চীন এখন ভেটোর প্রশ্নে অটল, বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তির পক্ষে রায়
জাতিসংঘ। বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের আশু জাতিসংঘভুক্তির আহ্বান জানিয়ে একটি সর্ব সম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবটির ওপর কোনোরকম ভোটাভুটি হয়নি। চীন এবং পাকিস্তানসহ সদস্যগুলো প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। যুগোশ্লোভিয়া ২২টি দেশের সমর্থন নিয়ে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। আর্জেটিনা কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রস্তাবও একই সঙ্গে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এতে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ও পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মানবিক সমস্যাসহ উপমহাদেশের অমীমাংসিত সমস্যাবলী সমাধানের আহ্বান জানানো হয়। ১৫টি দেশের সমর্থন নিয়ে আর্জেন্টিনা এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। এতে পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সমস্যাটি এই প্রথম আন্তজার্তিক সমর্থন লাভ করলো। এর ওপরও কোনো রকম ভোটাভুটি বা বির্তক হয়নি।
প্রস্তাব দুই টি পরস্পর নির্ভরশীল স্ট্যানিস্লাভ : সাধারণ পরিষদের সভাপতি পোল্যান্ডের মি. স্ট্যানিস্লাভ ট্রেপজিনস্কি ভোটাভুটি ছাড়া প্রস্তাব দুটি গৃহীত হওয়ার ব্যাপারে মতৈক্যের কথা ঘোষণা করে বলেন, এই মতৈক্যের মধ্যে প্রস্তাব দুটির একটির অপরটির ওপর নির্ভরশীলতা এবং উপমহাদেশে সমস্যাবলীর শান্তিপূর্ণ সমাধানের সাধারণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।
ভেটোর প্রশ্নে চীন অটল : সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে আশু সদস্যপদ দানের পক্ষে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করা সত্ত্বেও চীন এই মর্মে নোটিশ জারি করে যে, ডিসেম্বর যুদ্ধের সমস্ত পাকিস্তানি বন্দিকে ভারত যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে, বাংলাদেশের সদস্য পদের আবেদনে চীন ভেটো দিয়ে যাবে। প্রস্তাব দুটি গৃহীত হওয়ার পর ভারত, যুগোস্লাভিয়া, আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান ইন্দোনেশিয়া এবং বুলগেরিয়াসহ সর্বমোট ১৬ টি দেশ প্রস্তাব দুটির ওপর বক্তৃতা করেন। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু ও পর্যটন মন্ত্রী ত্রিদিব রায় বলেন, বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তির জন্য ‘অমীমাংসিত সমস্যাবলীর নিষ্পত্তি এবং প্রধানত যুদ্ধন্দিদের প্রত্যার্পণ হচ্ছে প্রয়োজনীয় পূর্ব শর্ত’ অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবটি মূখ্য অপরটি গৌণ। পক্ষান্তরে, জাতিসংঘ নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী পর্যবেক্ষক চার্জ দ্যা এ্যাফেয়ার্স সাঈদ করিম বলেন, জাতিসংঘ সনদের নির্ধারিত সাধারণ শর্তাবলী ছাড়া অন্য কোনো শর্ত জাতিসংঘের কোনো দেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে আরোপ করা চলে না। তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তির ওপর প্রস্তাবটি মুখ্য অপরটি গৌণ। সাধারণ পরিষদের গৃহীত ব্যবস্থা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অন্তর্ভুক্তির জরুরি প্রয়োজনীতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কখন তার সদস্য পদের আবেদনের ওপর স্বস্তিপরিষদের আরেকটি বৈঠক আহ্বানের প্রার্থনা জানাবেন জনাব করিম তা জানাতে অস্বীকার করে। স্বস্তি পরিষদের সুপারিশের আগে সাধারণ পরিষদ কোনো দেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দিতে পারে না। সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব দুটি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মনোভাবের মধ্যে একটি আপোষের পরিচায়ক।
প্রস্তাব দুটির পূর্ণ বিবরণ:
প্রথম প্রস্তাবঃ সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির আবেদনটি লক্ষ্য করে, এ ব্যাপারে স্বস্তি পরিষদের বিশেষটিও লক্ষ্য করে, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য পদের সার্বজনীনতার নীতিটি আবার হলোপ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে অচিরেই জাতিসংঘের সদস্য করে নেয়া হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাব : সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘ সনদের প্রাসঙ্গিক বিধানসমূহ মনে রেখে, জাতিসংঘ সনদ স্বস্তিপরিষদের ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর ৩০৭ (১৯৭১) নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক ও সহযোগিতা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের নীতিসমূহের ঘোষণাটি মনে রেখে, দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশে স্বাভাবিক অবস্থার পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহয়তা করার উদ্দেশ্যে এ যাবত গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, বিশেষ করে সিমলা চুক্তিটি সন্তোষের সাথে লক্ষ করে, সক্রিয় বৈরিতা বন্ধ করার পর অবিলম্বে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিদান ও প্রত্যার্পণের বিধান সম্বলিত ১৯৪৯ এর ১২ আগস্টের জেনেভা কনভেনশনের নীতিসমূহের কথা মনে রেখে সামরিক ও বেসামরিক লোকদের স্ব স্ব দেশে প্রত্যাবর্তনের সমস্যাসহ সমস্ত অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান এতোদঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলার পরিবেশ কায়েম করার জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করে। সকল পক্ষ সমস্যা-নিস্পত্তির সম্ভবনাকে বিপন্ন ও চূড়ান্ত আপোষ মীমাংসাকে আরো কঠিন করে তোলার মতো যে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করে এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছে যে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ ১৯৪৯ এর জেনেভা কনভেনশন ও স্বস্তিপরিষদের ৩০৭ (১৯৭১) নম্বর প্রস্তাবের সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহের সংগতি রেখে সহযোগিতা ও পারস্পারিক মর্যাদারও মনোভাব নিয়ে এখনো যেসব সমস্যার নিস্পত্তি হয়নি সেগুলোর সুষ্ঠ নিস্পত্তির জন্যে সম্ভব্য সব রকম প্রচেষ্টা চালাবে।১০৫
রেফারেন্স: ৩০ নভেম্বর ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ