কবি ও বঙ্গবন্ধু : এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য
বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধাভরে পুষ্পমাল্য পরিয়ে দিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। পরম স্নেহে বার বার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন কবির মাথায়। পিঠে। সর্বাঙ্গে। নির্বাক কবি অপলক দৃষ্টি মেলে তাকয়ে রইলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। হাত বাড়িয়ে বিড় বিড় করে কী যেন বল্লেন বঙ্গবন্ধুকে। বাকশক্তিহীন সে মুখের ভাষা বোঝা গেল না। দুর্বোধ্য সে একটি কথা। সে যুগে সদ্য প্রাণোচ্ছল কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরাধীন বাংলার সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন। তিনি বিদ্রোহের গান গেয়ে মুক মানুষের মুখে ভাষা ফুটিয়েছেন। জাগিয়ে তুলেছিলেন ঘুমন্ত বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে। দেশমাতৃকার মুক্তি পথে। কবির সে স্বদেশ ভূমি আজ স্বাধীন। বাঙালি জাতির মুক্তির আনন্দে উদ্বেল। কিন্তু মহা বিদ্রোহের কবিকণ্ঠ আজ নির্বাক। মুক মুখে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কবি এসেছেন এক নতুন বাংলাদেশে। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে। বিদ্রোহী কবি ও তার পরিবারের সদস্যরা থাকছেন ধানমন্ডিতে। ২৮ নম্বর রোডে দ্বিতল বাড়িতে। কোলকাতা থেকে ঢাকা আশার পর কবিকে দেখতে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সাথে ছিলেন মিসেস শেখ মুজিব। তাদের দু’মেয়ে ও ছোট্ট রাসেল। গণভবন থেকে কাজ সেরে বিকেল আড়াইটায় বঙ্গবন্ধু গেলেন তার ধানমন্ডির বাড়িতে। সাথে ছিলেন তার ক’জন অনুগামী। বাড়ি গিয়ে তিনি বুক সেল্ফ থেকে বের করলেন কবি নজরুলের কাব্য গন্থ সঞ্চিতা। আবেগ আর উচ্ছাস জড়িয়ে আবৃতি করলেন বিদ্রোহী কবিতা। তার পর মহাবিদ্রোহী “রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত’- চরণ দুটি আবৃতি করতে করতে সিড়ি বেয়ে সে নেমে আসলেন। তার বাড়ি থেকে ২৮ নম্বর কবির বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত সারাটি পথ আবৃতি করলেন কবিতার সেই চরণ দুটি হাতে তার পুষ্প নৈবেদ্য। সঙ্গে রয়েছেন মিসেস মুজিব। তার হাতেও ফুলের তোড়া। বঙ্গবন্ধু গেয়ে ঢুকলেন কবিকে যেখানে রাখা হয়েছে সে কক্ষে। শ্রদ্ধার সাথে পড়িয়ে দিলেন পুষ্পমাল্য। মিসেস মুজিব কবির হাতে তুলে দিলেন অতি সযত্নে নিজ হাতে বানানো ফুলের তোড়া। বঙ্গবন্ধু গভীর স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে দিলেন কবির মাথায়। পৃষ্ঠে নির্বাক কবি অপলক দৃষ্টিতে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। আর বিড় বিড় করে কি যেন বল্লেন সে এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য। বেশ কিছুক্ষণ বঙ্গবন্ধু কাটালেন। কবির সান্মিধ্যে তারপর কথাবার্তা বললেন কবির নাতি ও নাতনীদের সঙ্গে। তারপর বঙ্গবন্ধু নিজে তদারক করে দেখলেন কবির থাকার সব ব্যবস্থা। কবি ও তার পরিবারের সদস্যরা যাতে আরামে থাকতে পারে তার খুটিনাটির তদারকি করলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু যখন কবির সাথে সাক্ষাৎ করেন সে সময় বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীও সেখানে ছিলেন।৮৪
রেফারেন্স: ২৪ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ