছে শারীরিক অত্যাচার। সেই সব কালরাত্রিতে আকাশের তারা উঠতো কিনা জানি না- বাতাসের গন্ধ মধুর হতো কিনা জানি না, জোনাকিরা মিটমিট জ্বলতো কিনা জানি না- কিন্তু অসহায় মা বোনদের চোখে জ্বলতো আগুনের ফুলকি। বর্বর হানাদারদের ক্ষুধার শিকার আমার দুর্বার সংগ্রামী মা বোনেরা তিলে তিলে লজ্জাকে গলা টিপে হত্যা করেছিল। তাদের লজ্জা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সেইসব কালোরাত্রির দেয়ালে দেয়ালে বুলেট হয়ে বিঁধেছিল। সংগ্রামী বীরাঙ্গণা মা-বোন আমার, তোমাদের জন্য, শুধু তোমাদের আশীর্বাদের জন্য আজ বাংলার সারা আকাশ জুড়ে নতুন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আজ তোমাদের সব ভয়, লজ্জা, দ্বিধা, হতাশা রাতের অন্ধকারে ডুবে যায়। আমরা আজ সেসব স্মরণ করতে চাই না। আমরা চাই না আর স্মৃতিচারণ করতে। নতুন করে জন্ম হোক আমাদের। নতুন সূর্যের আলোয় আমরা স্নাত হয়ে প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে দেই ভালোবাসার গান। নবজীবনের আহ্বান। বাংলাদেশে হাজার হাজার মা বোন ধর্ষিতা ও লাঞ্ছিতা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। বেশকিছু সংখ্যক মা বোন স্বাধীনতা সূর্য উঠার আগেই বন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করেছে। এখনো যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন মহিলা সমিতি এবং আন্তর্জাতিক মহিলা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গণা মা বোনদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী প্রণীত হয়েছে।
শুধু সরকার নয়, শুধু মহিলা প্রতিষ্ঠান নয়, বাংলার বীর যুবসমাজও অবাঞ্ছিত সন্তানের জননীদের আপন করে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। বাংলার এই অবাঞ্ছিত মায়েদের দুঃখে যুবসমাজ মৌলিক দুঃখ প্রকাশ করে নিজ নিজ দায়িত্বে তরণী পার হয়নি। এদের জন্য যুবসমাজে জেগে উঠেছে এক বিরাট আলোড়ন। জাগ্রত যুব-জনতা হাত বাড়িয়েছে ওদের বুকে টেনে নেওয়ার জন্য, নতুন সমাজে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। অবাঞ্ছিত সন্তানের জননী যারা এখনো পাশবিকতার, অমানবিকতার, দগদগে ঘা নিয়ে বেঁচে বর্তে আছে, তাদেরকে সমাজে অপাংক্তেয় করা সাধারণ ঔদার্যের পরিচায়ক নয়। এ তুলনাহীন উদারতার অঙ্গে অঙ্গে মিশে আছে মহানুভবতা। এ হচ্ছে সেই মহানুভবতা, যা কেবল মানুষের অন্তরের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যেই জন্ম নিতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এদেশবাসীকে শুধু অস্ত্র তুলে ধরার মধ্যেই দীক্ষিত করেনি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মানুষকে করেছে মহীয়ান। তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি এদেশের যুবসমাজের মধ্যে। দিকে দিকে আজ চলছে মানবতার সাড়া দেওয়ার পালা, দিকে দিকে আজ দেখা যাচ্ছে যুবসমাজের সচেতনতার স্বাক্ষর। সত্যি, যুবসমাজ অবাক করেছে দেশবাসীকে। যুবসমাজের উদ্দেশ্য মহৎ। এ মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই যুবসমাজ মহিলা কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বেশকিছু সংখ্যক চিঠি পেয়েছে। সব চিঠিরই বক্তব্য এক। সব চিঠিরই উদ্দেশ্য মহান। এসব চিঠির মধ্যে একজন পত্র লেখক জানিয়েছেন, তিনি লাঞ্ছিত মেয়েদের মধ্যে একজন এম, এ শ্রেণীর মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার গড়তে প্রস্তুত আছেন। আরেকজন লিখেছেন, সংসারে তার একান্ত আপনজন বলতে কেউ নেই। তিনি একজন সঙ্গী চান। তার ইপ্সিত সঙ্গী হোক না লাঞ্ছিতা, হোক না অবাঞ্ছিতা। তিনি তাকে মনের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন। আর একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, পেশায় অধ্যক্ষ, মৌখিকভাবে এখানে সেখানে বলে বেড়াচ্ছেন বয়স অনেক হয়েছে অতএব কোনো তরুণীকে বিয়ে করে তিনি তরুণীটির জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে চান না। তিনি চান, খানসেনাদের অত্যাচারের শিকার একজন বীরাঙ্গণা মহিলাকে নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিতে। অবাঞ্ছিত সন্তানের জননীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে বাংলাদেশের ছেলেরাই যে একচেটিয়া অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে তা নয়। বাংলাদেশের বাইরে থেকেও চিঠি আসছে। চিঠি আসছে প্রতিবেশী রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গ থেকেও। বর্বর পাকিস্তান-বাহিনী বাংলার গরীয়সী মা-বোনদের সঞ্চিত সম্মান কেড়ে নিয়েছে। পূর্বতন সেই সম্মানের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য, আপন মর্যাদায় পুনর্বহাল করার জন্য মানবতার আদর্শে বিশ্বাসী বাংলার যুবসমাজ আজ প্রস্তুত। বাংলাদেশের মহিলা পরিষদও নিশ্চিত হয়ে বসে নেই। ২৫ মার্চের পর মহিলা পরিষদের কার্যালয় মুজিবনগরে স্থানান্তরিত হয়। এবং সেখান থেকেই তারা পাকিস্তান সামরিক চক্রের বর্বরতার কথা বিশ্ব সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান। বঙ্গ ললনাদের সীমাহীন নির্যাতনের চিত্র বিশ্ব নারী সমাজের কাছে প্রকাশ করেন এবং নৃশংসতা নিবারণের জন্য মানবিক আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে বিশ্বশান্তি পরিষদ, আন্তর্জাতিক মহিলা ফেডারেশন এবং ভারত মহিলা ফেডারেশনের সাড়াও পান। স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। রক্তের ঢলও নেমে গেছে কিন্তু রক্তের দাগ শুকায় নি। নির্যাতিত মা-বোনদের সমস্যারও হয়নি কার্যকর সমাধান। খান সেনাদের পাশবিক কামনা থেকে নাবালিকারাও রেহাই পায়নি, রেহাই পায়নি বৃদ্ধারাও। এমনকি সন্তান সম্ভবা নারীরাও অবলীলাক্রমে হয়েছে ধর্ষিতা। এসব অমানুষিক অত্যাচারের ফলে বহু নারী আজ উন্মাদ। বহু নারী আজ সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন। যারা আত্মহত্যা করেছে, তাদের নিয়ে ভাবনা তেমন প্রকট নয় কিন্তু যারা সন্তান সম্ভবা, তাদের নিয়ে সমস্যা। সন্তান সম্ভবাদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ। অনেকেই মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারের ফলে পঙ্গু। অনেকেই সহযোগিতার ভয়ে ভীত হয়ে ঘর-বিমুখ। অনেকেরই প্রিয় আত্মীয়স্বজনরা এইসব অবাঞ্ছিত জননীদের ভরণ পোষণে অনিচ্ছুক। সামাজিকতার ভয়ে অনেকে আজ বাধ্য হয়ে অসামাজিক পথে পা বাড়াচ্ছে। এসব মেয়েদের দায়িত্ব সরকারের নিতে হবে। সরকার এদের দায়িত্ব নিতে রাজি। কিন্তু সরকারি পুনর্বাসনের মধ্যেই কি নারী জীবনের পরম পূর্ণতা? বাংলাদেশের মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে মহিলা ডাক্তাররা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ধর্ষিতা জননীদের জীবনকে সুন্দর ও সুস্থ্য করার জন্য এরা কাজ করে যাচ্ছেন। জীবনের প্রতি ঘৃণাভাব এইসব মহিলাদের অন্তর থেকে চিরতরে মুছে দিতে হবে। মাতৃ-মুক্তির রক্তাক্ত সংগ্রামের পর এই সংগ্রামে শরীক হতে হবে বাংলার মানুষকে। এই সংগ্রামের অবসান না ঘটলে দুঃখের তিমির রাত বিদূরিত হবে কেমন করে?২৫
রেফারেন্স: ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ