এবারের সংগ্রাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম- বঙ্গবন্ধু
মাইজদী কোর্ট। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, আজ বিকেল ৪টা থেকে সরকার কালোবাজারী, মজুতদার, মুনাফাখোর, চোরাকারবারী, হাইজাকার, দুষ্কৃতকারী ও অপরাপর সমাজবিরোধী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। আজ বিকেলে এখানকার শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে এক বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সমাজবিরোধী, গণবিরোধী লোকদের অশুভ তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। নতুবা সরকার তাদের গুলি করবেন বলে তিনি ঘোষণা করেন। জনসভায় বিপুল হর্ষধ্বনীর মাঝে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, অসাধু তৎপরতায় লিপ্ত লোকদের বিরুদ্ধে সরকার আজ থেকে ব্যবস্থা শুরু করেছে। এদের মধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ীরাও রয়েছে। এরা চাল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী মজুদ করে জনসাধারণের অশেষ দুর্ভোগের কারণ ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মজুতদার, চোরকারবারী, মুনাফাখোর এবং পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে খালি করে দেওয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও যারা বেআইনীভাবে তা দখল করে আছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি করেন। জনতার হর্ষধ্বনীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, প্রয়োজন হলে দুষ্কৃতকারীদের তাদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের আইন প্রণয়ন করা হবে। দেশে শান্তি স্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধু জনগণকে কঠোর পিরশ্রম করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সমাজে এমন অবস্থা অবশ্যই সষ্টি করতে হবে, যাতে জনগণ একান্তভাবে তাদের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে। তিনি জনগণকে সমাজবিরোধী লোকদের দূরভিসন্ধিমূলক তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। তিনি চোর-ডাকাত ও রাজাকারদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জনসাধারণকে পুলিশের সাথে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
জনসমুদ্র : খারাপ আবহাওয়া সত্ত্বেও জনসভার ময়দানে বিপুল জনসমাগম ঘটে। ময়দানের আশে পাশের রাস্তায় ও দালানের ছাদে বহু লোক জমায়েত হয়। জনসাধারণ তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে এক ঝলক দেখার জন্য গাছের ডালে, বাড়ির ছাদে, যে যেখানে পারে সুবিধামতো স্থানে স্থানে জায়গা করে নেন। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় ময়দান কর্দমাক্ত হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও শ্রোতারা ময়দানে আসন গ্রহণ করেন। গভীর আগ্রহভরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন। জনসাধারণ তাদের প্রিয় নেতাকে দেখার ও তার ভাষণ শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে সভায় আগমন করেন। জনসভার ময়দান ও আশেপাশের সারা এলাকা জুড়ে শুধু মানুষের মাথাই দেখা যাচ্ছিল- এটাকে জনসমুদ্র বলে মনে হচ্ছিল।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা : প্রধানমন্ত্রী তার ৪৫ মিনিটকাল ভাষণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। এবং তার দলের, তার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে দেশের স্বাধীনতাত্তোর পরিস্থিতির সুযোগে যারা জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, তিনি তাদেরকে হুশিয়ার করে দেন।
আওয়ামী লীগে যোগদানের আহ্বান : পুনঃ পুনঃ হর্ষধ্বনীর মাঝে বঙ্গবন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগ হলো জনগণের পার্টি। তার পার্টি জনগণের জন্য সংগ্রাম করেছে। এবং নিপীড়িত জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাবে। তিনি জনগণকে আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান।
পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা : বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ জনসাধারণের ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালায় তার বর্ণনা দানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা নিঃস্বার্থ কর্মীকে হত্যা করতে পারে নি, তারা মার্টিয়ার জনগণের আত্মবিশ্বাসকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। তিনি বলেন, আমরা যদি নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করি তবেই আমরা আমাদের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো। তিনি বিশেষ জোড়ের সাথে ঘোষণা করেন, বিদেশ থেকে পাওয়া সব সাহায্যই জনগণের মধ্যেই ও জনগণের জন্যই মাত্র দেওয়া হবে। তবে তিনি একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলে দেন যে, কষ্টার্জিত স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে তিনি কোনো সাহায্যই নেবেন না।
জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকার যা করেছে : জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকারি কার্যক্রমের বিবরণদান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেষ্ট রিলিফ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ ও অন্যান্য বকেয়া কর মওকুফসহ সরকার জনসাধারণকে প্রায় ১ কোটি টাকার মতো রিলিফ দিয়েছে। তিনি জনসাধারণকে দেশের যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার পরামর্শ দেন। তিনি আইয়ুব-ইয়াহিয়া-ইস্কান্দার মির্জার আমলের এক শ্রেণির দালালের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এরা কখনোই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয় নি। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা বর্ণনাদান প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা যা পেয়েছি, তাহলো দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি, বিধ্বস্ত ও লুণ্ঠিত গ্রাম-বন্দর-শহর। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকার এক অতি মানবিক দায়িত্বের সম্মুখীন হয়। স্বাধীনতার ফল ভোগের আগে তিনি জনগণকে তিন বছরের জন্য জনগণকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। জনসাধারণ হাত তুলে তার আহ্বানে সম্মতি জানান। তিনি বলেন, এর অর্থ এই নয় যে তিনি এ তিন বছরকালে কিছুই দিবেন না। যে সব সাহায্য আসবে তার সবই জনসাধারণকে দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের সম্পত্তির মালিক হচ্ছে দেশের সাড়ে ৭ কোটি লোক। তিনি বলেন, আমি দেশের সাড়ে ৭ কোটি লোকের ভালোবাসা পেয়েছি আর তাদের কল্যাণে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। তিনি ঘোষণা করেন, বাংলাদেশই এখানে জেলায় জেলায় কোনো পার্থক্য ও বৈষম্য নেই।
ধর্মের নামে শোষণ চলবে না : তিনি আরো ঘোষণা করেন, এখানে প্রতিটি লোকের নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের অধিকার রয়েছে। তবে ধর্মের নামে কেউ শোষণ চালাতে পারবে না। পাকিস্তানি শোষকদের নিকট হতে টাকা নিয়ে ধর্মের নামে কাউকে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।৮৫
রেফারেন্স: ২২ জুন ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ