শহীদানের স্বপ্ন সফল করুণ- বঙ্গবন্ধু
দখলদারবাহিনীর বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চীর আকাঙ্ক্ষিত চূড়ান্ত বিজয় লাভের প্রাক্কালে স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মদানকারী বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির সম্মানে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের ফলক উন্মোচনকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল শুক্রবার শহীদানের স্বপ্ন সফল ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত অহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে না পারলে শহীদানের আত্মা শান্তি পাবে না। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকে হানাদার বর্বর পাকিস্তানিবাহিনী ও এদের দোসরদের সুপরিকল্পিত হত্যা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পূর্বে হানাদারবাহিনী যখন বুঝতে পারলো যে, এরা আর বাংলাদেশে থাকতে পারবে না, ওরা তখন বুদ্ধিজীবীগণকে আল বদর ও আল শামসের সহযোগিতায় তাদের নিজ নিজ বাড়ি হতে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরা ডাক্তারের হৃদপিন্ড টেনে বের করেন, সাংবাদিকদের হাত কেটে ফেলে, শিক্ষকদের চোখ উপরে ফেলে, ইঞ্জিনিয়ারদের মাথার মগজ বের করে হত্যা করে, এমন নৃশংসভাবে মানুষ হত্যার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার ইতিহাসে নাই। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সময় তার কণ্ঠ কান্নায় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এবং গন্ডদেশ দিয়ে অফুরন্ত অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছিল। কান্না জড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু বলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আমার কারা জীবনেরে সাথী ছিলেন। আমি তাদের লেখা পাঠ করেছি। আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি তাদের নিকট হতে অনেক সাহায্য পেয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল। পরক্ষণেই বঙ্গবন্ধু বজ্র কণ্ঠে বলেন, এই পশুদের নাকি বিচার হবে , এদেরই নাকি ক্ষমা করতে হবে। যদি এদের বিচার না করি তাহলে শহীদানের বৃদ্ধ মাতাপিতা, অবুঝ অনাথ ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নিকট আমি কি কৈফিয়ৎ দিব? আমরা প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না! আমরা ইনসাফে বিশ্বাস করি, বিচারে বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, এরা ভেবেছিল, অত্যাচার-নিপীড়ন করলে বাংলার মানুষ এদের নিকট আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু এরা বাংলার ইতিহাস জানে না। প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাঙালি অত্যাচারীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে জানে না। তিনি এই প্রসঙ্গে বাঙালি জাতির শৌর্যবীর্জের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের প্রতি আলোকপাত করে বলেন, এই বাংলার মাটিতে প্রথম সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। এই বাংলার তিতুমীর, সূর্যসেন, হাজী শরিয়তউল্লাহ স্বাধীনতার জন্য প্রথম সগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু তারা স্বাধীনতার সূর্য দেখে যেতে পারেন নাই। বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, আদর্শের জন্যে তারা রক্ত দিয়েছেন। সেই আদর্শ বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। যেদিন আমরা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো, মানুষ যেদিন পেট ভরে খেতে পারবে, রোগে চিকিৎসা পাবে, সেদিনই শহীদানের আত্মা শান্তি পাবে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গঠনের মাধ্যমে শহীদানের স্বপ্নকে বাস্ত বায়িত করার উদ্দেশ্যে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।৮৪
রেফারেন্স: ২২ ডিসেম্বর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ