পাকিস্তানি বর্বরতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে কান্নায় ভেঙে পড়েন
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে দখলদার আমলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেসব পাশবিক অত্যাচার করেছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, জনাব স্পীকার আমার মনে পড়ছে, গতবছর ২৫ মার্চ রাতে আমার বাড়িতে নির্বিচার গুলিবর্ষণের মাঝে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার লোকের রক্তের ওপর দিয়ে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু সংবিধান বিলের ওপর আলোচনার উপসংহার হিসাবে ভাষণদান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর মর্টার ও মেশিন গানের গর্জন শুনেছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘরবাড়ি পুড়তে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু তার জনগণকে হত্যা না করে তাকে হত্যা করার জন্য বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। গণপরিষদে একথা বলার সময় তার গন্ড বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। বঙ্গবন্ধু বলেন, “বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার কথায় কর্ণপাত না করে গণহত্যা চালিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী গণপরিষদে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদেন এবং পরিশেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “জনাব স্পীকার কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না যে মানুষ পাশবিকতার এতটা নিচে নামতে পারে যে, দুই বছরের শিশুকে হত্যা করে মায়ের বুকের ওপর ফেলে দেয়। জনাব স্পীকার একথা কেমন করে বিশ্বাস করা যায় যে, মানুষ পাশবিকতায় এত নিচে নেমে গেছে যে, আমার দেশের ৭০ বছরের বৃদ্ধাকেও ধর্ষণ করতে পারে।
“হালাকু, চেঙ্গীস খান, হিটলার ও মুসোলিনীর অমানবিক বর্বরতার বর্ণনা জনগণ পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর পাশবিক অত্যাচার এসব রেকর্ডকে ম্লান করে দিয়েছে। পাকিস্ত নিবাহিনী যে গণহত্যা, ধ্বংসকান্ড, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ চালিয়েছে বঙ্গবন্ধু যখন বর্ণনা দান করছিলেন তখন পরিষদে এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, তথ্য ও বেতার মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আরও অনেকেই তখন পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, “পাকিস্তানি দস্যুরা বাংলাদেশকে ৩০ লাখ লোক হত্যা ও ২ লাখ মহিলার শ্লীলতাহানী করেছে। এছাড়াও গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহরে অগ্নি সংযোগ ও ধ্বংস সাধন তো করছেই।” জনাব স্পীকার আশ্চর্যের ব্যাপার যে, সর্বোচ্চ জাতীয় সংস্থা হিসাবে আমরা যে ভবনকে ব্যবহার করছি সেই পরিষদ ভবনে এমন কোনো দেয়াল বা কক্ষছিল না যেখানে মানুষের রক্তের চাপ দেখা যায় নি। পাকিস্তানি সৈন্যরা এই ভবনকেও একটা কসাইখানা হিসাবে ব্যবহার করেছে। বঙ্গবন্ধু আরও জানান যে, পরিষদ ভবন সংস্কার সাধন করার জন্য আমাদের লোক প্রবেশ করে কেবলমাত্র রক্তের ছাপ দেখতে পেরেছে। কেউ জানে না এই ভবনে তারা কসাইখানা করে কত লোক হত্যা করেছে। গণপরিষদের অধিবেশনে ব্যবস্থা করার জন্য সেসব ভয়ংকর দৃশ্য মুছে ফেলতে হয়েছে। তবে রক্ত রঞ্জিত দেয়ালের জয় বাংলা লেখার জন্য এখনও বিরাজ করছে বলে বঙ্গবন্ধু জানান। শেখ মুজিব আরও বলেন, “অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান দখলদারবাহিনী বাংলাদেশের নির্দোষ জনগণের ওপর সর্বপ্রকার নৃসংশতা ও নিষ্ঠুরতা চালিয়েছিল। তারা পুলিশ, তৎকালীন ইপিআর এবং অন্যান্য সামরিক লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করছে। এরপর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীর প্রধান লক্ষ্য বস্তু ছিল পাকিস্তানি হত্যাকারীদের হাতে কেবল মাত্র আমাদের কয়েক জন পরিষদ সদস্যকেই হারায় নি, পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় এমন কোনো সদস্য নেই যার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় নি এবং তাদের আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করেনি। তবে ৭ মার্চ আমার জনগণকে আমি বলছিলাম যে, যারা রক্ত দিতে শিখেছে। তাদের পরাভূত করতে পারে এমন কোনো শক্তি বিশ্বে নেই। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ রক্তের বিনিময়ে এই সত্যকে প্রমাণিত করেছে।১৩
রেফারেন্স: ৪ নভেম্বর ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ