বাংলাদেশে আঞ্চলিকতার স্থান নেই- বঙ্গবন্ধু
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আঞ্চলিকতা টেনে এনে যারা শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়, তারা মেহনতী মানুষ তথা বাংলার জাতীয় শক্র। বঙ্গবন্ধু মঙ্গলবার আদমজী নগরে এক বিরাট শ্রমিক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। আবেগ-দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশে কোনো আঞ্চলিকতার স্থান নেই। শ্রমিক শ্রমিকই, তা সে যে কোনো অঞ্চলেই হোকনা কেন। বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের সবাই আমরা বাঙালি। প্রসঙ্গতঃ তিনি শ্রমিকদের কাছে প্রশ্ন তুলে বলেন, আপনারা যদি আঞ্চলিকতা টেনে এনে নিজেদের মধ্যে বিভেদ ডেকে আনেন, তাহলে কেন আমাকে জল্লাদের কারাগার থেকে, ফাসির দড়ি থেকে বের করে আনলেন? তিনি বলেন, সুখ-সমৃদ্ধি পূর্ণ এক সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছি। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে জেল খেটেছি, অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছি। আমার সেই স্বপ্নের বাংলায় যদি আঞ্চলিকতার কথা শুনতে হয়, তবে আগে আল্লাহ যেন আমার মুক্তি দেয়। (এই সময় আদমজি মাঠে বিশাল জনসমূদ্র হাত তুলে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেয় “আমরা আর আঞ্চলিকতা ও বিভেদকে প্রশ্রয় দিব না)।
উৎপাদন বাড়ান : শ্রমিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, কলকারখানার কাজে মন দিন। উৎপাদন বাড়ান। তিনি বলেন, গ্রামে লক্ষ লক্ষ মা-বোনের পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর নেই। আমার হাজার হাজার ছেলে বেকার, কলকারখানার উৎপাদন না বাড়ালে এদের জন্য কিছুই করা যাবে না। তিনি সমাজতন্ত্রের লক্ষে পৌছার জন্যে এবং শ্রমিকদের নীতিমালা মেনে চলার জন্য আহ্বান জনান।
কৃষকদের কাছে আমি একটি জিনিস চাই : বঙ্গবন্ধু বলেন, ধ্বংসস্তুপের মাঝে আমি প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। অর্থনীতি নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। এসব করণেই বলেছিলাম, “তিন বছরের মধ্যে আমি আপনাদের কিছু দিতে পারবো না।“ তা সত্ত্বেও গত দু’মাসে ১০০ কোটি টাকার ওপর রিলিফ দিয়েছি। ২৫ টাকা করে কর্মীদের মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। এবার কৃষক ভাইদের কাছে আমি একটি জিনিস চাইবো “আপনারা প্রতি বিঘা জমিতে মাত্র এক মণ করে যান বাড়ান।”
ভবিষ্যতে আর শোষণ থাকবে না : প্রধানমজী বলেন, সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে তা বাস্ত বায়িত হলে ভবিষ্যতে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের ওপর আর শোষণ থাকবে না। শ্রমিক নিজেরাই কলকারখানার ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে অংশগ্রহণ করবে।
বাড়াবাড়ি করলে ভালো হবে না : গোপন হত্যা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, একদল দুষ্কৃতকারী বিভিন্ন স্থানে গোপন হত্যা শুরু করেছে। গত দু’মাসে ৭০ জন আওয়ামী কর্মীকে রাতের অন্ধকারে গোপনে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এই সব দূষ্কৃতিকারীদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আমি এদের সাবধান করে দিচ্ছি, আর না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভালো হবে না। আইন-শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। যে জাতি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে না, সে জাতি বড় হতে পারে না। গণপরিষদ সদস্য জনাব শামসুদ্দোহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েল আহমেদ ও শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান এম, সি, এ বক্তৃতা করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রবল বারিপাতের ফলে মাঠে পানি জমে যাওয়া সত্ত্বেও হাজার হাজার মহিলা-পুরুষ অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। আদমজির শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে একটি রূপোর নৌকো উপহার দেয়া হয়।৬৪
রেফারেন্স: ১৮ জুলাই ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ