মুক্তিযুদ্ধকালে ৯৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি ও সংস্কার সম্পর্কে প্রথম সরকারি জরিপে নবজাত রাষ্ট্রের প্রায় ১৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসার দেখানো হয়েছে। শুক্রবার এক সরকারি রিপোর্টে এই তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকাস্থ আনরডের বিশেষ উপদেষ্টা শ্ৰী এস, কে, দে’র পরিচালিত এ জরিপে উল্লেখিত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও বেসরকারি হিসাবের খুব কাছাকাছি। উল্লেখ্য, সরকারের উক্ত প্রাথমিক হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকার উর্ধ্বে উল্লেখ করা হয়েছিল। বিশিষ্ট সমাজ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও ভারত সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রী দে তার রিপোর্টে বলেন। যে, কেবলমাত্র বৈষয়িক ক্ষয়ক্ষতিরই হিসাব করা হয়েছে, যেগুলো ফাইলপত্র থেকে ও সরেজমিনে তদন্তের ফলে পাওয়া যায়। এইসব বৈষয়িক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আরও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি রয়ে গেছে সেগুলো হিসাব করা প্রায় অসম্ভব। সাতটি তালিকায় বিভক্ত এ জরিপ রিপোর্টে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব মোট ৯২৯ কোটি ৮৯ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকার উল্লেখ করা হয়। এটা প্রায় ১২০ কোটি ৭০ লক্ষ ডলারের সমান। কৃষি ক্ষেত্রে এবং মৎস্য গবাদি পশু ও খাদ্যসহ কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে সর্বাধিক ক্ষতি সাধিত হয়। এই ক্ষতির মোট পরিমাণ প্রায় ৪২৯ কোটি টাকা। তারপর বৈষয়িক ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির স্থান। এই ক্ষেত্রে তিনশত কোটি টাকার ওপর ক্ষতিসাধিত হয়। একমাত্র পরিবহণ খাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় একশত কোটি টাকার ওপরে। তার মধ্যে মোটরযানের ক্ষয়ক্ষতি হয় ৩০ কোটি টাকার কিছু বেশি এবং রেলপথের ক্ষতি হয় অনুরূপ অর্থের কিছু কম। আনরডের কর্মচারী ও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত এই জরিপে উল্লেখ করা হয় যে, জনসাধারণের অন্যত্র গমণের ফলে উৎপাদনের বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। প্রায় ৪০ লক্ষ সমর্থদেহী প্রাপ্ত বয়স্ক সহ এক কোটি লোক পার্শ্ববর্তী দেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেয় এবং তারা গড়ে ৬ মাসের অধিক কাল যাবৎ তাদের লাভজনক পেশা থেকে বঞ্চিত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার সমগ্র সময় ধরে এটার প্রায় দ্বিগুন সংখ্যক লোক বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই একস্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয়ের জন্য গমনাগমন করে। জরিপ রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, এই বিপুল সক্রিয় জনশক্তি অব্যবহারের দরুন উৎপাদনের বিরাট ক্ষতি সাধিত হয় এবং এই ক্ষতি নবজাত রাষ্ট্রের ওপর দীর্ঘকাল যাবৎ চেপে থাকবে। জরিপ রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, উৎপাদন সরঞ্জাম ও দক্ষ শ্রমশক্তি বিনষ্ট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে কর্মকুশলীর দিক দিয়ে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তার সঠিক হিসাব নিরূপণ করাই কঠিন। রিকশা, নৌকা ও স্থানীয় যানবাহনের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। এই ক্ষতির পরিমাণ সঠিক ভাবে নিরূপণ করা অসম্ভব না হলে দূরূহ। গ্রামাঞ্চলের চাষিদের কিংবা কারিগরদের ব্যবহারিক সরঞ্জাম ও উপকরণের ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশৃঙ্খলা চলাকালে দোকানপাট ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালপত্র এবং সোনা, রূপা, লুণ্ঠনের ফলে যে ক্ষতি হয়, তাও একই পর্যায়ে পড়ে। সমগ্র দেশের গণ পাঠাগার ও কমিউনিটি সেন্টার, ক্রীড়া ও সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ক্ষতি সাধিত হয়েছিল সেগুলোর সঠিক হিসাব নিরূপণ করা সম্ভব নয়।১১০
রেফারেন্স: ২৭ অক্টোবর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ