দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল
সৈয়দ নজরুল বাংলাদেশ গণপরিষদের আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সহকারী নেতা শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার গণপরিষদের অধিবেশনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, দীর্ঘ ২৫ বছর ব্যাপী সভা-সমিতি, গণআন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আপামর মানুষের যে আশা আকাঙ্ক্ষা ও দাবি দাওয়া সোচ্চারিত হয়ে উঠেছে, যে আশা আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের জনগণ নিরবিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করেছেন, ক্ষমতা দর্পী শাসকদের নিকট আত্মসমর্পণ না করে আত্মাহুতি দিয়েছেন, সে আদর্শ এবং আশা আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই খসড়া সংবিধান রচিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক অধিকারের জন্য জনগণের সংগ্রামের আলোকেই এই খসড়া সংবিধান প্রণীত হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, গণপরিষদের অধিবেশনে খসড়া সংবিধানের বিলটি অবিলম্বে বিবেচনার্থে গ্রহণের জন্য সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন প্রস্তাব উত্থাপন করলে পরিষদে একমাত্র বিরোধী সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বিলটি জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রচার করার দাবি জানিয়ে পরিষদে একটি প্রস্তাব আনয়ন করেন। পরিষদের সহকারী নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম শ্রী সেনগুপ্তের প্রস্তাবটির বিরোধীতা করে পরিষদে ভাষণদানকালে উপরোক্ত বক্তব্য রাখেন। পূর্বাহ্নে ড. কামাল হোসেন শ্রী সেনগুপ্তকে তার প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই প্রসঙ্গে তার ভাষণে আরো বলেন যে, জনগণ গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ করতে চান। একনায়কত্ব জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরো বলেন যে, নির্বাচনের সময় তার দল সংবিধানে যে পরিকল্পনা ও রূপরেখা পেশ করেছিলেন, জনগণ তার পক্ষেই রায় দিয়েছিল। চারটি মৌলিক আদর্শ, যথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার জন্য জনগণের ম্যান্ডেট তার দল লাভ করেছে। অতএব এর নীতির ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করার অধিকার এই পরিষদের রয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, জনগণের এই আশা আকাঙ্ক্ষা যথা এই চারটি মৌলিক আদর্শ যাতে সংবিধানে প্রতিফলিত হয়, সেই ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সর্বদাই সচেতন ছিল। এবং এই আদর্শকে সামনে রেখেই এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই চারটি মৌলিক আদর্শকে সামনে নিয়েই তার দল স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল এবং বাংলাদেশের জনগণও এই আদর্শের সমর্থনেই স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বিপ্লবী সরকারের আহ্বানে ঘরে ঘরে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলেছিল, আত্মাহুতি দিয়েছিল, অতএব স্বীকৃত জনমতের ভিত্তিতেই এই সংবিধান রচিত হয়েছে। বিরোধী সদস্য শ্রী সেনগুপ্তের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন যে, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল সমূহের মতামত এই চারটি আদর্শের ব্যাপারে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যারা এই চারটি মৌলিক আদশের বিরোধী তারা জনমতের প্রতিধ্বনি করে না। এমতাবস্থায় সংবিধান প্রণয়নে বিলম্ব করলে শ্রী সেনগুপ্তের আশঙ্কা অনুযায়ী চক্রান্তকারীগণকেই সুযোগ দান করা হবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম খসড়া সংবিধানের প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত ক্ষমতা সমর্থন করে বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা উল্লেখ করে বলেন যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্ট বাতিলের পর ব্যাপক জাতীয়করণের পক্ষে নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করেছিলেন। কোনো কোনো সময় জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন অনুভূত হলে। তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা থাকা দরকার। সৈয়দ সাহেব এই পর্যায়ে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি গণতন্ত্রের বিষয় উল্লেখ করে বলেন যে, এ পদ্ধতিতে একনায়কত্বে আশঙ্কা থাকে বলেই সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, সংবিধানের পাতায় পাতায় জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি রয়েছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সংসদই দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করবেন। মন্ত্রীপরিষদ সংসদের নিকট দায়ী থাকবেন। তিনি বলেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি সীমা নির্ধারণের জন্য সংসদকে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশেও এ দৃষ্টান্ত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন যে, ভবিষ্যতে আইন প্রণেতাগণ পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমা নির্ধারণ সূচক আইন প্রণয়ন করতে পারবেন। সংসদীয় গণতন্ত্রকে যারা বুর্জোয়া গণতন্ত্র বলে অভিহিত করে থাকেন, তাদেরকে বাংলার ইতিহাস পাঠ করার আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে জমিদারগণ লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা সত্বেও বাংলার জনগণ প্রজাস্বত্ব আইনের পক্ষে শেরে বাংলা এবং তার দলকে ভোট দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালেও জনগণ প্রগতির দিকে তাদের রায় ঘোষণা করেছিল। তিনি এই প্রসঙ্গে শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, তাতে লজ্জার কিছু নাই। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোনো জমিদার পরিবারের সন্তান নয়, এজন্য পরিষদের সদস্যগণ গর্ববোধ করতে পারেন। তিনি বলেন যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্রের উত্তরণ সম্ভব হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোস্লাভিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, এসব সমাজতান্ত্রিক দেশেও জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আরো বলেন যে, গত ২৫ বছরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরও পাকিস্তানি আমলে যেখানে কোনো সংবিধান দিতে পারে নাই, সেই স্থলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সংবিধান প্রদান করায় সমালোচনার পরিবর্তে আমাদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা উচিত। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার সুদীর্ঘ ভাষণে সংবিধানের চারটি মৌলিক আদর্শ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক পটভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে দিল্লির মুঘল পাঠানদের বিরুদ্ধে বাঙালির বীরত্বমূলক মুক্তি আন্দোলনের এবং পাকিস্তাল আমলে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ধর্মের নামে অত্যাচার-নিপীড়নের ইতিহাস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, সংবিধান জনগণের সুখ সমৃদ্ধি আনবে কিনা, তা এ সংবিধানের অধীনে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপরই নির্ভর করবে। এছাড়া ড. কামাল হোসেনের প্রস্তাবের সমর্থনে আরো কয়েকজন সদস্য বক্তৃতা করেন।৭৯
রেফারেন্স: ১৯ অক্টোবর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ