শেখ মুজিবের নেতৃত্ব
পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আট-দফা মানিয়া লইয়াছে বলিয়া তারা বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করিয়াছি স্থায়ী অৰ্ব্বাচীনের মত কথা বলেন। “আওয়ামী লীগের সদস্যদের প্রকার বিভক্তি দ্বিধাবিভক্তি ন্যাপ সদস্যদের মত কোন আদর্শগত রােধ নহে।”
পি ডি এমপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা ও পূর্ব পাকিস্তান পিডিএম-এর সভাপতি জনাব আবদুস সালাম খান ১৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকে ৬-দফা সমর্থক আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কারের আলােচনা সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে উপরােক্ত মন্ত ব্য করেন।
এই সংক্রান্ত সংবাদের প্রথমাংশ গতকল্যকার আজাদে প্রকাশিত হইয়াছে।
আবদুস সালাম খান
পি ডি এমপন্থী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশন উদ্বোধন প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান পি ডি এম-এর সভাপতি জনাব আবদুস সালাম খান বলেন যে, কতিপয় আওয়ামী লীগ (ছয়-দফাপন্থী) সদস্য সম্প্রতি এমন কতিপয় আওয়ামী লীগ সদস্যকে(পিডিএমপন্থী) বিভিন্ন সময় মেয়াদের জন্য বহিস্কার করিয়াছেন যাহারা বয়সে প্রবীণ, তাহাদের আওয়ামী লীগ প্রীতি বিভিন্ন অগ্নিপরীক্ষায় পরীক্ষিত এবং যাদের দেশপ্রেম সন্দেহাতীত। ওসব বহিষ্কৃত নেতা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দান করিতে গিয়া বারবার কারাবরণ করিয়াছেন, নির্যাতিত হইয়াছেন। তাহার বয়সে বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠতর।
এই প্রসঙ্গে জনাব সালাম খান ৬-দফাপন্থী আওয়ামী লীগ কর্তৃক বহিস্কৃত আওয়ামী নেতাদের সংগ্রামী জীবনের পরিচিতি প্রদান করেন।
জনাব আবদুস সালাম খান আওয়ামী লীগের বর্তমান ভিত্তির কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন যে, ন্যাপ দলীয় সদস্য-আদর্শগত দ্বন্দ্বে যেরূপ নিজেদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যকার বিভক্তি তেমন কোন আদর্শগত বিরােধ নহে। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, আদর্শবাদের দ্বন্দ্বে ন্যাপ দলীয় সদস্যগণ পিকিংপন্থী ও মস্কোপন্থী এই দুই দলে বিভক্ত। আওয়ামী লীগের সদস্যগণ বিদেশী প্রভাবমুক্ত, তাহাদের স্থীমান দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি ছয়-দফার ব্যাখ্যা কেন্দ্র করিয়া সৃষ্ট বলিয়া জনাব সালাম খান ইঙ্গিত প্রদান করেন।
তিনি বলেন, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আট-দফা বলিয়া লইয়াছে বলিয়া যাহারা বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করিয়াছি তাহারা অর্বাচীনের মতাে কথা বলিয়াছেন। কেননা নেতৃত্ব কখনাে চ্যালেঞ্জ করা যায় না।, নেতৃত্ব অবিনশ্বর- বিবৃতি প্রদান উহার ক্ষতি সাধন করা যায় ইহা বরং, যাহারা আজ আমাদিগকে আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কার করিয়াছেন তাহারাই শেখ মুজিবরের নাম ভাঙ্গাইয়া ছয়-দফার ভুল ব্যাখ্যা করিয়া নেতৃত্ব টিকাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিতেছেন।
তিনি বলেন, কোন রাজনৈতিক দলের কোন কর্মসূচী বা প্রােগ্রামই অপরিবর্তনীয় বা অলংঘনীয় নহে—এই কথা মিথ্যা। শেখ মুজিবর রহমানও ছয়দফাকে চূড়ান্ত সমাধান বলিয়া জাহির করেন নাই। এইখানে অনুষ্ঠিত ১৯৬৬ সালের কাউন্সিল অধিবশেনে তিনি বলিয়াছিলেন ছয়-দফা অপেক্ষা কোন সুষ্ঠুতর বিকল্প প্রস্তাব কেউ দিতে পারিলে তিনি তাহা মানিয়া লইবেন।
তিনি বলেন যে, একসময় আমারা বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত সংগ্রামের পর্যায় শেষ হইয়া গিয়াছে, নেতৃত্ব শিথিল হইয়া পড়িয়াছে। এবং উহার একার পক্ষে সমগ্র জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করা সম্ভব নহে। সেই হেতু আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সহিত মিলিত হইয়া বহু সংগ্রামের পর তাহাদের দ্বারা ছয়-দফাকে প্রকারান্তরে স্বীকার করাইয়া আট-দফা কর্মসূচী প্রনয়ন করাইয়াছি। ইহা আওয়ামী লীগের জন্য পরম বিজয় ও আওয়ামী লীগ দৃঢ়তর হইয়াছে।
আট-দফাকে একটি গৌরবময় দলিল হিসাবে উল্লেখ করিয়া জনাব সালাম খান নিজের আইনজ্ঞজ্ঞানের প্রেক্ষিতে বলেন যে, আট-দফা দাবী কাৰ্য্যকরী করা হইলে পূর্ব পাকিস্তান নিজেই নিজের দাবী বুঝিয়া লইতে পারিবে।
তিনি বলেন, “পিডিএম-এ যােগদান করিয়া আওয়ামী লীগকে বিক্রয় করা হয় নাই। বন্ধুরা (ছয়-দফাপন্থী) ভুল বুঝিলে কি করিতে পারে। জানি না প্রথমদিকে কার্যকরী পরিষদের পঁচিশ জন সদস্যের মধ্যে ২৩ জন মত দিয়াও কেন কাহার নেপথ্য নির্দেশ অমত করিয়াছেন। আমাদের মধ্যে যাহারা সংগ্রাম করিতে চান না তাঁহারাই হাত উঠাইয়া বলেন, “আমরা পিছাইয়া যাইব না।”
জনাব সালাম খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অপরাপর বৈষম্যের সৃষ্টির তীব্র সমালােচনা করিয়া ১৯৫৮ সালের পর এ পর্যন্ত জাতীয় অর্থ ও বৈদেশিক মুদ্রা এ যাবৎ পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে কত ব্যয় করা হইয়াছে উহার একটি হিসাব বর্তমান সরকারের নিকট দাবী করেন। তিনি এই মৰ্ম্মে ইঙ্গিত প্রদান করেন যে, বর্তমান সরকারের শাসনকালেই দুই প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাইয়াছে।
মওলানা তর্কবাগীশ
অধিবেশনের সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ বলেন যে, মর্তানৈক্য হইলেও তিনি আওয়ামী লীগের দুই বিভক্ত দলের মধ্যে একটি সমঝােতা ও আপােষ রক্ষা হইবে বলিয়া আশা করিয়াছিলেন। কিন্তু একদল আওয়ামী লীগ সদস্য “ঔদ্ধত্য ” সহকারে আমাদিগকে বহিষ্কার করিয়াছে।
“মনে হয় ক্ষমতা থাকিলে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইত।” তিনি বলেন, “কিন্তু আমাদের দুয়ার সকলের জন্য খােলা।”
তিনি বলেন যে, পিডিএম গঠন করা হইলেও, উহার কোন অমঙ্গল নিজের নীতি বিসর্জন দেয় নাই যেমন আওয়ামী লীগও দেয় নাই।
মুজিবর রহমান
পিডিএম-পন্থী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহীর জনাব মুজিবর রহমান স্বীয় রিপাের্টে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের যােগদানের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং ছয়-দফা ও আটদফার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, “পিডিএম-এর আট-দফার মধ্যে ছয়-দফার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, “পিডিএম-এর আট-দফার মধ্যে ছয়-দফার সব দফাসহ অতিরিক্ত এমন কয়টি দফা আছে যাহা পূর্ব পাকিস্ত নীদের স্বার্থের পরিপূরক। রিপাের্টদান শেষে তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে আমরা ভাঙ্গন সৃষ্টি করি নাই।
তিনি অভিযােগ করেন যে, রাওয়ালপিন্ডির কোন একজন উজীরের (বর্তমান সরকারের) সাহায্যপুষ্ট ব্যক্তিদের সহায়তায় একটি পালটা “পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের ষড়যন্ত্র” চলিতেছে।
জহিরুদ্দীন
অধিবেশনে, পিডিএম-পন্থী পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জহিরুদ্দীন বলেন, তিনি মনে করেন না যে, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (পিডিএম) আট-দফার মধ্যে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা দাবী সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান। কেননা কোনও রাজনৈতিক দলই নিজেদের কর্মসূচী বিসর্জন দিয়া ছয়দফা সৰ্বাংশে গ্রহণ করিতে পারে না।
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, পিডিএম সম্পর্কে কিছুসংখ্যক আওয়ামী লীগ সদস্যদের মধ্যে যে ভ্রান্তধারণার সৃষ্টি হইয়াছে তাহা দূর হইয়া যাইবে।
ইহা ছাড়া অধিবেশনে বরিশালের জনাব লকিতুল্লাহ, কুষ্টিয়ার জনাব সাদ আহমদ, মােমেনশাহীর জুলমত আলী প্রমুখও বক্তৃতা করেন।
রেফারেন্স: আজাদ, ১৭ অক্টোবর ১৯৬৬