খসড়া সংবিধান ও মতামত
খসড়া সংবিধান জনসাধারণ্যে প্রকাশের পর থেকে দলমত নির্বিশেষে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ এবং আইনজীবীগণ সংবিধান সম্পর্কে তাদের মতামত ব্যক্ত করা শুরু করেছেন। তাদের মতে, মানুষের দ্বারা রচিত কোনো সংবিধানই নির্ভুল নির্দোষ হতে পারে না। তাই সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনের অপেক্ষা রাখে।
খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমদ : দেশের প্রবীণতম আইনজীবী খান বাহাদূর নজির উদ্দিন আহমদ বুধবার এই প্রতিনিধির সাথে এক বিশেষ সাক্ষাতকারে খসড়া সংবিধান সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন যে, সংবিধান রচনার ওপর খুব একটি কিছু নির্ভর করে না, যারা দেশ পরিচালনা করবেন তাদের সদিচ্ছার ওপরই প্রকৃত অর্থে সবকিছু নির্ভর করে। প্রবীণতম আইনজীর খসড়া সংবিধানে বিচার বিভাগের বিধানের প্রতি আলোকপাত করে অভিযোগ করেন যে আসত। সংবিধানের সুপ্রীম কোর্টকে হাইকোর্টের একটি অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দেশে আইনের শাসন। প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তার জন্য তিনি পৃথক স্বাধীন সুপ্রীম কোর্টের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার সুপারিশ করেন। তিনি আরো বলেন যে, আইনের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাদান কিংবা হাইকোর্টে আপিলের চূড়ান্ত নিস্পত্তির জন্য সুপ্রীম কোর্ট থাকা একান্ত দরকার। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, খান বাহাদুর নজির। আহমদ ১৯৪৭-৫১ সালে ভারতের গণপরিষদ এবং পার্লামেন্টের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৩৭-৪৬ সালে সাবেক বঙ্গীয় আইন পরিষদেও একজন সদস্য ছিলেন। খসড়া সংবিধানের কয়েকটি দিক পর্যালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, জনসাধারণের হিতার্থে সরকার কর্তৃক জায়গা-জমি দখল করা হলে সংশ্লিষ্ট জমির মালিককে তার মূল্য পরিশোধ করার কোনো নিশ্চয়তা সংবিধানে নাই। এটা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন যে, খসড়া সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী পার্লামেন্টের বিরোধী দলের অস্তিত্ব এবং বিরোধী দলের নেতার পদ-মর্যাদা সম্পর্কে কিংবা বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ নাই, অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারের একটি অংশ। সমাজতান্ত্রিক বিধান সম্পর্কে তিনি বলেন যে, বড়লোকের সম্পত্তি বিনা পয়সায় হাতড়িয়ে রাষ্ট্রের হস্তগত করার মাধ্যমে গরিবেরত উপকার সম্ভব নয়। এটা দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প-কারখানা উৎপাদনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিবে। রাষ্ট্র ও নাগরিক আরো গরিব হবে। তিনি সম্পত্তি দখলের পরিবের্ত ধনী ব্যক্তিদের আয়ের ওপর অধিক কর ধার্য করার প্রস্তাব করেন। দল থেকে বহিষ্কারের পর সংসদে সদস্যপদ বাতিল হওয়ার বিধান প্রসঙ্গে খান বাহাদুর বলেন, এটা ভুল করা হবে। কারণ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের হাতে ন্যস্ত থাকা উচিত নয়। তাতে নির্বাচিত সদস্যের কাজ করার মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করার সামিল হবে। সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি যদি কোনো অন্যায় করেন তাহলে পরবর্তী নির্বাচনের সময় জনগণই তার প্রতিবিধান করতে পারবেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : গণপরিষদে একমাত্র বিরোধী সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক বিশেষ সাক্ষাতকারে খসড়া সংবিধান সম্পর্কে বলেন যে, খসড়া সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, চলা, বলা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টা হয়েছে বটে কিন্তু একহাতে দেওয়ার চেষ্টা করে আর একহাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খসড়া সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক নাতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের গ্যারান্টি হিসেবে এই দলিল অচল বলে মনে হয়। কারণ রাষ্ট্র কর্তৃক অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা এবং চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করা ছাড়া সমাজতন্ত্র হয় না। শ্রী সেন গুপ্ত খসড়া সংবিধানে সুপ্রীম কোর্টকে হাইকোর্ট রাহু গ্রাস থেকে মুক্তিদানে এবং সুপ্রীম কোর্টকে দেশের আইনের সর্বোচ্চ পীঠস্থান হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি জানান। তিনি সংসদের জন্য তিনশত সদস্য সংখ্যা। নির্ধারিত করার বিরোধীতা করেন এবং জনসংখ্যা নির্ধারণ পূর্বক আসন নির্ধারণ করার দাবি জানান। সরকারি কর্মচারীগণকে আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ না দিয়ে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করায় তাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক দল হতে বহিস্কারের পর সংসদে সদস্য পদও বাতিল হওয়ার বিধানকে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূলে কুঠারাঘাত বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, রাজনৈতিক দল সংবিধানের অঙ্গ নয় সুতরাং দলের সিদ্ধান্ত।
সংবিধানের অঙ্গ হতে পারে না। তাতে এক নায়কত্ব সৃষ্টির অবকাশ বিদ্যমান। তিনি মহিলাদের আসন সংখ্যা ২০ এবং পৌর এলাকা হতে এই ২০টি আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করার প্রস্তাব করেন। তিনি খসড়া সংবিধান সম্পর্কে দেশের বিভিন্ন স্তরের নাগরিক যাতে সংবাদপত্র মারফত তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন তজ্জন্য সময় দানের দাবি জানান।৭৫
রেফারেন্স: ১৮ অক্টোবর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ