৭ই জুনের হরতাল
দেশ ও দশের স্বার্থে শক্তিশালী কেন্দ্রের পরিবর্তে শক্তিশালী পাকিস্তান’ গঠনের কর্মসূচী ৬-দফার প্রবক্তাদের দেশরক্ষা আইনে আটকের প্রতিবাদে এবং দেশের বুক হইতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন বন্ধ, রাজবন্দীদের মুক্তি, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য হ্রাস, কর্মচ্যুৎ বিড়িশ্রমিক ও বেকারদের কর্মসংস্থান, কৃষক-শ্রমিক নির্বিশেষে সকল মানুষের সত্যিকার মুক্তিসাধন, সংবাদপত্রের ও বাকস্বাধীনতা কায়েম প্রভৃতির দাবীতে আওয়ামী লীগ আগামী ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী যে সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানাইয়াছেন তাহাকে সর্বোতভাবে সাফল্যমন্ডিত করিবার জন্য প্রদেশের গণতান্ত্রিক শিবিরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়াছে। অবশ্য মহল বিশেষ হইতে এই দিনের হরতাল বানচাল করিবার জন্য যে চেষ্টা চলিতেছে না, তাহা নহে। কিন্তু তাহাদের জারিজুরি ইতিমধ্যেই প্রকাশ হইয়া পড়ায় গণতান্ত্রিক শিবিরে এই দিনটিকে সাফল্যমন্ডিত করার সংকল্প দৃঢ়তর হইয়াছে। গত কয়েক দিনে শত শত পােষ্টার ঢাকার রাস্তাঘাট ও যানবাহন অন্ধকারে এক বিশেষ শ্রেণীর বেতনভুক্ত কর্মীদের যখন তাহা ছিড়িয়া ফেলিবার ‘ব্রত’ গ্রহণ করে তখনই উক্ত মহলবিশেষের কারসাজি ধরা পড়িয়া যায় এবং তখন হইতেই গণতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃবৃন্দ ও কর্মিগণ প্রতিপক্ষের সকল জারিজুরি বানচাল করিয়া ৭ই জুনের সাধারণ হরতালকে সাফল্যমন্ডিত করাকে মহান কর্তব্য জ্ঞান করিয়া সহযােগিতার হস্ত লইয়া আগাইয়া আসেন। এই সত্যোপলব্ধির ভিত্তিতেই প্রদেশের দূর-দূরাঞ্চলের শ্রমিক-কৃষক হইতে শুরু করিয়া সকল মহলই ৭ই জুনের হরতালের মধ্য দিয়া দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার প্রশ্নে প্রদেশবাসীর সুস্পষ্ট রায় জানাইয়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থার মুখপাত্রগণ ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের সহিত সহগযােগিতাক্রমে ৭ই জুনের হরতাল সাফল্যমন্ডিত করার ব্যপারে আগাইয়া আসিয়াছেন। অনেকে আবার বিবৃতির মাধ্যমেও এই দিনটিকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকল মহলের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন।
কর্ণফুলী কাগজ কল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান লেবার ফেডারেশনের সহ-সভাপতি আগামী ৭ই জুনের হরতালের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়াছেন। সকল প্রকারে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হইয়া স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে এই হরতালকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য তিনি প্রদেশের শ্রমিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন।
জনাব মকবুল হােসেন সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে গতকাল বলেন যে, ৬-দফার মধ্য দিয়াই জনসাধারণ যাবতীয় শােষণের হাত হইতে অব্যাহতি কামনা করিতেছে; কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাইতেছে যে, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না করিয়া সরকার আবার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরিয়া দেওয়ার ও অন্যান্যভাবে নির্যাতনের পথ বাছিয়া নিয়াছেন। এই পটভূমিকায় আগামী ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী যে সাধারণ হরতাল আহ্বান করা হইয়াছে সকল স্তরের মানুষ তাকে স্বাগতম জানাইয়াছে।
পূর্ব পাক বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন
আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহূত ৭ই জুনের হরতালকে সাফল্যমিন্ডত করিয়া তােলার। জন্য সকল শ্রেণীর শ্রমিক ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাইয়া পূর্ব পাকিস্তান। বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জনাব নুরুল ইসলাম গতকল্য (শুক্রবার) সংবাদত্রে এক বিবৃতি দিয়াছেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, ঐতিহাসিক ৬-দফা যখন সকল শ্রেণীর মানুষের সমর্থন লাভ করিতেছে, ঠিক সেই মুহুর্তে ৬-দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাকে গেফতারের প্রতিবাদে এবং অন্যান্য বহুবিধ দাবীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আগামী ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী সাধারণ হরতাল পালনের যে আহ্বান জানাইয়াছেন তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন রহিয়াছে।
পরিশেষে তিনি আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহুত ৭ই জুনের হরতাল দিবসকে সাফল্যমন্ডিত করিয়া তােলার জন্য সকল স্তরের মানুষকে বিশেষ করিয়া শ্রমিকদের এই হরতালকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য দলমত নির্বিশেষে প্রদেশের। সকল শ্রেণীর জনগণের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন।
বিবৃতিতে তাঁহারা বলেনঃ “পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম, লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক শাসন অর্জন, রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন বন্ধ করা, কৃষক-শ্রমিকমধ্যবিত্ত নির্বিশেষে শােষিত জনগণের মুক্তিসাধন, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সমস্যার সমাধান, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের ও বাক-স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং রাজবন্দীদের মুক্তি প্রভৃতি দাবিতে উক্ত হরতাল আহ্বান করা হইয়াছে। এই দাবীগুলি কোন দলবিশেষের নয়, বরং দেশের শােষিত ও নির্যাতিত কোটি কোটি মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নের সঙ্গে উহা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। সুতরাং যেসব দাবীদাওয়ার সঙ্গে সকল সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত তাহার বাস্তবায়নের জন্য যে কোন গণ-আন্দোলনকে সাফল্যমন্ডিত করার দায়িত্ব কোন দেশপ্রেমিক নাগরিক অস্বীকার করিতে পারে না। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সােস্যালিষ্ট পার্টি আশা করে যে, ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির নীতিতে বিশ্বাসী সকল দল ও সকল শ্রেণীর জনগণ আগামী ৭ই জুনের হরতালকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য আগাইয়া আসিবেন।
কমলাপুর আওয়ামী লীগ
গতকাল কমলাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কর্মীরা ৭ই জুনের হরতালের সমর্থনে আগামী ১লা জুন হইতে পথসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত করে। জনাব এম, এ জলিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
রেফারেন্স: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ মে ১৯৬৬