কৃষি সেমিনারে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
ময়মনসিংহ। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম আজ এখানে বলেন যে, আগামি ৩ বছরের মধ্যে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকার সর্ব প্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে প্রাকৃতিক অবস্থা, বিশেষ করে আবহাওয়ার ওপরই সরকারের এই প্রচেষ্টার সাফল্য নির্ভর করছে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি এবং কৃষি শিক্ষানীতি সংক্রান্ত চারদিনব্যাপী আয়োজিত এক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। এই অধিবেশনে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কাজী এম, এফ, রহিমও ভাষণদান করেন। সেমিনারে অংশগ্রহণকারী ডজনাধিক বিদেশি প্রতিনিধিসহ শতাধিক ব্যক্তি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই উপলক্ষে প্রেরিত এক বাণীতে সেমিনারের সাফল্য কামনা করেন। বাণীতে রাষ্ট্রপ্রধান সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ে তোলার ব্যাপারে দেশের কৃষি এবং কৃষকদের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি সরকারের কৃষি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ বা পরামর্শ দানের মাধ্যমে সরকারের সাথে সহযোগিতা করার জন্য কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানান। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তার ভাষণে কঠোর পরিশ্রম করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই যতশীঘ্র সম্ভব বিদেশ হতে চাউল ও গম আমদানির প্রয়োজনীয়তার অবসান করতে হবে এবং আবাদযোগ্য জমিতে ফসল উৎপাদন করতে হবে। সবুজ বিপ্লব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিপ্লব ঘটানো এবং তার সাফল্যের ওপরই জাতির ভবিষৎ নির্ভর করবে। তাকে কেবল সরকারের একক প্রচেষ্টায় তা সফল হবে না। জনগণ এবং সরকারের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হতে পারে না। তিনি কৃষি পরিকল্পনাকে গণমুখী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ প্রসঙ্গে বলেন যে, এই পরিকল্পনায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং জনগণের অংশগ্রহণের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিনি বলেন চাষাবাদের নতুন কলাকৌশল অবলম্বনে আমাদের দেশের কৃষকগণ পিছনে পড়ে থাকবেন না বলে আমার বিশ্বাস রয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, সরকার সবুজ বিপ্লবকে একটি গণভিত্তিক বিপ্লবে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে। বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা কেবল সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নের মাধ্যমেই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। তিনি বলেন, কৃষি শিক্ষা এবং কৃষি প্রশাসন উভয়েই গণমুখী হবে। দেশের কৃষকগণ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেইসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশেষজ্ঞদের প্রতি আহ্বান জানান। সরকার কর্তৃক কৃষক প্রতিনিধি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে গঠিত কৃষি কমিটির কথা উল্লেখ প্রসঙ্গে তিনি আশা করেন যে, কৃষকদের এসব প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞগণ তাদের সমৃদ্ধশালী ভবিষৎ রচনা করতে সক্ষম হবেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের খাদ্য ঘাটতিপূরণ এবং দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টার উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধু কৃষিকে অগ্রাধীকার দান করেছেন। তিনি আরো বলেন, সরকার দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য আর বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর থাকতে চান না। আমাদের মাটি হতেই আমাদের খাদ্য আহরণ করতে হবে। তিনি কৃষি পরিকল্পনা রচনার বেলায় মাটির সাথে সম্পৃক্ত মানুষের বিষয় মনে রাখার জন্য পরিকল্পনাবিদদের প্রতি আহ্বান জানান। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার দুইটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বদান করেছেন। একটি পাটের ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা এবং অপরটি বন্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা। তিনি এই প্রসঙ্গে কঠোর সর্তকবাণী উচ্চারণ করে বলেন, চাষিদের ন্যায্য মূল্যদানে বঞ্চিত করলে কাউকেও ক্ষমা করা হবে না। তিনি আরো জানান যে, ব্যাপক পাট উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পাটের আঁশের উন্নয়নের মাধ্যমে পাট চাষিদের আয় বৃদ্ধি করার জন্য সরকার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিনি জানান যে, চলতি সালে ২৪শত গভীর নলকূপ, ৪ সহস্র অগভীর নলকূপ এবং ৩৫ শত শক্তি চালিত পাম্প স্থাপন করা হবে। এর ফলে আরো ২০ লক্ষ একর জমিতে ইরি এবং বোরো ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে। এতে দেশে চলতি বছর ১ কোটি ২৪ লক্ষ টন ধান উৎপাদন করা যাবে। তিনি আরো জানান যে, ১৯৭৪-৭৫ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে এ সময়ের মধ্যে দেশে ১ কোটি ৪৩ লক্ষ টন খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। পূর্বাহ্নে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী এখানে আগমন করলে তাকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। পুলিশবাহিনীর একটি অংশ তাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন : আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তার ভাষণে সোনার বাংলা গঠনের মাধ্যমে বঙ্গন্ধুর স্বপ্ন সার্থক করার জন্য মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে নবযুগের সূচনা করার উদ্দেশ্যে একটি নীতি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এই সেমিনারের আলোচনাও সিদ্ধান্ত সহায়ক এই বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার ভাষণে কৃষিখাতে একটি সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ এবং দেশের প্রয়োজনীয়তা ও সঠিক চাহিদা নিরূপণের জন্য আহবান জানান।১৩
রেফারেন্স: ৫ আগস্ট ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ