কাদের সিদ্দিকী কি করছেন | শাহরিয়ার কবির | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৩ মে ১৯৮০
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন এবং আওয়ামী লীগ বাকশালের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার বিশিষ্ট সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভা গঠিত হয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সমন্বয়ে। আওয়ামী লীগের দুই শতাধিক সংসদ সদস্য নতুন সরকারকে সমর্থন জানান। তবে আওয়ামী লীগের সকল নেতা যে এই পরিবর্তনকে মেনে নেয়নি তার প্রমাণ কিছুদিন পরেই পাওয়া গেল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান জিল্লুর রহমান, তোফায়েল ও রাজ্জাক সহ কয়েকজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা কারারুদ্ধ হন এবং বেশ কিছু সংখ্যক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান। শেষোক্ত ওদের ভেতর যার নাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার ফলে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে তিনি হলেন কাদের সিদ্দিকী। তখন ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবাংলার সংবাদপত্রের কাদের সিদ্দিকীর ভাষণ বিবৃতি ও বিভিন্ন তৎপরতার কথা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হতো। তাকেই এদেশের প্রধান নেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো বলা হতো এশিয়ার ক্যাস্ট্রো।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের তরুণ ছাত্রনেতা কাদের সিদ্দিকীর নাম প্রথম শোনা যায়, যিনি অতি অল্প সময়ে এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন যা ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে পরিচিত ছিল। নামটি ভারতীয় বেতারকেন্দ্র থেকেই বেশি শোনা যেতো। এর সঙ্গে বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্বের যোগাযোগ ছিল না। কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধোত্তর কার্যকলাপ যদিও বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন কারণে, তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী ক্ষমতাভিত্তি ছিল এই কাদেরিয়া বাহিনী। বিশেষ করে সাধারন মানুষ মনে করত ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এর জন্ম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাদের সিদ্দিকী রাজনীতির মঞ্চে প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নি। জাঁকজমক করে অস্ত্র জমা দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে নিরব হয়ে গেলেন কাদের সিদ্দিকী। তার বাহিনীর অনেকে রক্ষী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন, অনেকে ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে গেলেন। কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব সেইসময় পালন করেননি, ব্যাপক পরিচিতি থাকা শর্তে নির্বাচনে দাঁড়াননি এবং যুবলীগের সহসভাপতি হওয়া সত্ত্বেও কার্যতঃ তাকে নীরবই দেখা গেল। তাঁর এই নীরবতা তাকে ক্রমশ বিস্মৃতির গর্ভে ঠেলে দিচ্ছিল। হঠাৎ করেই তার নাম শোনা গেল বাকশাল হওয়ার পর টাঙ্গাইলের গভর্নর হিসেবে তাকে নিযুক্ত করার মাধ্যমে। তার পরেই ঘটল ১৫ আগস্ট এর ঘটনাবলী এবং আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে অতিক্রম করে কাদের সিদ্দিকী সংবাদপত্রের শিরোনামে পরিণত হলেন।
কাদের সিদ্দিকীঃ সংবাদপত্রে
বিচিত্রার জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহের কাজে যখন গত ২২ এপ্রিল ‘৮০ তারিখে কলকাতা যাই। কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শেখ মুজিবের পরিবারের একজন সদস্যের সঙ্গে যিনি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন এবং ১৫ আগস্টের পর যিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশ তাদের সম্পর্কে অপপ্রচার খুব বেশি হয়েছে। জানতে চাইলেন তাদের সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভব কিনা। তথ্য পেলে সম্ভব হতে পারে এটা জেনে তিনি কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেন।
আওয়ামী লীগের নেত্রীস্থানীয় ব্যক্তিরা যারা ‘৭৫ এর পর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন তারা মোটামুটি বহাল তবিয়তেই সেখানে অবস্থান করছেন। অনেকে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন, অনেকে স্থানীয়ভাবে ব্যবসাও করছেন। অবশ্য বেশ কিছু সংখ্যক কর্মী রয়েছেন যাদের অবস্থা খুব শোচনীয়, কায়ক্লেশে দিনযাপন করছেন। এদের অনেকে দেখলাম সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর যথেষ্ট বিক্ষুব্ধ, কোন কোন ক্ষেত্রে কাদের সিদ্দিকীর উপরও। যারা অভিযোগ করলেন নেতারা যদিও এখনও ভারত সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন, কর্মীরা দীর্ঘদিন যাবত সেই ভাতা থেকে বঞ্চিত।
১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এদের প্রতি কিছুটা কঠোর মনোভাব অবলম্বন করেন। তার আগে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এদের প্রতি যথেষ্ঠ সদয় ছিলেন, নেতাদের তো বটেই এমনকি কর্মীদেরও পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাতা দিতেন। মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে নেতা এবং কর্মী সবার ভাতাই হয় বহুলাংশে কমিয়ে দেন, না হয় একেবারে বন্ধ করে দেন। এমনকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে অধিকাংশকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন। আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ কর্মীদের অভিযোগ হচ্ছে -নেতারা মোরারজি দেশাইর সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হয়েছেন, জনতা পার্টি সরকারে থাকা সত্বেও তারা ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করেছেন, যার ফলে মোরারজি দেশাই বিরক্ত হয়েছেন। কর্মীদের কেউ কেউ এখনো অভিযোগ করলেন যে জনতা সরকারের আমলে নেতাদের কেউ নাকি ইন্দিরার হয়ে কাজও করেছেন।
আওয়ামী লীগ কর্মীদের অভিযোগ সঠিক নয় এটা মনে করার কোন কারণ নেই। তবে ভারতের রাজনৈতিক মহল মনে করেন যেহেতু মোরারজি দেশাই জনতা সরকার বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী ছিলেন সেই কারণে তারা আওয়ামী লীগের প্রবাসী রাজনৈতিক নেতাদের কার্যকলাপের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন।
দিল্লি থেকে এক্সপ্রেস নিউজের সার্ভিস গত ২৬ নভেম্বর এই মর্মে এক সংবাদ পরিবেশন করে -‘বাংলাদেশের বিদ্রোহী নেতা ‘টাইগার’কাদের সিদ্দিকীকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যে বাংলাদেশের কোন শরণার্থীকে এদেশে অবস্থানকালে কোনো রকম রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের বিদ্রোহী নেতা যখন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তখন এ কথা তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয়। তারা তাকে বলেন যে সরকার অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি কঠোরভাবে অবলম্বন করছে এবং এই কারণে কোনো স্বর্ণা থেকেই ভারতের মাটিতে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না।
উক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, -‘টাইগার’ সেদিকে গত বেশ কিছুদিন যাবৎ দিল্লিতে থেকে বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার দলিত হচ্ছে বলে প্রচার চালাচ্ছেন। প্রথমে মনে হয়েছিল সরকারের প্রধান নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন না, কিন্তু তিনি সবাইকে বিস্মিত করে শুধু প্রধানমন্ত্রী আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেন নি, উপরন্তু জনতার সর্বোচ্চ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যাদের ভেতর রয়েছেন মিঃ চন্দ্রশেখর, মিঃ মধুলিমায়ে এবং মিঃ রবি রায়।
‘প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই কারণে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, তারা তাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন ভারত সরকার বিদেশিদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো রকম রাজনৈতিক তৎপরতাকে উৎসাহিত করবে না।’
‘আশা করা গিয়েছিল এসব কথা বলার পর ‘টাইগার’সেদিকে এমন কোনো বিবৃতি দেবেন না যা রাজনৈতিক তৎপরতার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু এরপর তাঁর প্রথম বিবৃতি ছিল অত্যন্ত রাজনৈতিক। তিনি বলেছেন যে,’প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অপসারিত হওয়ার পথে।’
‘এ নিয়ে এখানে বিতর্কের সূচনা হয়েছে যে, সরকার যখন অপর দেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এর বিরুদ্ধে তখনই তাদের উচিত হয়েছে কিনা ‘টাইগার’ সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করার। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে যখন কোনো নেতা তার দেশের মানবাধিকার জন্য কথা বলছেন তখন তাঁর বক্তব্য শুনতে অস্বীকার করা উচিত নয়।’
মোরারজি দেশাই এর সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর উপরোক্ত আলোচনার পর তার তৎপরতায় স্বাভাবিকভাবেই ভাটা পড়ে। ময়মনসিংহের উত্তরে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে তাদের যে প্রধান ঘাঁটি ছিল সেটি অবশ্য গত নভেম্বরের আগেই তুলে দিতে হয়েছিল। কাদের সিদ্দিকী এরপর প্রকাশ্যে বিবৃতি এবং উপস্থিতি থেকে বিরত থাকেন। তিনি কোথায় থাকেন তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানেন না। এরপর থেকে একরকম আত্মগোপন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি পশ্চিমবাংলার বর্ধিষ্ণু জেলা শহরে। মাঝে মাঝে দিল্লি যান সরকারি নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য। এছাড়া অন্য কোন তৎপরতার সংবাদ পাইনি।
মোরারজি দেশাইর আগে যখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ছিল তখন কাদের সিদ্দিকীর ব্যাপক তৎপরতা বাংলাদেশের সবাই মোটামুটি জানেন। বাংলাদেশের সীমান্তের বিভিন্ন ফাঁড়ি আক্রমণ করেছেন তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায়। কমলাকান্দা, দুর্গাপুরে, ঘোষগী প্রভৃতি স্থানে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে তাঁর বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। কেন এই ধরনের সংঘর্ষে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন সে বিষয়ে তিনি পরে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আলোচনা করেছেন।
কাদের সিদ্দিকী কি গত সাড়ে চার বছরে একবারও বাংলাদেশে আসেন নি? যদিও তিনি আমাকে বলেছেন তাঁর সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতেই এবং তাঁদের ঘাঁটিও ছিল বাংলাদেশ তবুও তিনি ঢাকায় এসেছিলেন কিনা এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তার একজন অনুগামী বলেছেন,’স্যার একাধিকবার ঢাকা গেছেন এবং আত্মগোপন অবস্থাতেই গেছেন’।
কলকাতার দৈনিক বসুমতি এবং চমকপ্রদ তথ্য দিচ্ছে। গত ৮ এপ্রিল ‘৮০ ও তারিখের দৈনিক বসুমতি প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষে রিভার্স হেডিং -এ (কালোর ভেতরে সাদা হরফের শিরোনাম) লিখলো ‘বাংলাদেশে রাজনীতিতে চমক -বাঘা সিদ্দিকীর আত্মপ্রকাশ।’ ঢাকা থেকে জনৈক মোল্লা ওয়াজেদ আলী প্রেরিত এই সংবাদটি হুবহু উদ্ধৃত করছি।
‘মুক্তি সংগ্রামের অনন্য সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাদের সিদ্দিকী ওরফে বাঘা সিদ্দিকী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আত্মপ্রকাশ করেছেন বলে ঢাকার রবিবাসরীয় সাপ্তাহিক ‘খবর’ পত্রিকার সতের মার্চ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয় তা নিয়ে সারা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
‘সরকারি বাজা দলের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে এই সংবাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয় বিষয়। বাজা দল কর্মী মহলে বলতে শোনা যায়ঃ বাঘা সিদ্দিকী বাংলাদেশে ঢুকতেই পারে না। খবরটি আজগুবি। অপরদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মহলে আরেক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। আওয়ামী লীগের মালেক গোষ্ঠী দাবি করেনঃ কাদের সিদ্দিকী -আমাদের গোষ্ঠীতে থেকে তিনি আমাদের দলের নেতৃত্ব করবেন। মিজান গোষ্ঠী দাবি করছেনঃ বাঘা সিদ্দিকী আমাদের নেতা।
‘যে যাই বলুন না কেন বাঘা সিদ্দিকী কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তা তিনি নিজেই প্রকাশ করেননি। ঢাকার খবর পত্রিকার প্রতিবেদকের সূত্র থেকে জানা গেছে কাদের সিদ্দিকী সদলবলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন তবে তিনি কোথায় অবস্থান করছেন বা ঘাঁটি গেড়েছেন তা ঐ প্রতিবেদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
‘অসমর্থিত সূত্রে প্রকাশ, কাদের সিদ্দিকী বর্তমানে চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলের দলবল নিয়ে অবস্থান করছেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। কবে নাগাদ তিনি রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্য কোথাও আত্মপ্রকাশ করবেন ওই সূত্রটি তা জানায়নি।
‘ কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে জনমনে এখন একটা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে, যাতে মনে হয়, তাঁর প্রতি মানুষের অগাধ বিশ্বাস এবং তাঁর প্রতি মুক্তি সংগ্রামী ও যোদ্ধাদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ও সমর্থন রয়েছে। তাঁর আত্মপ্রকাশ তাই যেন সকলেরই কাম্য।
‘আরেক অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে কাদের সিদ্দিকীর বাংলাদেশের সদলবলে উপস্থিতির সংবাদে সরকারি বাজা দলের সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। খোদ রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানকেও নাকি তার উপস্থিতির খবরে চিন্তিত করে তুলেছে।রাস্ট্রপতির ভাবনা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এবং গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও রয়েছে। কেননা বাঘা সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিশংস হত্যাকাণ্ড প্রতিশোধ নেবার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে জিয়া সরকার দাবি করেন। সেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়াগ করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাঘা সিদ্দিকী স্বদেশে ফিরে এসেছেন। তিনি দাবি জানাবেনঃ মুজিব হত্যার তদন্ত হোক, দোষী ব্যক্তিদের সাজা দেয়া হোক। আরো অনেক দাবি জানাবেন জিয়াতান্ত্রিক সরকারের কাছে।
‘ঐ সূত্র থেকে জানা গেছে, জিয়া সাহেব সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে দিকে পাঠিয়েছেন কাদের সিদ্দিকীর অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। সেনা ও নাকি কয়েক কোম্পানি মজুত রেখেছেন আশেপাশে। যদি কিছু ঘটে এমন আশঙ্কা করেই জিয়া সাহেব আটঘাট বাঁধছেন।
‘আওয়ামী লীগের মালিক গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেনঃ যা শুনেছেন তা শীঘ্রই জানতে পারবেন। আমরাও শুনেছি তিনি দোরগোড়ায় হাজির। তাই জিয়া সরকার সন্ত্রস্ত। এর বেশি তাঁরা কিছু বলেননি। এদিকে মিজান গোষ্ঠীর নেতারা বলছেনঃ বাঘা সিদ্দিকী বাংলাদেশে এসে গেছেন এবং আমাদের দলের নেতৃত্ব দেবেন।
‘রাজধানীর রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন কেবল বাঘা সিদ্দিকী এর আগমন সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা চলছে।
‘প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর বাঘা সিদ্দিকী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্ত অস্ত্র হাতে নেন। ওই সময় গুজব রটে যায় কাদের সিদ্দিকী দেশত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের স্বীকার করেন, কাদের বিদেশে আশ্রয় নিয়ে দেশের অখন্ডতা ধ্বংসের চেষ্টা করছেন।১৯৭৭ সালের ১১ আগস্ট জিয়া -মোরারজি দেশাই চুক্তিতে ভারতে অবস্থানকারী বিপথগামী বাংলাদেশীদের স্বদেশে ফিরে নেবার কথা উল্লেখ করা হয়। সেসময় বহুলোক স্বদেশে ফিরে যান। কাদের সিদ্দিকীর অন্তর্ধান রহস্যই থেকে যায়। বাংলাদেশ সরকার তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু উচ্চবাচ্য করেননি।
‘বর্তমানে কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে যে জল্পনা-কল্পনা চলছে তাতে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন যে প্রকাশ্য রাজনীতিতে কাদের সিদ্দিকী আত্মপ্রকাশ করলে দেশবাসী তাকে বঙ্গবীর হিসেবে ফের সম্মান দেবেন। এবং দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশবাসী তার উপর নেতৃত্ব আরোপ করতেও দ্বিধা সংকোচ করবে না।
‘এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর বাংলাদেশ উপস্থিতি সম্পর্কে সরকারিভাবে কোনো ঘোষণা বা সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়নি। তবে বাজা দলের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের কাছে বিশেষ করে ময়মনসিংহের বাজা দল কর্মীদের নাকি নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে।’
‘দৈনিক বসুমতির তথাকথিত ঢাকাস্থ সংবাদদাতার উপরোক্ত সংবাদটি যে নিছক চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিবেশন করা হয়েছে তাতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। এই সংবাদের সূত্রপাত হয়েছে ঢাকার একটি পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে এবং প্রায় সবটাই হচ্ছে ‘অসমর্থিত সূত্রের।’আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে খবরকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলেছেন। ৯ এপ্রিল, বসুমতিতে তাঁর জনৈক ‘সহযোদ্ধা চৌধুরী কবির ফিরোজ’ এই সংবাদের ‘তীব্র প্রতিবাদ’ জানিয়ে বলেছেন, কাদের ভাইয়া বাংলাদেশ ফিরে যাননি।….. বাংলাদেশের যে রাজত্ব চলছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানোর জন্য সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি একত্রিত করার চেষ্টা হচ্ছে।… এই আন্দোলন জোরদার করার জন্য একটি সংহতি পরিষদও গঠন করা হয়েছে।’
‘বসুমতিতে যে অজ্ঞাত নামা সাংবাদিকের বানোয়াট প্রতিবেদন ছাপা হয় শুধু তাই নয়, অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিও এই পত্রিকায় আজগুবি সব প্রতিবেদন লেখেন। এদের ভেতর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডঃ মযহারুল ইসলামও রয়েছেন। তিনি বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসরের চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন এবং বসুমতিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ নামে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভ্রান্তি কল্পকাহিনী লিখছেন।
ভারতের সংবাদপত্র অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন ‘৭১ এর যুদ্ধের সময়ও ছাপা হতো। তখন ভারতের সাধারণ মানুষ এসব সংবাদ আগ্রহ সহকারে করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনায় আপ্লুত হতেন। ‘৭১-এর পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। এখন ভারতের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের শরণার্থীদের ব্যাপারে,যারা ‘৭৫ এরপর সেখানে গিয়ে ব্যবসা ও চাকরি জুটিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন এবং সরকারি ভাতা পাচ্ছেন তাঁদের প্রতি যথেষ্ঠ বিরক্ত। এই শরণার্থীদের ব্যাপারে আমি সাধারন মানুষের প্রতিক্রিয়া যখন জানতে চেয়েছি তখন প্রত্যেকে একই ভাষায় বলেছেন, এদের উচিত বাংলাদেশে গিয়ে আন্দোলন করা। আমাদের এখানে হাজার রকমের সমস্যা রয়েছে। এরা এখানে চাকরি করছে, ব্যবসা করছে, আমাদের বেকার ছেলেরা কর্মের সংস্থান হারাচ্ছে।’
ভারতের সাধারণ মানুষের হাজার রকমের সমস্যা কি ‘৭১ সালে ছিল না? নিশ্চয়ই তখনও ছিল। কিন্তু তখন তারা বাংলাদেশের হাজারগুন লক্ষ গুণ বেশি শরণার্থীকে নিজেদের দেশে দিয়েছিলেন ঠাঁই দিয়েছিলেন, সহানুভূতির হাত বাড়িয়েছিলেন এবং সাধ্য অনুযায়ী সাহায্যও করেছেন। তখন তাঁরা এক কোটি শরণার্থীর বোঝা বহন করেছিলেন, এখন কয়েকশ’ শরণার্থীর বোঝা তাঁরা বইতে অপারগ। ‘৭১ এর পরিস্থিতি আর ‘৭৫ এর পরিস্থিতি যে এক নয় এটা ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশের শরণার্থীরা অনুধাবন করতে না পারলেও যে কোন সাধারণ মানুষেই বোঝেন। কাদের সিদ্দিকীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর জবাব শুনে মনে হলো ভারতের সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি অসচেতন নন। অথবা সচেতন হতে চান না।
‘মহামান্য’ কাদের সিদ্দিকী
কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে তিনি আমার সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন তাঁকে কথা দিতে হয়েছিল বিচিত্রায় লেখার সময় সাক্ষাতের স্থান আমি গোপন রাখবো, কারণ কাদের সিদ্দিকী আত্মগোপন অবস্থায় আছেন। তিনি আমাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন যাতে কাদের সিদ্দিকী আমাকে সাক্ষাৎ প্রদান করতে সম্মত হন। চিঠির ওপর শুধু লেখা ছিল ‘মহামান্য কাদের সিদ্দিকী’। তাঁকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম নামের সঙ্গে মহামান্য কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,’কাদের সিদ্দিকী আমাদের সর্বাধিনায়ক। তাঁর আন্ডারে আমরা ‘ওথ নিয়েছি। তার সঙ্গে এখন আমার মত পার্থক্য থাকলেও ওথ এখনো ভাঙিনি।’ এই মতপার্থক্য সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকীকে পরে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন,’এটা আমাদের নিজেদের ব্যাপার’।
কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় ২৫ এপ্রিল ‘৮০ তারিখে সকাল দশটায় । কলকাতা থেকে আড়াই ঘন্টা ট্রেনযোগে যেতে হয়েছিল। প্রচন্ড গরম তখন। তাপমাত্রা ছিল ১১০ ডিগ্রী ফারেনহাইট এর বেশি।
দোতলা বাড়ির গেটের উপর বেগুনি রংয়ের বোগেনভিলিয়ার ঝাড়। গেটে লেখা ‘বি অ্যাওয়ার অফ ডগ।’গেট খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি তিনি বারান্দায় বসে আছেন, পরনে সাদা লুঙ্গি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। আমি আসবো এ সংবাদ তিনি আগেই পেয়েছিলেন। মৃদু হেসে অভ্যর্থনা জানালেন। চিঠিখানা তাঁকে বের করে দিলাম। তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম না তিনি আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার দেবেন কিনা।
চিঠি পড়ে মৃদু হেসে কাদের সিদ্দিকী বললেন, চিঠির কোন প্রয়োজন ছিল না। আপনি এত দূর থেকে এসেছেন আপনাকে ফিরিয়ে দিতাম না। অবশ্য এখানকার পত্র-পত্রিকায় আমার শাখার আমার সাক্ষাৎকার দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে।’এরপর তিনি তার একজন সহকর্মীকে ডেকে আমার জন্য মুখ হাত ধোয়ার পানি দিতে বললেন।
আমি বললাম,’ বিচিত্রায় আগেও আপনি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন।’
তিনি হেসে বললেন,’মনে আছে বিষয় ছিল বয়স ২৫ এর নিচে। একটা ছোট খাটো ছেলে এসেছিল সাক্ষাৎকার নিতে। আপনারা ববিতা, রুনা লায়লার সঙ্গে আমার ছবি ছেপেছিলেন। সেই ছেলেটি কি এখনো বিচিত্রায় আছে ? কি যেন নাম ছিল?
‘চিন্ময় মুৎসুদ্দি’, বিচিত্রাতেই আছেন।
‘তারপর বলুন ঢাকার খবর টবর কি?
‘খবর ভালোই। এখানে তো সবই পাচ্ছেন। দশ দলের মিটিংয়ে মারা মারির খবরে দেখলাম এখনকার কাগজে ছাপা হয়েছে।’
‘ঢাকায় জিনিসপত্রের দাম খুব বেড়েছে?’
কিছুটা বাড়তির দিকে। তবে বাকশাল আমলের চেয়ে কম।’এরপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,’আপনার খবর কি বলুন। আপনার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।’
তিনি হেসে বললেন,’ বলেন কি! এখানে এসে আমার ওজন অনেক কমে গেছে। ক’দিন আগে লু হাওয়া লেগে শরীর একেবারে ধ্বসিয়ে দিয়েছে।’
বললাম,’ চুয়াত্তর সালে আপনাকে জমা দেখেছিলাম তার তুলনায় এখন আপনার স্বাস্থ্য অনেক ভালো।’
তিনি আবার বললেন ‘আপনি মুখ হাত ধুয়ে নিন। মুখে কিছুদিন। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।’
কিঞ্চিত জলযোগের পর তাঁকে বললাম,’আমরা এখন তা’হলে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করতে পারি।’আমি টেপ রেকর্ডারটি তাঁর সামনে রাখলাম।
রেকর্ডারের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ এটা বাদ দিলে হয় না?’
বললাম,’আমি টেপরেকর্ডারেই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে থাকি। হাতের নোটের চেয়ে এটা অনেক বেশি বিশ্বস্ত।’
এরপর তিনি বললেন, ‘কি ধরনের প্রশ্ন করতে চান?’
বললাম, ‘যেমন ধরুন আপনি কেন ভারতে এলেন, এখানে কী করছেন, আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা -।’
তিনি বাধা দিয়ে বললেন,’এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া যাবেনা। আমি ভারতে আছি এ কথাই বলা যাবে না। তা’ছাড়া সাংগঠনিক কোনো ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না। রাজনৈতিক ব্যাপারে যদি কোন প্রশ্ন করেন আমি উত্তর দেবো।’
‘আপনি ভারতে আছেন একথা আপনি কার কাছ থেকে গোপন রাখতে চাইছেন? বাংলাদেশ সরকার জানেন আপনি ভারতে আছেন, ভারত সরকার জানেন আপনি ভারতে আছেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজনৈতিক মহলে জানেন আপনি ভারতে, এমনকি সাধারণ মানুষও তা জানেন।’
কাদের সিদ্দিকী বললেন, ‘আমি ভারতে থেকে কোন সাক্ষাৎকার দিতে পারিনা।’
আমি হেসে বললাম, ‘সে ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি মুজিবনগরের মত কোন মুক্তাঞ্চল থেকে আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। সেটা আরো থ্রিলিং হবে।’
কাদের সিদ্দিকীও হাসলেন -‘সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে?’
আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন। কোথায় বসে আপনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছি সেটা উল্লেখ না করলেই কোন ঝামেলা থাকবে না। কিন্তু টেপে সাক্ষাৎকার দিতে আপত্তি করছেন কেন? আমার খাটুনি বাড়াতে চান?’
তিনি বললেন,’আপনার পরিশ্রম বাড়াবার জন্য আমি দুঃখিত। আমি যা বলবো আপনি নোট করে নিন। পরে যদি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য প্রয়োজন হয় আমি টিপে কিছু প্রশ্নের জবাব দেবো।’
এবার আমি বললাম, ‘আমি যে নোট করার জন্য কোন কিছুই আনিনি।’
তিনি তাঁর এক সহকর্মীকে পাঠালেন দোকান থেকে নোট বই আনার জন্য। নোট বই আনার পর তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ আরম্ভ করি। তাঁর সঙ্গে আমার একটানা ছয় ঘণ্টা আলোচনা হয়। মাঝখানে দুপুরে খাবার বিরতি ছিল আধঘন্টার মতো। আমার খাবার ব্যবস্থা তিনি তাঁর ডেরাতেই করেছিলেন।
তাঁর সঙ্গে আমার ছয় ঘন্টা আলোচনার ভেতর এক ঘন্টা টেপে রেকর্ড করা আছে, বাকি আলোচনা আমাকে নোট নিতে হয়েছে। ছয় ঘণ্টার এই আলোচনায় অনেক প্রশ্ন বা উত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আলোচনার প্রয়োজনেই। সেসব পুনরাবৃত্তি করবো না। এবং যে বিষয়গুলো তিনি প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন সেগুলো বাদ দিয়ে আলোচনার মূল বিষয়টুকু শুধু নিচে উল্লেখ করছি।
সাক্ষাৎকার
কাদের সিদ্দিকীর প্রতি আমার প্রথম প্রশ্ন ছিলো, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনা বলি আপনার মনে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো?
উত্তর – ১৫ আগস্টের সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলী এখনো যখন মনে পড়ে তখন আমি স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলি। আমি ১৫ আগস্টের প্রত্যুষে, খুব সম্ভব পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা হবে -এমন সময় খবর পাই। টেলিফোনের মাধ্যমে খবর পাই। অপরপ্রান্ত ছিল আমার ছোট বোন, টেলিফোনে জানায়, সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। তখন আমার বিশ্বাস হয়নি। এই জন্য বিশ্বাস হয়নি, ঢাকা শহরে রাতে খুব একটা ঘোরাফেরা না করলেও ওই দিন রাতে দীর্ঘসময় আমি ঢাকা শহরে ছিলাম। আমার মা তখন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, সে একটা কারণ, দ্বিতীয় কারণ আপনি হয়তো জানেন আমাকে টাঙ্গাইলের প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। টাঙ্গাইলের শান্তি-শৃঙ্খলা জন্য আর্মড ফোর্সের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। এজন্য রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়েছিলাম আমি। এবং ওই দিনেই বোধহয় আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়া যাকে আমরা সেকেন্ড ক্যাপিটাল বলি সেখানে। আপনারা হয়তো জানেন যে সেখানকার ডেপুটি ডাইরেক্টর যিনি আনোয়ারুল আলম শহীদ, তিনি ৭১ সালে আমার সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। আমি তাকে বলতে গিয়েছিলাম আমাদের এখানে দুই ব্যাটেলিয়ান রক্ষীবাহিনী পাঠিয়ে দাও। রাত এগারোটার দিকে আমি ওর ওখানে গিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমি যখন মাকে দেখতে পিজি হাসপাতালের দিকে যাই তখন প্রথম কাওরান বাজারের ওখানে একটা ট্যাংক দেখতে পাই। এ ট্যাংক শহরের দিকে যাচ্ছে। তখন রাত সম্ভবত পৌনে বারো কি বারো হবে। তারপর আমি পিজি হাসপাতাল এর কাছে যাওয়ার পর সেখানেও একটা ট্যাংক দেখতে পাই। মার সঙ্গে দেখা করে আমি অযথাই, কোনো কারণ ছিলো না, মতিঝিলের ওদিকে ঘুরতে গিয়েছিলাম। মতিঝিলের ওদিকেও একটা ট্যাঙ্ক দেখতে পাই। ফিরে আসার পথে আরেকটা ট্যাংক দেখতে পাই কাওরান বাজার পার হয়ে ফার্মগেটের কাছে। সেটা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছিল। আমি যখন বাসায় ফিরছি তখন মনে হলো আরেকবার শহীদকে জিজ্ঞেস করে যাই। আমি এমনিতেই ওকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার ওর ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করি শহরে ট্যাংক দেখছি কি ব্যাপার। ও বললো, না ওদের তো নিয়মিত মহড়া আছে, আজকে বোধহয় ওরা মহড়া দেবে। তিনটা ট্যাংককে শহরে মহড়া দিতে বঙ্গবন্ধু অর্ডার দিয়েছেন। আমার গুনতিতে কিন্তু তিনটার বেশি হয়েছে। শুনে সে বললো, এমনও হতে পারে একটা ট্যাংক আপনি দুবার দেখেছেন। আমি ভাবলাম, হতে পারে। তারপর আমি বাসায় ফিরে এসেছি। যখন বাসায় ফিরি তখন রাত্রি দেড়টা। সকালবেলা ফোন পাওয়ার আগে কিছু শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। সেই শব্দগুলো প্রায় সময় আমার কাছে পরিচিত মনে হয়েছে। মনে হচ্ছে গোলাগুলির শব্দ। কিন্তু আমি তখন ভেবেছি হয়তো বাজির শব্দ পটকার শব্দ। যদিও শব্দগুলো গুলির শব্দের মত মনে হচ্ছিলো। সে সময় আমার ছোট বোন টেলিফোন করেছিলো।টেলিফোন ধরার পর ওর কথা বিশ্বাস করিনি, ধমক দিয়েছি। ও তখন বললো, আপনি রেডিও শুনুন। রেডিওতে আমি প্রথম শুনতে পেলাম, কোন একটা কণ্ঠস্বর বলছে, স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। তখন আমার ভীষণ খারাপ লাগছিলো। এ কি করে হলো! তখনও আমি নিশ্চিত ছিলাম , বঙ্গবন্ধু হয়তো অবরুদ্ধ হয়েছেন কিম্বা কোন পাগলের প্রলাপ হতে পারে, রেডিও স্টেশনে গিয়ে প্রলাপ বকছে। রেডিও স্টেশন হয়তো ওদের দখলে। সঙ্গে সঙ্গে আমি কাপড় পরে বেরুই। বের হওয়ার পর নিচে যখন আমি নামি, নামার পরই গাড়িতে উঠছিলাম। তখন ড্রাইভার, যিনি আমার গাড়ির চালক ছিলেন, তিনি আমার খুব আপনজন, সে বলছে স্যার আমি আপনাকে নিতে পারবো না, আমি যেতে পারবো না -এই ধরনের কথা সে বলেছে। এর পরই সে চলে গেছে। দৌড়ে গেট থেকে বেরিয়ে চলে গেছে। আমি পেছনের সিটে বসতে গিয়েছিলাম। শুনে আমার মাথা কেমন হয়ে গেলো। এই ড্রাইভারই রাত দেড়টার সময় আমাকে নিয়ে এসেছে। এবং সে এত বিশ্বস্ত, আমার প্রতি সে এত লয়াল যে, কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতন হয়েছে এ খবর তার কানে ঠিকমতো গেল কিনা এরই মধ্যে ঘুরে গেলো! আমার মনে এ ধরনের একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আমি তখন নিজেই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছি এমন সময় আমার সামনে একটা গাড়ি নিয়ে এসে সে দাঁড়ালো। পাড়ার একজনের একটা গাড়ি। যেরকম ভাবে সে দৌড়ে গিয়েছিলো, সেরকমভাবে এসে বললো, স্যার এই গাড়িতে চলেন। তখন আমি বুঝলাম, আমাকে অবজ্ঞা করার জন্য ওভাবে বলেনি। সম্ভবত বলতে সময় পায়নি, সে চাইছিল আমি যেন পরিচিত গাড়িটায় না বেরুই। আমি সেই গাড়িতে উঠলাম। ঠিক করলাম প্রথমে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাবো। গণভবনের মোড়টা যখন পেরুতে যাবো সেই সময় পরিচিত এক ভদ্রলোক, একজন ডেপুটি সেক্রেটারি হাত তুলে গাড়ি থামালেন। বললেন, আপনি কই যান। বললাম রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাই। তিনি বললেন, আপনি জানেন না -? জানি, সেজন্যই যেতে চাই। তিনি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আমার গাড়িতে উঠলেন। বললেন, আপনি রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে পরে যান। আপনি আগে ফোন করেন। ফোন করে জানেন। তারপরে যান। দেখলাম তার কথাটা খারাপ না। তো সেখানে পাশে একটা বাসায় গেলাম। সেখান থেকে ফোন করলাম। শহীদ সাহেবকে ফোন করলাম। কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। গোলাম সারোয়ার – আরেকজন ডেপুটি ডিরেক্টর, ফরিদপুর বাড়ি, তাকে ফোন করলাম। তাকেও পেলাম না। তারপর ফোন করলাম নজরুল ভাইকে। তাঁকে পেলাম। বললাম, আমরা কি করবো বলেন -।
প্রশ্ন -নজরুল ভাই মানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম?
উত্তর -হ্যাঁ। তিনি বললেন, দাদু কিছুতো বুঝতে পারছিনা। কাউকেই তো পাচ্ছিনা। আমাকে তো ঘেরাও করে রেখেছে। আমি বললাম, আমরা কি করবো বলুন না। প্রেসিডেন্টের অবর্তমানে আপনিই প্রেসিডেন্ট। তখন অলরেডি জেনে গেছি। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে। দশ পনের মিনিট আগেই শুনেছিলাম। তিনি বললেন, আমি কি বলবো, আমার কথা কি কেউ শুনবে, কেউ শুনবে না। বললাম, এটা কোন কথা হলো না। তখন আমি মনসুর আলী সাহেবকে ফোন করি। মনসুর আলী সাহেব খুব জোরের সঙ্গে বললেন, এর একটা বিহিত করতেই হবে। তোমরা যে স্টেপ নেবে তাতেই আমাদের সমর্থন থাকবে। এবং আমাকে সঙ্গে নেবে। এর দশ মিনিট পরেই শহীদ সাহেবকে পেলাম। বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না, কি যে হলো। একটু পরে দেখলাম আমি যেই বাসায় আছি তার সামনে দিয়ে সে জিপে দুবার এলো গেলো। মনটা তখন খুব খারাপ হয়ে গেলো। কি ব্যাপার। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেললো আর রক্ষীবাহিনীর লোকেরা এভাবে ঘুরছে। নিশ্চয়ই এদের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। তার দু ঘন্টা পরে রেডিওতে ওদের স্টেটমেন্ট শুনলাম। শহীদ সাহেবের স্টেটমেন্ট শুনলাম। আগে এসেছে শফিউল্লার স্টেটমেন্ট জিয়াউর রহমানের স্টেটমেন্ট কখনো আসেনি। সে ফেলার পরে নৌ-বাহিনীল প্রধান, বিমানবাহিনীর প্রধান এদের সবার আসলো। তারপর শহীদ সাহেবদের আসলো। ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান, আই বির নুরুল ইসলাম এদের সবারই এলো।
প্রশ্ন -এলেন মানে তারা নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন?
উত্তরঃ -হ্যাঁ। মোশতাক সরকারের প্রতি তারা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন। এবং এটা বারবার প্রচার করা হলো। সব শুনলাম। সেখান থেকে বিকেল বেলা বাসায় গেলাম। সেখানে গিয়ে এক নতুন মন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা হলো। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়ও মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বললেন, ভাই কাদের, তোমার কোন চিন্তা নাই। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তিনি তোমার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট। উনি তোমাকে একটা ভালো দায়িত্ব দিতে চান। তোমাকে কিন্তু দায়িত্বটা বহন করতে হবে। নতুন প্রেসিডেন্ট তিনি হয়েছেন, খন্দকার মোশতাক আহমদ, উনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট এটা বুঝতে পারার একটা সুবিধে ছিলো। সেভেন্টি ওয়ানে যখন উনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমরা সেভেন্টি ওয়ানের লড়াইয়ের সময় আমাদের যে ব্যয়ের হিসাব, আমরা স্বাধীন বাংলা সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলাম। হিসাবপত্র দেখে মোশতাক সাহেব খুশি হয়েছিলেন। তারই জের টেনে উনি বলেছিলেন মোশতাক সাহেব আমার উপর খুশি আছেন। তখন আমি আমার নিজের অবস্থাকে আয়ত্তে রাখতে পারি নাই। যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে শুনেছি তখন বুকের ভেতর একটা তীব্র যাতনা অনুভব করেছে কিন্তু চোখে পানি আসে নাই। এই কথা যখন শুনলাম, তখন স্বাভাবিকতা আমার হারিয়ে গিয়েছিলো। আমার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছিলো। তার একটু পরেই দেখলাম টেলিভিশনে তাদের শপথ অনুষ্ঠান। শপথ অনুষ্ঠান দেখার পর সত্যিকার অর্থেই খুব খারাপ লাগছিলো। বাংলার ইতিহাস বারবার কিভাবে ঘুরে আসে। একই বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস বারবার ঘুরে আসে। তখন আমি খাচ্ছিলাম। যখন মাংশ মুখে দিয়েছি তখন আমার মনে হলো বঙ্গবন্ধুর মাংশ চিবিয়ে খাচ্ছি। তারপর থেকে আমি মাংশ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। এবং যতদিন না দেশের মাটিতে যাব ততদিন আর হয়তো মাংশ খাবো না। আর যেদিন খাবো সেদিন যদি একই অনুভূতি আসে আর খাওয়া হবে কিনা বলতে পারি না। যাহোক এমনি করে আমার তিনটা দিন কেটেছে। প্রথম ভেবেছিলাম এরা টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু আওয়ামীলীগের যারা মন্ত্রিসভায় চলে গেলেন, তাঁদের যাওয়ার ফলে নীচের দিকে কর্মীদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি এসেছিলো, কর্মীদের মধ্যে ধারণা হয়েছিলো আমাদের সবাই তো আছে, নেতারা তো আছেনই। তাঁরা যেভাবে নির্দেশ দেবেন আমরা সেভাবে কাজ করবো। এরকম একটা মানসিকতার জন্য খুনি চক্র একটা সময় পেয়ে গেলো। আমি নিজেও একটু উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিনই নেমে পড়বে সেটা যে ব্যাহত হলো তাতে কোন সন্দেহ নেই বুঝতে পারলাম। তিন দিন এভাবে কেটে যাওয়ার পরে মার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা -।
প্রশ্ন -আপনি কি মনে করেন মানুষ যে রিয়াক্ট করলো না, তার কারণ এটাই যে আওয়ামী লীগের নেতারা শপথ নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন, নতুন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করলেন? মানুষ কে শুধু এ কারণেই রিয়াক্ট করেনি?
উত্তর -না, ঠিক তা নয়। মানুষ যে সব সময় প্রতিবাদ করে, একটা চ্যানেল ধরে করে, একটা লাইন ধরে করে। তারা চায় সামনে কেউ থাকুক। বঙ্গবন্ধুর দলের লোক তাঁরাই বঙ্গবন্ধুর বেশি অনুসারী এবং তাঁরা যেহেতু এখন ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা এখনই হয়তো বিচার করবেন। যেভাবে করলে ভালো হবে সেটা তাঁরাই ডিসাইড করবেন। এই ভরসাতেই তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে আসেনি। যদি তাঁরা মন্ত্রিসভায় না যেতেন তাহলে জিনিসটা স্কাটার্ড হলেও, সুশৃংখল না হলেও লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদ জানাবার জন্য রাস্তায় নেমে পড়তো। এই প্রতিবাদকে ব্যাহত করেছে এ জিনিসটা।
প্রশ্ন -যাঁরা শপথ নিলেন এঁদের সম্পর্কে আপনার কমেন্ট কি?
উত্তর -এঁদের সম্পর্কে আমার দেশের মানুষ কমেন্ট করবেন। এবং সে কমেন্টকে আমিও মেনে নেবো।
প্রশ্ন – তাঁদের অনেকেতো এখনো আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে আছেন?
উত্তর -আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা আর দেশের সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব করা নয়। বা সাধারণ মানুষের মনের সিংহাসনে – বা ভালোবাসা অর্জন করা নয়।
প্রশ্ন -কিন্তু আপনি তো আওয়ামী লীগে অবস্থান করছেন?
উত্তর -হ্যাঁ , আমাদের দলে যে খারাপ লোক নেই একথা তো নয়। হাজারো ভালো লোকের ভেতর আমাদের দলে খারাপ লোকও আছে। যাঁরা স্বাধীন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছেন তাঁদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এমন কথা আমি বলছি না। কিন্তু তাঁরা যদি নিজেরা বলেন আমরা ঠিক করেছি তাহলে নিশ্চয়ই তাঁদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।
প্রশ্ন – তাঁরা নিশ্চয়ই বলবেন যে এটা একটা কৌশল ছিল। নিজেদের রক্ষা করার জন্য -।
উত্তর – তাহলে বলবো কৌশলটা ভ্রান্ত কৌশল ছিলো। তাঁরা যদি এটাকে কৌশল হিসেবে নেন, তাহলে আমার বক্তব্য হবে কৌশল ঠিক হয়নি, ভুল ছিলো।
প্রশ্ন – তাঁরা এটা বলতে পারেন যে তখন যদি আমরা এটা না করতাম, কোন -অপারেট না করতাম, তাহলে, মেরে ফেলতে পারতো, অথবা জেলে নিতো।
উত্তর – সেটা তাঁরা বলতে পারেন।
প্রশ্ন – সেদিন থেকে বিচার করলে এই কৌশলকে আপনি কি সঠিক মনে করেন না?
উত্তর – তাঁদের সেফটির জন্য সঠিক হতে পারে। কিন্তু জাতীয় পরিবর্তনের জন্য অথবা বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই কৌশলটা ঠিক না।
প্রশ্ন -তারা যদি কো-অপারেট না করতেন, ইট ওয়াজ কোয়াইট শিওর যে তাদের জেলে পোরা হতো -।
উত্তর -আমার মনে হয় না সবাইকে জেলে পুরতে পারতো। তাঁদের অসুবিধা ছিল, এটা সত্য কথা কিন্তু তাঁরা ইচ্ছে করলে এসব এস্কেপ করতে পারতেন।
প্রশ্ন – আপনি কি তাদের কাছে আত্মসমালোচনা দাবী করছেন?
উত্তর -হ্যাঁ, তাদের সেটা বলা উচিত, কোথায় ভুল হয়েছে, কোথায় ঠিক হয়েছে। মানুষ জীবনে ভুল করতে পারে। কিন্তু ভুলকে শুদ্ধ বলে চালানো ঠিক না।
প্রশ্ন -আত্মসমালোচনা যদি আপনি ডিমান্ড করেন তাহলে শুধু ১৫ আগস্টের পরের কাজের জন্য কেন, তার আগে তাঁরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তার জন্যও -।
উত্তর -আমি শুধু ১৫ আগস্টের কথা বলছি না। ১৫ আগস্ট এর উপর জোর দিয়ে বলছি আগেরটাও বলছি। মনে করুন একটা সময়ে একটা কাজ করেছি আমি। আমার কাজ ভুল হয়েছে, আমি যদি বুঝতে না পারি বা যেটা সত্য বুঝতে পারি অথচ স্বীকার করি না, তাহলে সে ভুল আবার করবো, আরও বেশি ভুল করবো।
প্রশ্ন -ভুল করা একটা ব্যাপার। কিন্তু দুর্নীতি করা তার ভেতরে জড়িয়ে যাওয়া যেটা আপনিও আগে স্বীকার করেছেন (সাক্ষাৎকারের পড়বে আলোচনার সময়) সেটা তাঁরা না জেনে করেছেন তাতো নয়, জেনেশুনেই করেছেন।
উত্তর -কিছুটা জেনেও করেছেন।
প্রশ্ন -যে লুটপাট করা, লাইসেন্স পারমিটবাজি করা, চোরাচালানী করা -।
উত্তর -কিছুটা জেনেই করেছেন। কিন্তু বেশ কিছু লোক আছেন যাঁরা এর এফেক্টটা বুঝতে পারেননি।
প্রশ্ন – এর পার্থক্য করবেন কিভাবে? কারা বুঝায় করেছে কারা না বুঝে -।
উত্তর -এক্ষুনি এসব পরিষ্কার করে বলা আমার জন্য একটু অসুবিধাজনক।
প্রশ্ন – এখন যে তাঁরা ডিমান্ড করছেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চান, যাঁরা এই হত্যার পর পরই মন্ত্রী হবার শপথ নিলেন, এটা কি আপনার কাছে একটা প্রহসনের মতো মনে হয় না?
উত্তর -যারা খুন করেছে, তাঁদের কাছে যাকে খুন করেছে তার বিচার চাওয়াটা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না। আজ যাঁরা খুনের সহযোগিতা করেছে তাঁরা যদি চায় সেটা আরও বড় প্রহসন। খুবই ন্যাক্কারজনক কাজ, জনগণ এটা ভালো বোঝেন। তাঁরা এর জবাব দেবেন।
প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
উত্তর – আমি মনে করি বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের বেশিরভাগ আওয়ামি লীগে রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে যেমন দুর্বলতা আছে, কলুষতা আছে, তেমনি নতুন মুখও আছে এবং কর্মশক্তিও আছে তাদের মধ্যে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আওয়ামীলীগ বাংলাদেশ একটা বিরাট সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারবে এ বিশ্বাস আমার আছে।
প্রশ্ন -কিন্তু সাড়ে চার বছর হয়ে গেল আওয়ামী লীগ কোন এফেক্টিভ মুভমেন্ট গড়ে তুলতে পারেনি দেশের ভেতর, এর কারণ আপনি কি মনে করেন।
উত্তর – ঠিক নেতৃত্বের চাবিকাঠি বলতে যা বোঝায় তা যাদের হাতে আছে, তাঁরা ততটা শক্তিশালী নয়। এর আরেকটা কারন হলো আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় বলিষ্ঠ নেতৃত্বের চলে এসেছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে সে বলিষ্ঠতা একটু কমে গেছে।
প্রশ্ন – বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগের কোন নেতা বা নেতাদের প্রতি আপনি বেশি শ্রদ্ধাশীল?
উত্তর – তাঁরা মারা গেছেন।
প্রশ্ন – যাঁরা বেঁচে আছেন?
উত্তর – তাঁদের কারো কারো প্রতি আমার সমর্থন আছে, তবে নাম বলতে চাই না।
প্রশ্ন – আওয়ামীলীগ তো দুভাগ হয়ে গেছে। কোন অংশকে আপনি বেশি সঠিক মনে করেন?
উত্তর – আওয়ামী লীগ একটাই, মালেক উকিল সাহেব যার নেতৃত্বে রয়েছেন।
প্রশ্ন – আওয়ামী লীগে যে দশ দলীয় ঐক্যফ্রন্ট করেছে এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর – বর্তমান যে সরকার, এই প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে হটানো জন্য সকল প্রগতিবাদী মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। সে কারণে এটাকে আমি ভালো মনে করি।
প্রশ্ন – এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনি কতখানি আশাবাদী?
উত্তর – আদর্শগত মিল না থাকলে ভবিষ্যৎ ঝরঝরে।
প্রশ্ন – কতদূর পর্যন্ত এই আদর্শগত মিল আপনি চাইবেন?
উত্তর – এক, তাঁরা সমাজতন্ত্র চান কিনা, সাধারণ মানুষের ভাগ্য সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁরা পরিবর্তন করতে চান কিনা, দুই, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের পদক্ষেপকে তাঁরা সমর্থন করেন কিনা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অবদান কতটা সমর্থন করেন এগুলি দেখতে হবে।
প্রশ্ন – এই দশদলীয় ফ্রন্টের ভেতর আওয়ামী লীগের পরেই দ্বিতীয় শক্তিশালী দল হচ্ছে জাসদ। জাসদের সভাপতি কিছুদিন আগে বিচিত্রা সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন আওয়ামী লীগ বাকশাল কনসেপ্ট বাদ না দেয় তাহলে তাদের সঙ্গে কোনো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সম্ভব নয়।
উত্তর – আমার তো মনে হয় না আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাদ দিয়ে এই ফ্রন্টে জয়েন করতে গিয়েছিলো?
প্রশ্ন – জাসদ নেতারা এখন এটা খোলাখুলিই বলছেন।
উত্তর – তাহলে তারা ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। সেখানে আওয়ামী লীগের চলে যাওয়ার কথা উঠে না।
প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের চলে যাওয়ার কথা নয়, কথা হচ্ছে জাসদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন নিয়ে -।
উত্তর – জাসদ এ বিষয়ে অনমনীয় থাকলে তাদের সঙ্গে আন্দোলন সম্ভব নাও হতে পারে।
প্রশ্ন – তার মানে দ্বিতীয় বিপ্লবের যে কর্মসূচির কথা আপনি বলছেন, বাকশাল যার অন্তর্ভুক্ত -দশ দলের ফ্রন্টে যারা আছে তাদের সবাইকে মানতে হবে?
উত্তর – আমি ঠিক তা বলছি না। বাকশালের যে সম্পূর্ণ প্রোগ্রাম, টোটাল প্রোগ্রাম তারা মেনে নেবেন তা আমি বলছি না। আমি বলছি বাকশালের মূল যে কথাটি, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দিকে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা -সে ব্যাপারে তো তাঁদের ঐক্যমত হতেই হবে। যারা সমাজতন্ত্র করতে চায় না, তাঁদের সঙ্গে তো আমাদের ইয়ে হতে পারে না। এটা হতে পারে, আমরা সমাজতন্ত্র একভাবে করতে চাই, তাঁরা ঠিক সেভাবে করতে চায় না, তাঁদের সঙ্গে সাময়িকভাবে ইয়ে হতে পারে।
প্রশ্ন – জাসদের প্রোগ্রামে তো তাঁরা সমাজতন্ত্র রেখেছে।
উত্তর – হ্যাঁ?
প্রশ্ন – কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, তাঁরা বলছে সমাজতন্ত্র তাঁরা তাদের মত করে করবে -।
উত্তর – তা করুক।
প্রশ্ন – কিন্তু বাকশাল কনসেপ্ট মাইনাস করে?
উত্তর – এখন একটা ব্যাপার বুঝতে হবে। আন্দোলন কি আপনি নীতিকে প্রতিষ্ঠার জন্য করছেন না বর্তমান যে শক্তি আছে তাকে সরাবার জন্য করছেন। আমার মনে হয় এই ঐক্যফ্রন্টটা বর্তমান যে সরকার আছে তাকে উৎখাত করার জন্য একটা প্রচেষ্টা। সেখানে আমার নীতিকে কারো উপর পুরোপুরি চাপিয়ে দেয়া যেমন ঠিক না তেমনি আমার নীতি যে স্বীকার করবে না তার সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট হতে পারে না। কিছুটা সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।
প্রশ্ন – ধরা যাক দশ দলীয় জোটের আন্দোলনের ফলে বর্তমান সরকারের পতন ঘটলো। তারপর মে সরকার হবে সেটা কি দশ দলের মিলিত সরকার হবে?
উত্তর – আমার মনে হয় সেটা ভালো ফল দিতে পারবে না। আদর্শগত ঐক্য না থাকলে শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য কোনো ঐক্যফ্রন্ট বা যুক্তফ্রন্টে কোনদিন সাধারণ মানুষের ভালো হতে পারবে না।
প্রশ্ন – তাহলে সাধারণ মানুষ এই যুক্তফ্রন্টকে সাপোর্ট করবে কেন?
উত্তর -সাপোর্ট করবে বর্তমান যে গভমেন্ট তার চেয়ে কিছুটা ভালো হবে এই জন্যে। আমরা যতটা ভালো চাই এভাবে সেটা হবে না।
প্রশ্ন – তার মানে এই গভমেন্টের যদি পতন হয় তাহলে আবার ক্ষমতা নিয়ে ফ্রন্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব হবে?
উত্তর – ক্ষমতার দ্বন্দ্বতো হবেই।
প্রশ্ন – তাহলে তখন কি আওয়ামী লীগ এককভাবে ক্ষমতায় যেতে চাইবে?
উত্তর -আমার মনে হয় এখানেই সাধারণ মানুষের সম্মতি প্রয়োজন আছে। এখানে ভোটের প্রশ্ন আসে। যদিও বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ভোট হয় সেটা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নয়, সেটার কিছু অংশ দূষিত আছে। এই মুহূর্তে দশ দল যে কর্মসূচি নিয়েছে সেটাই সঠিক। তবে এই আন্দোলনকে ভাঙ্গবার চেষ্টা হবেই।
প্রশ্ন – দশ দলের এই জোট শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে বলে কি আপনি মনে করেন?
উত্তর – নীতি ওদের খুব একটা কাছাকাছি নয় তো। সেজন্যে ভাঙতে পারে।
প্রশ্ন – আপনি তাহলে মনে করছেন দশ দলের ফ্রন্টে আরো পোলারাইজেশন দরকার?
উত্তর -তাই তো মনে হয়। দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রোগ্রামের ব্যাপারে কোন আপস নাই।
প্রশ্ন -যদি বলি আওয়ামী লীগ এককভাবে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় যেতে পারবে না বলেই ফ্রন্ট, আন্দোলন -এসব করছে?
উত্তর -আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ক্ষমতায় যেতে পারবে না, কারণ সামরিক জান্তা তাকে যেতে দেবে না, কোথাও দেয়নি। নেতারা আপোষ করে ক্ষমতায় গেলে জনগণ তা মানবে না, আজকে পার্টির তা অবস্থা পার্টিও তা মানবে না। জিয়া সরকারকে উৎখাত করেই ক্ষমতায় যেতে হবে।
প্রশ্ন -রক্তাক্ত সংঘর্ষ ছাড়া কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না?
উত্তর – প্রয়োজন হলে মুক্তিযুদ্ধের মত দীর্ঘ রক্তাক্ত সংঘর্ষেও যেতে হতে পারে।
প্রশ্ন -সিপিবি বলেছে আফগানিস্তানের স্টাইলে বিপ্লব ঘটবে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
উত্তর -আফগানিস্তানে ঠিক কি ঘটেছে আমি জানি না তবে মনিদারা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন ওই ভাষা আমি ব্যবহার করবো না।
প্রশ্ন – আপনি বলেছেন একাত্তরের যুদ্ধের মতো হতে পারে। তার মানে কি এই যে ভারতীয় সৈন্যের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ গদিতে বসবে?
উত্তর – এই মুহূর্তে বাইরের সশস্ত্র শক্তির সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন – আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার জন্য বা কোন রকমে ক্ষমতায় বসে ক্ষমতা রক্ষার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইতে পারে?
উত্তর – ক্ষমতায় বসার জন্য আমি মনে করি না ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য প্রয়োজন। তবে ক্ষমতায় বসার পর বাংলাদেশ যদি বহিঃশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে।
প্রশ্ন -ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি মোতাবেকই সেটা ডাকা যাবে?
উত্তর -হ্যাঁ।
প্রশ্ন -কোন কোন ভারতীয় নাগরিক এমনকি রাজনীতিবিদও মনে করেন বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে পারবে না, বাংলাদেশের উচিত ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হওয়া। এ ব্যাপারে আপনার কি অভিমত?
উত্তর -বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ছোট, লোক সংখ্যায় অনেক কম দেশও স্বাধীন সার্বভৌম অবস্থায় টিকে আছে। যারা ওসব বলে তাঁরা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়। আমি আপনাকে এটা স্পষ্টভাবে বলতে পারি বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়। ঠিক এর বিপরীতে ভারত যদি প্রভুত্ব করতে চায় তা’হলে বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোকই তার বিরোধিতা করবে। সেই ক্ষেত্রে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে সম্মান দেয়া এবং বন্ধুত্বের দ্বার উন্মুক্ত করা। ‘৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ গিয়েছিল সেটা একটা আলাদা পরিস্থিতি।
প্রশ্ন -কিন্তু এটা আমরা আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সময়ও দেখেছি ভারতের বিরুদ্ধে বেশ কিছুটা জনমত গড়ে উঠেছিল চোরাচালানী ও অন্যান্য নানাবিধ কারণে যেটা আওয়ামী লীগ সরকার এবং এখানকার কংগ্রেস সরকার দুই সরকারই বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। চোরাচালানী এমনই বেড়ে গিয়েছিল যে এটা আপনিও জানেন পাটের ব্যাপারে বলা হয়েছে ভারতেরই লোকসভায় যে, ভারত এমন পাট এক্সপোর্ট করছে যেটা তারা নিজেরা উৎপন্ন করে না -।
উত্তর -এর যেমন কিছুটা সত্যতাও আছে, আবার এর অনেকটা প্রোপাগান্ডাও বটে।
প্রশ্ন – লার্জ সার্কেলে যে স্মাগলিং হতো আপনি কি বলবেন সেটা শুধু প্রোপাগান্ডা? ইন্ডিয়ান পার্লামেন্ট এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে -।
উত্তর -যতটা চোরাচালানি হতো তার চেয়ে বেশি প্রপাগণ্ডা হতো। একটা সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা আর ঠিক গুছিয়ে তোলা প্রশাসন ব্যবস্থা এক হতে পারেনা আজ থেকে পাঁচ বা দশ বছর আগে কি অবস্থা ছিল তার সঙ্গে আজকের তুলনা করা চলে না। সেদিন সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হয়তো সামর্থের অভাবে অনেক কিছু করা সম্ভব হয়নি। আমাদের যে ব্যর্থতা ছিল না তা নয়, আমাদের ব্যর্থতার চেয়ে শত্রুপক্ষের প্রোপাগান্ডা অধিক পরিমাণে শক্তিশালী ছিলো।
প্রশ্ন – বলা হয়ে থাকে আওয়ামি লীগ সরকারের ভেতরই অনেক লোক ছিলেন যারা এই চোরাচালানিতে নিয়োজিত ছিলেন -।
উত্তর -আমার মনে হয় তা ঠিক নয়।
প্রশ্ন -আপনি কি বলবেন এগুলো শুধুই বিরোধীদলীয় প্রোপাগান্ডা?
উত্তর -আমি তো বলছি কোন প্রোপাগান্ডাই একশ’ ভাগের একশ’ ভাগ সত্য নয়, তেমনি একেবারে একশ’ ভাগ মিথ্যাও নয়।
প্রশ্ন – তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে আওয়ামী লীগের ভেতরও চোরাচালানী ছিলো সংখ্যায় তারা -।
উত্তর -আমি আপনাকে এটা নিশ্চয়ই বলবো না যে আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটি মানুষ ভালো।
প্রশ্ন – প্রশ্নই ওঠে না।
উত্তর – তবে আমি আপনাকে বলব বাংলাদেশের যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে তার মধ্যে যতজন রাজনীতিসচেতন কর্মী আছেন তার মধ্যে আওয়ামী লীগেই বেশি ভালো লোক আছে। যেহেতু এটা একটা বিরাট সংগঠন সেহেতু এর মধ্যে খারাপের সংখ্যাও কিছু বেশি। অন্য দলে, সংগঠন যাদের ছোট, তাদের ভেতর খারাপ লোকের সংখ্যাও আনুপাতিক হারে কম।
প্রশ্ন -আমরা এটা লক্ষ্য করছি যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তা ক্রমাগত খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এর কারণ কি?
উত্তর -এই খারাপটা কি আপনি সরকারি পর্যায়ে দেখছেন না জনগণ -টু জনগণ দেখছেন?
প্রশ্ন -জনগণ টু জনগণের কোনো প্রশ্নই আসে না। আমরা দেখছি সরকারি পর্যায়ে, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয়বার যখন ক্ষমতায় এলেন তখন দেখা যাচ্ছে যে ফারাক্কা এবং অন্যান্য ব্যাপারে তাঁরা কঠোর মনোভাব নিয়েছেন।
উত্তর – ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে না বাংলাদেশের পক্ষ থেকে?
প্রশ্ন -বাংলাদেশ থেকে তো আমাদের মনে হচ্ছে ইন্ডিয়ার তরফ থেকেই এটা হচ্ছে।
উত্তর – তা’হলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। এরা এতো কঠোর মনোভাব নিচ্ছে, তারপরেও কেন জিয়াউর রহমান সাহেব ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটা সদ্ভাব তৈরি করার জন্য উপযাচক হয়ে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার দিন পনেরো পরই ভারত সফর করে গেলেন যে সফরটা সরকারি পর্যায়ে স্বীকৃতও ছিলো না। আমার মনে হয় জিয়াউর রহমান সাহেব তোষণ নীতি নিয়েছেন বলেই ভারত কিছুটা চাপ সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছে। আমার তো মনে হয় না ভারত বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কোন অসদাচরণ করতে চায় কিংবা অসদাচরণ করলে ভারতের কোন লাভ হবে।
প্রশ্ন – তোষণ নীতি বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন ব্যাখ্যা করুন।
উত্তর – আমরা প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই ফারাক্কা সমস্যার কথা শুনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশ এ সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট মাতামাতি করেছে। এটা যে একটা সমস্যা এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সময় সময় এটাকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হয় সেটা লক্ষ্য করার বিষয়। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে ইন্দিরা-মুজিব যে চুক্তি হয়েছিল সে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ফারাক্কা থেকে চুয়াল্লিশ হাজার কিউসেক পানি পেতো।বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর সে চুক্তি বহাল ছিলো। তারপর উত্তরবঙ্গে প্রথম যে খরা হয়, সে খরা যে ফারাক্কার কারণে এটা বোঝাবার জন্য সরকার সবরকম ব্যবস্থা নিয়েছিলো। অথচ তার দুই বছর পর মোরারজি ভাইর সরকারের সঙ্গে ফারাক্কা নিয়ে চুক্তি করা হয়, তাতছ বাংলাদেশ চৌত্রিশ হাজার কিউসেক পানি পায়। দশ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েও দেখা যায়নি যে ফারাক্কা নিয়ে জিয়াউর রহমান সাহেব কোন কথা বলেছেন। যদিও জিয়াউর রহমান সাহেব তাঁর অনুসারীদের দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়েই যাচ্ছেন। এখানে আমার প্রশ্ন হলো আগে দশ হাজার কিউসেক পানি বেশি পাওয়া সত্ত্বেও উত্তরবঙ্গের খরার জন্য সেদিন ভারতকে দায়ী করা হয়েছিল অথচ দশ হাজার কিউসেক পানি কম পাওয়ার পর থেকে উত্তরবঙ্গে পানি নেই, টিউবওয়েলে পানি উঠছে না এসব সরকারিভাবে বলা হচ্ছে না। এইযে হচ্ছে না এখানেই দেখা যায় যে এটা একটা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছিলো। পানির প্রয়োজন নেই এ কথা আমি বলছি না। আমি বলছি বেশি পানি পাওয়ার পরও ভারতকে সেদিন গালি দেওয়া হলো। অথচ কোম্পানির পাওয়ার পরেও যে প্যাক্ট তাঁরা নিজেরা করেছেন তার জন্য তাঁরা কিছু বলেননি। আমি এটা এজন্যই বলছি যে এভাবে তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধু যেদিন মারা যান সেদিন ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ছিলেন। আজকেও ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষমতায় আছেন। সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলা হয়েছিলো। এবার ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পরপরই জিয়াউর রহমান উপযাচক হয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন। অথচ ইউনিডো কনফারেন্স উপলক্ষে জিয়াউর রহমান ভারতে এসেছিলেন। সেখানে তার আসার কথা ছিল না। উপরাষ্ট্রপতি সাত্তার সাহেবের আসার কথা ছিলো। সফরটাও সহকারী, আনুষ্ঠানিক সফর ছিলো না। সেই সফরটা ছিলো তাঁর ব্যক্তিগত অনুরোধের উপর। এবং সেই সফরসূচিতে আপনি দেখতে পাবেন ফরমালিন শুধু একবার ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে ।আরও তিনবার তিনি কথা বলেছেন। এই তিনবারের জিয়াউর রহমানের রিকোয়েস্টে -অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধীর কথা বলেছেন। এটা আমাদের দেশের জন্য, একটা জাতির জন্য সম্মানজনক ব্যাপার নয়। আমি মনে করি জিয়াউর রহমানের এই সফরের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীর মন জয় করা। এই মন জয় করার তোষণ নীতি আমরা খুব একটা পছন্দ করি না।
প্রশ্ন -আপনার কথা মত জিয়াউর রহমান যদি তোষণ নীতি অবলম্বন করেন তা’হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তো ভালো হওয়ার কথা, আমরা লক্ষ্য করছি এই সম্পর্ক কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
উত্তর -একটা দুর্বল সরকারকে কেউ পছন্দ করে না। এই দুর্বলতা মোরারজি ভাইর আমলেও বাংলাদেশ দেখিয়েছে এজন্যে জিয়া সরকার জনগণের আস্থা হারিয়েছে।
প্রশ্ন -আস্থা হারিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা যে অভিযোগ করেছেন তার জবাবে বিএনপি’র নেতারা বলেছেন আপনারা জনগনের সমর্থন নিয়ে আসুন, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন করুন, উশৃংখল হবেন না, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ লিপ্ত হবেন না, যেমনটি তারা হয়েছিলেন গত হরতালের সময়, এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন?
উত্তর -বিএনপি যেভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তাঁরা ভাবে সবাই বুঝি ওভাবেই ক্ষমতায় আসতে চায়। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে নির্বাচন অবাধ হবে বলে আমি মনে করি না। নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা নেই। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব হতো।
প্রশ্ন -তা’হলে কি আওয়ামী লীগ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়?
উত্তর -সামরিক অভ্যুত্থান করে নাও যেতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যেতে পারে।
প্রশ্ন -আপনি দেশে ফিরছেন না কেন?
উত্তর -যতক্ষণ পর্যন্ত খুনিরা ক্ষমতায় আছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি দেশে ফিরে যাবো না।
প্রশ্ন -তার মানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত আপনি দেশে ফিরবেন না?
উত্তর -না।
প্রশ্ন -আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কি আপনি ক্ষমতার অংশীদার হবেন?
উত্তর -এক্ষুনি ক্ষমতায় যেতে চাই না। পার্টিতে থাকতে চাই।
প্রশ্ন -মোরারজি দেশাইর সঙ্গে অফিশিয়ালি আপনি কতবার সাক্ষাৎ করেছেন?
উত্তর – তিনবার।
প্রশ্ন – আপনার সঙ্গে তাঁর কি ধরনের কথা হয়েছে?
উত্তর -বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক এটা তাকে আমি বলেছি। জনগণ যে সরকারকে সমর্থন করেনা সে সরকারকে যদি আপনারা সমর্থন করেন তা’হলে সেটা জনগণের বিরুদ্ধে যাবে একথাও তাকে বলেছি।
প্রশ্ন – তিনি আপনাকে ভারতে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে বারণ করেছেন বলে এখানকার পত্র পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে -।
উত্তর – রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর কোনো অনুমতি আমি তাঁর কাছে চাইনি।
প্রশ্ন -কিন্তু আপনাদের প্রতি তিনি যথেষ্ট বিরূপ ছিলেন এটা কি সত্যি?
উত্তর -প্রথম দিকে ছিলেন । যে সরকারকে সরিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে আমাদের সদ্ভাব থাকার কারণে প্রথমদিকে কিছুটা ছিলেন। পরে তা কেটে যায়।
প্রশ্ন -কোন যোগ্যতা বা অধিকার নিয়ে আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে কথা বলেছেন?
উত্তর -একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির যোগ্যতা নিয়ে আমি কথা বলেছি। বিগত পিএম-এর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। কখনো তার কাছে মাথা নোয়াইনি।
প্রশ্ন -ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কতবার ফর্মাল আলোচনা হয়েছে আপনার? আলোচনার বিষয় কি ছিল?
উত্তর -কয়েকবারই কথা হয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু এখন আমি বলবো না। আমি অত্যন্ত খুশি যে তাঁরা আমাদের সম্মান রেখে কথা বলেছেন।
প্রশ্ন -‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আপনি বাংলাদেশে যেসব অপারেশন চালিয়েছেন তাতে আপনার পক্ষে এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা কত?
উত্তর -সব বলতে পারবো না। ‘৭৫-এর ৯ অক্টোবর পাবনার কাজিপুর থানার নিশ্চিন্তপুরে যুদ্ধে একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন, দুইজন লেফটেন্যান্ট এবং চৌদ্দজন সিপাহী মারা গেছেন। আমাদের পক্ষে নিহত একজন, বগুড়া যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান।
প্রশ্ন – আপনি জানেন এরা ৭১ -এর হানাদার পাকবাহিনী নয়, তারপরও কেন এ ধরনের আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন? এটা কি রাষ্ট্রবিরোধী কাজ নয়?
উত্তর -আমরা একটা খুনী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার উদ্দেশ্যেই এটা করেছি। সরকারকে দুর্বল করা আর রাষ্ট্রকে দুর্বল করা এক কথা নয়। ‘৭১ সালে আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ও দুর্বল করতে চেয়েছি রাস্তা ভেঙ্গে, ব্রিজ উড়িয়ে, রেললাইন উপড়ে ফেলে। এখন আমি সেরকম কিছু করছি না। আমার যুদ্ধ দেশের বিরুদ্ধে নয়, দেশের বেআইনি সরকারের বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন -আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন ‘৭১ সালে ভারতীয়রা বাংলাদেশের শরণার্থীদের যেভাবে দেখতো ৭৫ সালের পর সেভাবে দেখছে না, বরং তাদের অনেকে যথেষ্ট বিরক্তিও প্রকাশ করেছে আমার কাছে। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
উত্তর -বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয়। এটা ঠিক যে একাত্তর সালে বাংলাদেশের দুর্গত শরণার্থীদের পাশে ভারতীয়রা এসে দাঁড়িয়েছিলো। সাহায্যটা যেন প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছিলো। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের আশেপাশের রাজ্যগুলোর মানুষের আবেগ অনেক বেশি ছিলো। যারা এসেছিল তাঁরা তাদের ঘর-বাড়ি পুড়তে দেখেছে মা বাবা ভাই বোনদের চোখের সামনে মরতে দেখেছে তাদের আবেগ-অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো। ভারতীয়দের আবেগের উষ্ণতা তাঁদের স্পর্শ করেনি। নয় মাস পরে দেশে গিয়ে তারা ভাঙ্গা সংসার জোড়া লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। একটা চিঠি লিখে খোঁজ নেয়নি যারা তাঁদের নয় মাস আশ্রয় দিয়েছে তাদের। ফলে এখানকার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। তা’ছাড়া যুদ্ধের পর বাংলাদেশের সকল চাহিদা ভারতকে মেটাতে হয়েছে। কারণ অন্য দেশ থেকে কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ আমাদের ছিলো না। আমরা পাকিস্তান আমলে যেসব বিদেশি জিনিস ব্যবহার করেছি সেগুলোর তুলনায় ভারতের কিছুকিছু জিনিসের মান তুলনামূলকভাবে নিকৃষ্ট ছিল। ভারত যদিও এসব দিতে রাজি ছিলো না তবু বাংলাদেশের প্রয়োজনে তারা দিতে বাধ্য হয়েছে। যেসব আমলারা ভারত থেকে জিনিস কিনতে এসেছিল তারা নিকৃষ্ট মানের জিনিস কিনেছে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো জিনিস না পেয়ে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। তাঁরা ভারতকে ভুল বুঝেছে।
প্রশ্ন -আপনি বর্তমান সরকারকে উৎখাত করতে চান। সরকার উৎখাতের এই আন্দোলনটা দেশের মাটিতে বসে করলেই কি ভাল হয় না?
উত্তর -আপনি কি মনে করেন সরকার আমাকে দেশের মাটিতে বসে আন্দোলন করতে দেবে?
প্রশ্ন -সেরকম পরিস্থিতিতে দেশের ভেতরওতো আত্মগোপন করে থাকা যায়। আওয়ামী লীগের আমলে বহু রাজনৈতিক দল আত্মগোপন অবস্থা আন্দোলন করেছে।
উত্তর -আমার সেরকম অবস্থা নেই। আমার পরিচিতি অনেক ব্যাপক। আমার পক্ষে দেশে বসে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করার অসুবিধা আছে।
কাদের সিদ্দিকীর প্রতি আমার আনুষ্ঠানিক আলোচনার শেষ প্রশ্ন ছিল -‘৭১-এর পর যুবলীগের সহ-সভাপতি থাকা ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্বে আপনি কেন ছিলেন না?
কাদের সিদ্দিকী বললেন, ‘এর অনেকগুলো কারণ আছে। তার ভেতর প্রধান যে অসুবিধা ছিল আমার দিক থেকে সেটা হচ্ছে আমার বয়স। ‘৭২ -এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু আমাকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেছিলেন। আমি বলেছি এ পদের জন্য আমি উপযুক্ত নই। তখন জিল্লুর ভাইকে সাধারণ সম্পাদক করা হলো। বঙ্গবন্ধু এরপর আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক হতে বলেন। সেটাও আমি অস্বীকার করি। আমি বলেছি আমাকে শুধু আওয়ামী লীগের মেম্বার রাখুন। দায়িত্ব দেয়া সত্বেও কেন অস্বীকার করেছে এ বিষয়ে বলা দরকার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যদি আমি হতাম তা’হলে দলের বহু প্রবীণ সদস্যদের বিরুদ্ধে আমাকে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিতে হতো। প্রবীণ সদস্যরা জোট বেঁধে আমার বিরুদ্ধে লাগতেন। বঙ্গবন্ধু একবার দু’বার না হয় আমার কথা বিশ্বাস করলেন। কিন্তু বারবার তাঁর কাছে আমার বিরুদ্ধে বলা হলে আমি তাঁর আস্থা হারাতাম। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বহু নেতা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে। অনেক সময় আমি বলি বঙ্গবন্ধুকে তো আমরাই মেরেছি। আমাদের সম্পর্কে বলা হয় বঙ্গবন্ধু ভালো ছিলেন, তাঁর আশপাশে যারা ছিল তাঁরা খারাপ। অথচ ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে, বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হলো। তাঁর আশপাশে যারা ছিলেন তাঁরা মন্ত্রী হলেন। তাঁরাই এখন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চান!
প্রশ্ন করলাম, ‘ আওয়ামী নেতৃত্ব আত্মসমালোচনা করছেন না কেন?
কাদের সিদ্দিকী উত্তর দিলেন, ‘ কি করে করবে? যারা দশ হাজার টাকা থেকে দশ কোটি টাকা বানিয়েছে তাঁদের কাছে আত্মসমালোচনা আশা করা যায় না।
আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষ হওয়ার পরও কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যে আলোচনা থেকে আমার মনে হয়েছে বর্তমান সরকারের প্রতি তাঁর প্রচন্ড বিরূপ মনোভাব থাকলেও আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব সম্পর্কেও তিনি কম বিরূপ নন। অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অস্বাভাবিক দূর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগের যে নেতারা মোশতাক সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের সম্পর্কে বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। এক পর্যায়ে বললেন, আমার তখন মনে হয়েছিল ভাগাড়ের শকুনের মত এরা বঙ্গবন্ধুর মাংশ নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের বিবরণ জানতে চেয়েছিলাম। নিশ্চিন্তপুরের ঘটনা ছাড়া অন্যগুলো বলতে তিনি ইতস্তত করছিলেন । এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘দুর্গাপুর থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত এই নব্বই মাইল দীর্ঘ এলাকায় যে কটা অপারেশন চালিয়েছি সব কটাতেই সাফল্য অর্জন করেছি। তবে এবার লড়াই করাই আমার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিলো না। আমার উদ্দেশ্য ছিলো রাজনৈতিক। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে তাঁদের প্রতিরোধ করাই ছিলো আমার উদ্দেশ্য। যাতে খুনী চক্র ভবিষ্যতে প্রগতিশীলদের ওপর আঘাত হানতে সাহস না পায়। আমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অনেকখানি সফল হয়েছে।’অপর এক প্রশ্নের জবাবে কাদের সিদ্দিকী জানিয়েছেন, তাঁরা যে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেগুলি তাঁর কাছে আগে থেকে ছিলো। ভারতীয় অস্ত্র তিনি এবার ব্যবহার করেননি।
উপসংহার
কাদের সিদ্দিকীর কার্যকলাপ সম্পর্কে ভারতের রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ইন্দিরা কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলি তাদের সম্পর্কে সমালোচনা মুখর। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের ইন্দিরা কংগ্রেসের সভাপতি অজিত পাঁজার মতামত জানতে চাইলে তিনি বললেন, কাদের সিদ্দিকীকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের কোন ভাতা বা অস্ত্র সাহায্য কখনো দেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’
পশ্চিমবঙ্গের জনতা পার্টির সভাপতি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন বললেন,’ওদের আগে ভাতা দেয়া হতো। জনতা সরকার ক্ষমতায় গিয়ে ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েকজন ছাড়া সবাইকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তাদের ভাতা দেয়া হচ্ছে কিনা আমার জানা নেই। দেয়া উচিত নয় এটা বলতে পারি।’
প্রবীণ সিপিআইএম নেতা আবদুল্লাহ রাসূল বললেন, ‘আমরা বরাবরই তাদের আশ্রয় দেয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম। তবে এ ব্যাপারে কার্যকর ভাবে আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিলো না। কারণ তাদের আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তটা কেন্দ্রীয় সরকারের।’
সি পি আই (এম-এল) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সম্পাদক এবং বিধানসভার সদস্য সন্তোষ রানা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘জনতা সরকার যদিও এদের অনেককে বের করে দিয়েছেন, আমি মনে করি সব কটাকে এক্ষুনি ইন্ডিয়া থেকে বের করে দেওয়া উচিত।’
ইন্দিরা কংগ্রেসের সমর্থক কিছু বুদ্ধিজীবী অবশ্য এদের প্রতি যথেষ্ঠ সহানুভূতিশীল। আওয়ামীলীগকে তারা বাংলাদেশে ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রতিনিধি বলে মনে করে। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে তাঁরা যথেষ্ট বিক্ষুব্ধ। তাঁরা মনে করেন বাংলাদেশে এখন প্রচন্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভয়াবহ ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ বিরাজ করছে যার প্রধান লক্ষ্য বস্তু হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামীলীগের কর্মীরা সবাই আত্মগোপন করে আছে কারণ তাদের ধারা মাত্র গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মীদের জীবন যে ততখানি দুর্বিষহ নয় এটা শুনে তাঁরা আশ্বস্ত হওয়ার পরিবর্তে আশাহত হয়েছেন বলে মনে হলো।
কাদের সিদ্দিকী ‘৭৫ সালে যখন তাঁর বাহিনী গঠন করেন তখন তাঁর দলের চূড়ান্ত পর্যায়ে দশ হাজারেরও বেশি সদস্য ছিলো বলে জানিয়েছেন তাঁর দলের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী। বর্তমানে সেটা কয়েক শ’তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই নেতাটি কাদের সিদ্দিকীর বিরোধীদলে অবস্থান করেন। ভারতে জনতা সরকারের আমল থেকে কাদের সিদ্দিকীর দলে মতপার্থক্য দেখা দেয়। কাদের সিদ্দিকীর বিরোধী দলের মত ছিলো, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যদি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করে জাতীয় নেতার মর্যাদা প্রদান করে এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেন তাহলে তাঁরা দেশে ফিরে যেতে রাজি আছেন। কাদের সিদ্দিকী এ মতের বিরোধিতা করায় তখন থেকে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কিছু কর্মী অসন্তুষ্ট বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কর্মীদের ভাতা বন্ধ করে দেয়ার ফলে এ বিক্ষোভ আরও ঘনীভূত হয়। তবে এখনও তাঁরা কাদের সিদ্দিকীকে ‘সর্বাধিনায়ক’ মনে করে তাঁর সঙ্গেই আছেন। আছেন এ কারণে যে, কাদের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন যাঁদের কথা কর্মীরা ভেবেছিলেন তাঁরা এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছেন না। এই দু’ই দলই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। আমার জানামতে সম্প্রতি কাদের সিদ্দিকী মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ২৭ এপ্রিল দিল্লী গেছেন আর তার বিরুদ্ধও দলের নেতার সঙ্গে মিসেস গান্ধী দেখা হওয়ার কথা ১০ মে।
কাদের সিদ্দিকী তাঁর রণকৌশল সম্পর্কে কিছু বলেন নি। তাঁর দলের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী বললেন, ‘তারা অপেক্ষা করছেন আওয়ামী লীগ যে কোন প্রকারে একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে তাঁরাও সেই মুহূর্তে আঘাত হানবেন। সেই সময় মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা থেকে তারা বঞ্চিত হবেন বলে এই নেতাটি মনে করেন না। নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরুদ্বিপ্ন হলেও কাদের সিদ্দিকীর দলের সাধারণ কর্মীরা সাধারণভাবে হতাশাগ্রস্থ । কয়েকজন কর্মী ফিরে আসার সময় আমাকে বললেন, ‘একটা কিছু করুন যাতে আমরা দেশে ফিরে যেতে পারি’।
—————————–
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1980.05.23-bichitra.pdf” title=”1980.05.23 bichitra”]