You dont have javascript enabled! Please enable it! বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ প্রতিবেদন - সংগ্রামের নোটবুক

স্বরূপ অন্বেষা

|| বীরশ্রেষ্ঠ ||

<তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর। সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ- তাড়ানিয়া তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন সন্তান আমার। >

।। মাহফুজ উল্লাহ, চন্দন সরকার, কাজী জাওয়াদ, মাহমুদ শফিক।।

বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তের একটি গ্রাম। নাম খরোদা খালিশপুর। ঝোঁপ জঙ্গলে আকীর্ণ একটি মাটির ঘর, ওপরে ছনের চাল, জানা গেলঃ বিক্রি হয়ে গেছে সেটাও। সন্ধা নামতে না নামতেই গাঢ় হয়ে এলো রাত্রির ছায়া, চারপাশে ঝোঁপ- জঙ্গল বলেই হয়তো।

কথা বলতে বলতে উঠে গেলেন কায়সুন্নেসা। ফিরে এলেন ক্ষীণশিখা এক কুপি হাতে….

বিচিত্রার প্রতিবেদক কথা বলছিলেন সম্পাদকে টেবিলে, ঐ একটি কুপিই আছে সারাটা ভিটেয়। চারদিকটা ছিলো অন্ধখার। যখনই দরকার পড়ছিলো তখনই কায়সুন্নেসা ঘরের ভেতর যাচ্ছিলেন, আবার ফিরে আসছিলেন, – ঐ কুপিটা হাতে নিয়েই। এক মুহূর্তের জন্যও ঐ ক্ষীণ প্রদীপকে আমি আলোক বর্তিকা বলে ভাবতে পারছিলাম না।

একজন বীরশ্রেষ্ঠ – র বাড়ি হচ্ছে ঐ ভিটে। কায়সুন্নেসা তার মা, যার আলোর সংস্থানটুকু নেই।

বীর প্রমিথিউস হরণ করেছিলেন পরম সম্পদ আগুন এনে দিয়েছিলেন মানুষের হাতে। দেবতারা তাকে দিয়েছিল অভিশাপ, তাকে করেছিল বন্দী। কিন্তু সেই আগুনের আলোয় মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতা, ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র সেই বীর্যবত্তার অবদান। আর প্রমিথিউজ অপেক্ষায় থেকেছেন তার উদ্ধারকারী উত্তরসূরীর, যে বীর আসবেন বীরত্বের পুনরুদ্ধারে, তার প্রত্যাশায় সয়েছেন দেবালয় থেকে পাঠানোন শকুনি- গৃধিনীর খুবলে খুবলে খাওয়া।

বাংলাদেশের প্রমিথিউসরা কি বন্দী?

স্বাধীনতা ব্যক্তির অহংকার। স্বাধীনতা বাংলাদেশের অহংকার। স্বাধীনতার যে আলোয় আজ বাংলাদেশ উদ্ভাসিত, সে আলো এই সীমিত ভূখণ্ডকে পরিচিতি দিলেও স্বাধীনতা সৈনিকদের আত্মদানকে আলোকিত করতে পারেনি, তারা এখনো হয়তো বন্দী।

স্বাধীনতার যে সৈনিক জীবনের প্রিয় সম্পদকে স্বচ্ছন্দে উৎসর্গ করেছিলেন এক সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, সে সৈনিক আজ জাতীয় ভাবে বিস্মৃতির অতলে।

বীরত্বের যে গাঁথা, যে কাহিনী সময়ের স্রোতে পরিণত হবে প্রাণের কথায়, বর্তমানে বেঁচে আছে সে বীরত্বের এ বিভ্রান্ত পরাজিত ও অনালোকিত ইতিহাস।

শোণিত নক্ষত্র জ্বেলে আমাদের পথ দেখিয়েছেন কিন্তু ঘরে ফিরতে পারেন নি। অপরাজেয় সেই সৈনিকেরা আলোতে ফিরতে ফিরতে প্রমাণ করেছেন মানুষের ধ্বংস আছে, পরাজয় নেই।

পরাজয় নেই বলেই এই বাঙলাদেশেই কখনো কখনো উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার সৈনিকদের কথা। যারা স্বাধীনতার স্বপক্ষে, যারা বাংলাদেশের পক্ষে, একমাত্র তারাই উচ্চারণ করবেন এ কথা। এর পাশাপাশি এই নবজন্মকে অস্বীকার করার, সে বীরত্ব কাহিনী মুছে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে এই বাঙলাদেশেই।

যে স্বাধীনতা আমাদের গৌরবের প্রতীক, আমাদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, আমাদের সকল উৎকর্ষের ভিত্তি, সর্বোপরি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উন্নয়নের কাঠামো, আজ সে স্বাধীনতার মর্যাদা লুন্ঠিত৷

এই লুন্ঠনের ইতিহাস একদিনে তৈরী হয়নি। দিনে দিনে গড়ে উঠেছে এর কাঠামো। তৈরী হয়েছে মিথ্যা ও অসুন্দরের প্রলেপ।

মা তার সন্তানকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, গোটা বাংলাদেশ তার প্রিয়জনকে পাঠিয়েছিল রণাঙ্গনে। জীবনের সব কিছুর চেয়ে স্বাধীনতা দামী বলেই সেদিন সম্ভব হয়েছিল জাতীয় জীবনের এই বর্ণচ্ছটা। কিন্তু মেঘের ফাঁকে একটু আলোর ঝলকানির মতই শুধু এখন স্বাধীনতা। যুদ্ধের আলো, বীরত্বের আলো চোখে পড়ে। ব্যাপক অংশটাই এখন অন্ধকারে ঢাকা – ক্ষুদ্রতম অংশটা শুধু আলোকিত।

স্বাধীনতার প্রথম বছরে, ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন মন্ত্রীসভা বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য বাঙলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর নিয়মিত সৈনিক ও গণ সৈনিকদের জন্য চারটি উপাধি ঘোষণা করেন।

বীরত্বের মাপকাঠি অনুযায়ী সর্বোচ্চ মর্যাদার উপাধি বীর-শ্রেষ্ঠ, উচ্চ মর্যাদার উপাধি বীর- উত্তম, প্রশংসনীয় মর্যাদার উপাধি বীর – বিক্রম এবং বীরত্বের সার্টিফিকেট বীর – প্রতীক।

উপাধিগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, শত্রুর মোকাবেলায় মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বহুবিধ অসুবিধার মধ্যে বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্যে দেয়া হবে ‘বীর – শ্রেষ্ঠ’ উপাধি। এই উপাধির সঙ্গে নগদ দশ হাজার টাকাও পুরষ্কার দেয়া হবে। বাঙলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সব পদের নিয়মিত ও গণসেনা উভয়েই এই খেতাব পাওয়ার অধিকারী।

দ্বিতীয় খেতাব বীর- উত্তম, এ সঙ্গে নগদ পাঁচ হাজার টাকা এবং বীর- বিক্রম, এ সঙ্গে নগদ দু হাজার টাকা দেয়া হবে৷

উল্লেখিত তিনটি মানের পর্যায়ে পরে না কিন্তু স্বীকৃতির সামিল, এরূপ বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য দেয়া হবে বীর- প্রতীক উপাধি।

এই রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার সত্ত্বেও, জীবন- মৃত্যুর যে প্রাণোময় প্রদর্শনী স্বাধীনতার তূর্য ধ্বনিত করেছিল, তা স্মৃতিতে পর্যবসিত। মহিমান্বিত করণের প্রক্রিয়া এখন শেষ। আত্মত্যাগের কাহিনীই শুধু অবশেষরূপে বিরাজমান।

একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব শুধু আভিজাত্যের প্রতীক দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। স্বাধীনতার সংগ্রামের আহবান শিরোধার্য – করে যে শত সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছে – সে কথা ইতিহাস লেখে না। মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল বীরত্বের বিপুল বিশাল তরঙ্গের মধ্যে সরকারী ভাবে দেয়া ৬৭৬ টি পদকই এখানে একমাত্র ইতিহাস।

১৯৭০ এর ১৫ ডিসেম্বর সরকারী গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী যে পদকগুলো দেয়া হয়, তার মধ্যে সাতজন পেয়েছেন মরণোত্তর বীর-শ্রেষ্ঠ, আটষট্টি জন বীর-উত্তম, একশ পঁচাত্তর জন বীর বিক্রম আর চার’ শ ছাব্বিশ জন পেয়েছেন বীর প্রতীক।

স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল পদকগুলো দেয়া হবে আনুষ্ঠানিক ভাবে। স্বাধীন পতাকার নিচে বীরের মিছিল আন্দোলিত করবে গোটা দেশ ও জাতিকে৷ হাত ধরে বর্তমানকে নিয়ে যাবে ভবিষ্যতে।

কিন্তু সেদিন সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি৷ গোটা জাতিকে শুধু ঘোষণায় বন্দী করে উত্তরাধিকারীদের জানিয়ে দেয়া হয় ঘোষণা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেদিন দেয়া হয়নি কোন পদক। আনুষ্ঠানিক ভাবে, বীরদের প্রিয়জনদের কাছে কেউ বহন করেনি জাতীয় মর্যাদার সংবাদ। কেননা, ভয় ছিল রণক্ষেত্রের, সত্যিকার যোদ্ধা বীরদের জয়গান ম্লান করে দেবে বীর সেজে বসা প্রতারকদের জোর করা সম্মানকে। রাজনৈতিক আততায়ী, যারা সেদিন রণক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে থিয়েটার রোডে বসে নিজের ওপর নিজেই চাপিয়ে দিয়েছিলেন সেনাপতির মর্যাদা, সেদিন তাদের প্রয়োজন ছিল বাস্তব বীরত্ব – গাঁথাকে শুধু ঘোষণায় বন্দী করা। দলীয় স্বার্থকে মহিমান্বিত করার জন্য সার্টিফিকেট বিতরণ করা৷ তাই সেদিন শুরু হয়েছিল সার্টিফিকেট বিতরণের খেলা। এ কারণেই রাতারাতি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা স্ফীত হয়ে ছাড়িয়ে যায় কয়েক লক্ষ।

একজনের ইচ্ছেয় তৈরী হতে থাকে স্বাধীনতার নতুন ইতিহাস, যুদ্ধের নতুন কাহিনী। মুছে দেয়ার চেষ্টা হয় ষে কাহিনী যেখানে ‘শত্রপক্ষ যখন মাত্র ৭০ গজের মধ্যে এবং নিজ পক্ষের নয় জন এরই মধ্যে নিহত এবং আরো বহু আহত হয়েছে৷ এমতাবস্থায় তিনি এল এম জি নিয়ে ক্রমাগত ভাবে যুদ্ধ করে নিজ পক্ষকে অপসারণে সহায়তা করেছেন। অবশেষে শত্রুপক্ষ দ্বারা ঘেরাও হয়ে আত্মসমর্পণের জন্য বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি ‘জয় বাংলা’ ও ‘ইয়া আলী’ বলে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শহীদ হন।

এ কাহিনী শুধু একক বীরত্বের কাহিনী নয়। এমনি হাজারো কাহিনী আছে বীরত্বের, আত্মত্যাগের। কিন্তু দেশকে জানতে দেয়া হয় নি সে কাহিনী। আয়নার প্রতিবিম্বের মত সে কাহিনী শুধু ভেসে ওঠে বাঙলাদেশের আয়নায়, থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বীরের মর্যাদা কি হবে? এ প্রশ্নের জবাব নীতিকথায় দেয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় গেজেট নোটিফিকেশন দিয়ে তা স্বীকার করা। দুঃখজনক হলেও, এ মর্যাদা প্রদানের পেছনে নেই কোন প্রমাণ উল্লেখ (Citation)। বীর শ্রেষ্ঠদের প্রমাণ উল্লেখও সরকারীভাবে হারিয়ে গেছে।

এর পাশাপাশি অন্য কাহিনীও আছে৷ জনৈক কুদ্দুস মোল্লাকে বীর প্রতীক উপাধি দিয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে তার বীর বিক্রম উপাধি। দুটি ঘোষণাতেই স্বাক্ষর করেছেন একই সরকারী কর্মকর্তা।

এ কারণেই প্রশ্ন ওঠে। বীরত্বের জন্য পদকই যদি দেয়া হয়, তাহলে তা প্রত্যাহার করা হয় কিভাবে? তাই সন্দেহটা সংগত কারণেই। আর এর পেছনে যে রাজনীতি পুতুল খেলার মত – ছিল অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে বাঁধা।

স্বীকৃতির কাহিনীও আছে। আছে বীরদের জন্য নিভৃতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভালোবাসার কাহিনী। কিন্তু সে ভালোবাসা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বীর যোদ্ধাদের পরিবারকে দিতে পারেনি কোন নিশ্চয়তা। তাই বীরত্বের প্রতীক নিয়ে এক মহিলা এসেছিলেন সাহায্যের আশায়। তার স্বামীর নামে রাস্তার নামকরণ হয়েছে। কারো নামে জাহাজের নামকরণ হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তব, নির্মম সমস্যার সমাধান হয়নি। বীর পরিবারেরা যাপন করছেন নির্মম মানবেতর জীবন।

রাষ্ট্রশক্তি কখনো এককভাবে এই কাহিনীকে ধরে রাখতে পারবে না। এ স্মৃতিকে ছড়িয়ে দিতে হবে জীবনের প্রতিটি অস্তিত্ব – সে দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের প্রত্যেকের।

‘যদি ভালবাসো, তবে নীরবেই তোমাদের অন্তরে লিখে রেখো আমাদের নাম’, শহীদের জড়-অবশেষ যেন অসম্মানিত না হয়। শহীদের উৎসর্গের মিনার যেন হতে পারে আলোকসজ্জিত, সূর্যের সঙ্গে করে জ্বলজ্বল – নক্ষত্রের সঙ্গে ঝলমল।

স্বাধীনতা অনিঃশেষ এক চিরবহমান স্রোতধারা – সে কেবল বয়েই চলে, কখনো থামে না।

সেই ক্ষীণশিখা প্রদীপ, বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বীর প্রসবিনী মাতা যা জ্বালিয়ে রেখেছেন, আমাদের চেতনাকে তা আলোকিত করতে ব্যর্থ।

আমাদের জাতীয় অহংকারের অনুভূতি প্রতিদিন আহত হচ্ছে। আত্মদানই যদি মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে থাকে, তবে তা যথেষ্ট হয়েছে। যদি বীরত্ব প্রদর্শনই কাঙ্ক্ষিত হয়ে থাকে, তাও হয়েছে যথেষ্ট। সীজারকে আমরা শুধু সম্মানিত করি না – তার প্রশস্তিও গাই৷

***

সিপাহী হামিদুর রহমান

শীতের বিকেল। সূর্য অস্ত যেতে যেতে ঘন্টা খানেক বাকী। বাস থেকে নেমে পানের দোকানে ঠিকানাটা দেখাতেই দোকানদার বলল, আরে, ও বেটি তো এখানেই ছিল। দাড়ান দেখি। বলেই কিছুক্ষণ ঘুরে সঙ্গে নিয়ে এল একজন মহিলাকে। বয়স ৫০/৫৫ এর মত। হয়ত এক সময় শ্যামলা ছিলেন, এখন রোদে পুড়ে কালো৷ পরনে মোটা লাল পেড়ে সাদা শাড়ী৷ অন্য কোন অবয়ব বা আভরণও নেই শরীরে। পা ও খালী।

এই মহিলাই মোসাম্মৎ কায়সুন নেসা। বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের মা। ‘৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়ে যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভেবেছিলেন দেশ স্বাধীন হলে দরিদ্র মানুষের দূর্দশা লাঘব হবে। তার যে মা – ভাইয়েরা পরের বাড়িতে এবং জমিতে মজুর খেটে একপেট, আধপেট খেয়ে জীবন নির্বাহ করে তার অবসান ঘটবে। কিন্তু তা’ হয়েছে কি? – প্রশ্নবোধক চিহ্ন চোখে এঁটে তাকালেন কায়সূন নেসা। কায়সূন নেসা গ্রামের সহজ সরল খেঁটে খাওয়া মহিলাদেরই একজন। কথায় কোন ঘোর প্যাঁচ নেই। সোজা প্রশ্ন।

প্রশ্নটি মনে রেখেই তাকে বাড়ি যাওয়ার কথা বললে, স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বললেন, চল বাপু।

রিক্সায় প্রায় তিন মাইল। এবরো খেবরো গ্রামের কাঁচা ধুলো ওড়ানো রাস্তা।

কায়সূন নেসার বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন সন্ধা হয় হয়। শীত জমে উঠেছে। কিন্তু তখনও কায়সূন নেসার বাড়িতে যে কয়জন সদস্য উপস্থিত, কারো গায়ে গরম কাপড় দূরে থাক, কাপড়ই ছিল না।

বাড়ির তিনটি ঘরের (দুটো মাটির দেয়াল ও ছনের চালার এবং একটি অসম্পূর্ণ সেমি পাকা), একটির বারান্দায় পাটি বিছিয়েই বসার জায়গা হল। কায়সূনকে ছেলে হামিদুর রহমানের কথা জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি৷ বড় ছেলে হামিদই ছিলেন সংসারের উপার্জনশীল ব্যক্তি। তিন বছরের হামিদকে নিয়ে কায়সূন ও আক্কাস আলী মন্ডল ভারত বিভক্তির পর ‘৪৭ সালে ২৪ পরগণার চাপড়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামের বাড়ি – জমিজমা ফেলে চলে আসেন তৎকালীন পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এই গ্রাম খরোদা খালিশপুরে।

এর পর পুরো পরিবারের জীবন সংগ্রাম ছিল নির্মম বাস্তব৷ ক্রমে হামিদরা হয়েছেন তিন ভাই ও তিন বোন। অন্যের বাড়িতে দিন মজুর খেটে দুই ভাই ও পিতা মিলে বর্তমান ভিটেটি কেনেন হামিদ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগেই। এর মাঝে আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীরও সদস্য হন হামিদ। অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হামিদ গ্রাম্য খেলা হাডুডু ইত্যাদিতেও ছিলেন পারদর্শী।

টানাপোড়েনের সংসার বলেই লেখা পড়া তেমন করতে পারেন নি হামিদ। খালিশপুর স্কুল ও পরবর্তীতে স্থানীয় নাইট স্কুলে কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। অন্য ভাইবোনদের কারো ভাগ্যেই পড়োশোনা জোটেনি৷ তবে হামিদের সততা সম্পর্কে অন্ততঃ আশেপাশের কারো কাছ থেকে কোন অভিযোগ পাওয়া যায় নি। বরং সবাই প্রশংসা করেছেন। যখন যেখানেই যে কাজে গেছেন, সে কাজে তিনি ছিলেন সৎকর্মী। ফলে কদর ছিল সবার কাছেই৷ কাজের অভাব ঘটতো না৷ পাঁচ বেলা নামাজ পড়তেন৷ সমাজকর্মীও ছিলেন। বিশেষ করে আশেপাশে কেউ মারা গেলে হামিদকে দেখা যেত সবার আগে। দাফনের কাজে৷ রাজনীতি তিনি সক্রিয় ভাবে করতেন না। তবে ষাটের দশকের শেষার্ধের উত্তাল দিনগুলোতে দেশ স্বাধীনের কথা মনে ধরত তার।

হামিদ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান আমলের একবারে শেষের দিকে। ট্রেনিং – এর পর বাড়ি এসেছিলেন একবার। ২৫ মার্চে পাক বাহিনীর সার্বিক আক্রমণের মুখে সেনাবাহিনীর চাকরী স্থল থেকে চলে আসেন বাড়িতে। কিন্তু মাত্র এক রাত্রির জন্য। পরের দিনই চলে যান। মা কায়সূন শেষ বার দেখেন তাকে সে দিনই। তারপর আর দেখেননি। খোঁজও পাননি কোথায় ছিলেন হামিদ। হামিদ যুদ্ধ করেছেন কোথায়?

যাওয়ার সময় কোন কথা হামিদ তা মাকে বলেছিলেন কিনা জানতে চাইলে কায়সূন জানান, ‘হ্যাঁ, ঈদে খরচ পাঠাবে বলেছিল, কিন্তু সে টাকা আর পাই নাই।’ কায়সূন বলতে পারেননি যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন হামিদ।

দেশ স্বাধীন হলে কায়সূন – আক্কাস ভেবেছিলেন ছেলে ফিরে আসছে৷ কিন্তু না, ফিরে আসেনি ছেলে৷ কবে, তখন তা মনে করতে পারেননি কায়সূন – শুধু বলেছেন, স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে সেনাবাহিনীর একটি চিঠি ও সেই সঙ্গে ৫০০ টাকার চেকে জানতে পারেন, ছেলে আর নেই। ঢালাইপুর সীমান্তে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে ৩০০ পাক সেনাকে হত্যা করেছেন। স্বাধীন হওয়ার দু দিন আগে তিনি যুদ্ধে নিহত হন। এর পরে শেখ মুজিব একটি চিঠি ও সেই সঙ্গে এক হাজার টাকা পাঠান কায়সূনের নামে। কায়সূন তার ছেলের মৃত্যু সম্পর্কে এটুকুই জানেন।

বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের সংসারের বর্তমান পরিস্থিতি কি? বিয়ে তিনি করেননি। কিন্তু তিনি রেখে গিয়েছিলেন মা, বাবা ২ ভাই, ৩ বোন। এদের মধ্যে এক ভাই বিয়ে করেছেন, ২ বোনের বিয়ে হয়েছে৷ কায়সূন তার সবচেয়ে ছোট মেয়ের (১০) দিকে তাকিয়ে বলছিলেন এর বিয়ে হয়ে গেলে বাঁচি। ছেলে দুটি আছে – ওরা পরের জমি বর্গা নিয়ে হালচাষ করছে৷ তাতে আর কি হয়?

আপনার ছেলে দেশের সর্বোচ্চ পদক পেয়েছের। এতে আপনি সুখী? – প্রশ্নের উত্তরে কায়সূন জানান, হ্যাঁ, খুশী। কিন্তু আমি তো আর ছেলে পাব না। আমার সংসার চলে কি করে? কায়সূন আরো জানালেন, শেখ মুজিব পরে আরো দু বার বছরে ২০০০ টাকা করে মোট ৪০০০ টাকা দেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন দশ হাজার টাকা ও ৭ বান টিন দেবেন। কিন্তু তা আর পাওয়া যায় নি।

বীর শ্রেষ্ঠ পদক ও অন্যান্য চিঠিপত্র দেখতে চাইলে দেখাতে পারেন নি কায়সূন। তিনি জানান, গত চৈত্রে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পদক নেয়ার জন্য চট্টগ্রাম গেলে সেখানে সবই খোয়া গেছে৷ আরো জানান, পদক তিনি পান নি৷ চৈত্র মাসে চট্টগ্রাম গেলে তাকে সেনাবাহিনীর পদকের সঙ্গে ৫০০০ টাকাও দেয়া হয়, একটি ঘর করে (অসমাপ্ত ঘরটি) দেন স্থানীয় সি. ও, চেয়ারম্যান এরা। এ ব্যাপারে কায়সূন শুনেছেন, ঘর করার জন্য না কি সরকার থেকে ১৪০০০ টাকা দেয়া হয়েছে। তাতে যে ঘর হয়েছে (২৪’*১২’) তা’ বাসের অযোগ্য। কাঁচা মেঝে, ছাদহীন বারান্দা এবং এক ইটের দেয়ালের এ ঘরে নেই কোন পার্টিশন দেয়াল। টিনের যে চালা দেয়া হয়েছিল তাও প্রয়োজনের চেয়ে খাটো হওয়ায় বিগত বৈশাখী ঝড়ে উড়ে যায়। এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে৷ কায়সূন জানালেন, দেখুন, এ ঘরে কি থাকা যায়? এর উত্তর একটিই, না।

এ ছাড়া কাঁচা যে দুটো ঘর রয়েছে তার একটিতে থাকেন বিবাহিত ছেলে৷ বাকীটাতে অন্য সবাই। কায়সূনের এ ঘরটির ছনের চালা বিক্রি হয়েছে এক বছর আগে। দয়া পরবশ হয়ে যিনি কিনেছেন আজো তা নেন নি। তাই থাকতে পারছেন তিনি। চালাটি নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন ক্রেতা। এর পর কি বলবেন, কোথায় থাকবেন – এ অসহায় প্রশ্নের জবাব চেয়েছেন কায়সূন।

কায়সূন একজন বীরশ্রেষ্ঠের মা হিসেবে যা পেয়েছেন তা’ কায়সূনের বক্তব্য অনুযায়ী এই। এছাড়া তিন একর জমি দেয়ার কথা বলেছিলেন সাবেক ডিসি। বর্তমান ডিসি নাকি বলেছেন সাড়ে চার একর জমির কথা। কিন্তু কোনটাই হয় নি৷ বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের মা জানেন না তার ছেলের কবর কোথায়? বা তার ছেলের স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু করা হয়েছে কি না?

আলাপ করতে করতে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এর মাঝে জ্বালানো হয়েছে সর্বসাকুল্যে বাড়িটি আলোকিত করার ব্যর্থ প্রয়াসের একমাত্র কালির দোয়াত দিয়ে তৈরী কেরোসিনের কূপীটি। এ ম্লান আলোয় চলে আসার মুহূর্তে ‘আপনার কোন কথা আছে কি?’ প্রশ্নের জবাবে কায়সূন বললেন, ‘আমি কি বলব। আমার ছোট মেয়েটির বিয়ে এবং থাকার ঘর চাই।’

হয়ত কায়সূনের মত বীর শ্রেষ্ঠ মাতারা যে প্রায়ান্ধকার ম্লান আলোয় বাস করেন তাদের পক্ষে এর চেয়ে বেশী পাওয়ার আশা বা বলার আশাও করা যায় না। এটাই রূঢ় বাস্তব। কারণ তিনি বীর শ্রেষ্ঠের মা হলেও তাকে কাজ করতে হয় অন্যের বাড়িতে। যখন চলে আসছি পেছন থেকে কায়সূন বললেন, ‘হামিদের বাবা মারা গেছেন দু’ বছর আগে। তোমরা লিখলে আমার কিছু হবে।’

***

ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ

নড়াইল শহর থেকে দশ মাইল দূরে দত্তপাড়া। দত্তপাড়া থেকে ৫ মাইল সম্পূর্ণ কাঁচা রাস্তা। কোথাও বা মেঠো পথ। এরপর মহিষখোলা গ্রাম। মহিষখোলার বীর শ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মহীদ নূর মোহাম্মদের পৈত্রিক ভিটাটি এখন শুন্য। হাল দেয়া হয়েছে। মাটির ঢেলা ওঠানো একটি তরকারীর বাগান।

মহিষখোলার নূর মোহাম্মদের পৈতৃক ভিটে খুঁজে পেতেও হয়রানীর সীমা ছিল না। ঢাকা থেকে তার যে ঠিকানা নেয়া হয়েছিল, সে ঠিকানাও ছিল না। ঠিকানা ছিল গ্রাম মহেশখালী, পোঃ বকসীপুর। নড়াইল নেমে একজন পুলিশ সিপাহীকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, নড়াইলে তো এমন কোন গ্রামের নাম আমি জানি না। তবে নড়াইল শহরের অর্ধেকই তো মহিষখোলা। ওপাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে পেয়ে যাবেন।

এরপর রিক্সায় মহিষখোলা ঘুরেও কোন হদিশ মেলেনি।

ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল নূর মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী তোতাল বিবির এ্যাডভোকেট তবিবুল ইসলামকে। তিনিই দিলেন নূর মোহাম্মদের হদিশ। কারণ, তার মুহুরি সৈয়দ ইয়াকুব আলী একই এলাকার লোক। তার কাছেই নিশানা মিলল নূর মোহাম্মদের ভিটের। এ কথা বলা এজন্য যে, একজন বীর শ্রেষ্ঠের ঠিকানাও আমরা সঠিকভাবে ঢাকা থেকে যোগাড় করতে পারি নি।

নড়াইল থেকেই জানা গিয়েছিল নূর মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী তোতাল বিবি থাকেন যশোরে। তবে তার সম্পর্কে জানা যাবে শ্বাশুড়ির কাছ থেকে। সে ভাবেই নূর মোহম্মদের বাড়ি থেকে অল্প দূরেই তার শ্বশুর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শ্বাশুড়ি মাঠে গেছেন উনুন জ্বালানোর ‘খড়ি’ যোগাতে।

এলেন তিনি। নূর মোহাম্মদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘মেয়ে তোতাল বড় কষ্টে আছে, সে কি সাহায্য পাবে?’

নূর মোহাম্মদর শৈশব সম্পর্কে জানালেন, ছোটবেলাতেই পিতৃ-মাতৃহীন হন তিনি। পৈতৃক ভাবে বেশ জমি জমা ও একটি বড় টিনের ঘর পেয়েছিলেন নূর মোহাম্মদ। কিন্তু মাথার ওপর তেমন কোন অভিভাবক না থাকায় সব বিক্রি করে বসে বসে খান তিনি। অন্য দিকে শখও ছিল প্রচুর। যাত্রা, থিয়েটার, জারী, হাডুডু খেলা ইত্যাদিতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করেই সব উজাড় করে দেন। এর মাঝেই এক সময় বিয়ে করেন। ধরতে গেলে পাশের বাড়ির মেয়ে তোতালকে। পরে শ্বশুর বাড়িতেই বাস করতে থাকেন তিনি। পড়াশোনা করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত। হাই স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু পাশ হয়নি৷

প্রথম স্ত্রী তোতাল জানান, ‘এমন সৌখিন লোক ছিল যে একটা কলের গানও কিনেছিল।’ এ সময়ে নূর আনসার বাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন।

পরে এক সময় হঠাৎ করেই একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যান চাকরীর অন্বেষায়। দেড় বছর পর একটি চিঠি ও কাপড় চোপড় পাঠিয়ে তোতাল বিবিকে জানান তিনি বিডিআর – এ যোগ দিয়েছেন। জমি জমা বিক্রি করে কোন বাজে নেশা তিনি করতেন না – এ কথা অবিশ্যি তার আশেপাশের লোকদের কাছ থেকে জানা গেছে।

নূর মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে যান তিনি নিজে ‘৬৯ এ। মেয়ে জামাই অবশ্য স্বাধীনতার পর বিডিআর – এ চাকরী পেয়েছেন।

নূর মোহাম্মদের দ্বিতীয় স্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ওরফে ফজিলা থাকেন মহিষখোলা থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ধুরিয়ায় ‘বাপের বাড়ির গ্রামে’। নূর মোহাম্মদ এ বিয়েটি করেন প্রথম পক্ষের ছেলেটি যখন গর্ভাবস্থায় তখন। এ বিয়ের কাহিনী আছে৷ দু স্ত্রী দুই ভাবে ব্যক্ত করেন এ কাহিনী। প্রথম স্ত্রীর বক্তব্যঃ দ্বিতীয় স্ত্রী ফজিলা ছিলেন আসলে প্রথম স্ত্রী তোতালের সৎ ভাইয়ের স্ত্রী। বিয়ের পরই ফজিলার প্রথম স্বামী অসুস্থ হন৷ সে সময় নূর মোহাম্মদ আসেন দেখতে (শ্বশুর বাড়িই তখন তার বাড়ি)। এ সময়ই ফজিলাও প্রথম শ্বশুর বাড়ি আসেন। এখানেই পরিচয়। তার পর বিয়ে। এ বিয়েতে প্রথম আপত্তি ছিল তোতালের। পরে অবশ্যি মেনে নেন।

দ্বিতীয় স্ত্রী ফজিলার বক্তব্যঃ চাকরী স্থল থেকে নূর মোহাম্মদ যে টাকা পয়সা পাঠাতেন তা’ দিয়ে শ্বশুর-শ্যালকরা নিজেদের নামে জমি জমা করেন। শ্যালক মারা যাবার পরে এ জমির কারণেই শ্বশুর বাড়ি (উভয়ের) থেকে এ বিয়ের আয়োজন করা হয়। এতে ফজিলার পিতা আবদুল মালেকের আপত্তি থাকলেও পরে রাজী হন তিনি। এর পরেই বিয়ে হয়। আগে থেকেই প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বাড়ির সঙ্গে বনিবনা ছিল না বলে এরপর স্থায়ীভাবে বাস করেন ফজিলার সঙ্গে।

দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে নূর মোহাম্মদের রয়েছে তিন মেয়ে। মেয়ে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে এবং দুই মেয়ে ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবে।

নূর মোহাম্মদের সঙ্গে শেষ যোগাযোগ কখন হয় জানতে চাইলে প্রথম স্ত্রী বলেনঃ ‘৬৯ সালে। সে সময় মেয়ের বিয়ে দেন। এ সময় তার কর্মস্থল ছিল দিনাজপুর। মেয়ে ও মেয়ে জামাই সে সময় দিনাজপুর বেড়াতে গেলে তাদের সঙ্গে তাদের ও তোতাল এবং ছেলে মোস্তফার জন্য কাপড় চোপড় ও টাকা পয়সা দিয়ে দেন। মেয়ের জামাইকে একটা ঘড়িও দেন তিনি। এই তার শেষ যোগাযোগ।

দ্বিতীয় স্ত্রীর বক্তব্যঃ বিয়ের পর পর স্বামীর সঙ্গে চলে যান তার চাকুরী স্থলে। পরে ধুরিয়া গ্রামেই কিছু জমি কিনে বর্তমানে যেখানে তিনি বাস করছেন, এ ভিটে কিনে একটি টিনের ঘর করে এখানে রেখে যান তাকে। এর পর ছুটি ঠাটায় এখানেই আসতেন। মাঝে মাঝে ফজিলাও যেতেন স্বামীর কাছে। ‘গন্ডগোলের’ আগে রোজার মাসে এক রাত্রে এসেছিলেন। ঈদের মধ্যে আসার কথা ছিল। কিন্তু হরতাল চলছিল বলে আসেন নি। এ সময় তার পোস্টিং ছিল যশোরে৷ এখান থেকেই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কুষ্টিয়া সীমান্তে। এ পর্যন্তই জানেন তিনি।

দুজনেই বলেছেন, নূর মোহাম্মদ স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তা জানতে পারেন হায়েনা বাহিনী তাদের যখন খোঁজ করেন তখন।

নূর মোহাম্মদের মৃত্যু সংবাদ সম্পর্কে তোতাল বিবি জানান, স্বাধীনতা লাভের প্রায় তিন মাস পর একটি চিঠি ও ২০০০ টাকার একটি চেক পান। এতেই প্রথম মৃত্যু সংবাদ সম্পর্কে জানেন। নূর মোহাম্মদের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে তোতাল বিবি জানান, এ সবই শোনা কথা। শুনেছি, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি আহত অবস্থায় ছিলেন দিনাজপুরের কুটিবাড়ী হাসপাতালে। ওখান থেকে তার পোস্টিং হয় চুয়াডাঙ্গায় চতুর্থ ব্যাটেলিয়নে। এরপর যান ভারতে। সেখান থেকে পরে চলে আসেন যশোরের কাশীপুর বোয়ালখালী সীমান্তে। ক্যাপ্টেন হুদা ছিলেন কমান্ডিং অফিসার। এখানেই শহীদ হন তিনি।

উভয় স্ত্রীই অবিশ্যি চৌগাছায় নূর মোহাম্মদের কবর জিয়ারত করেন পরে বিডিআর – এর সৌজন্যে।

বর্তমানে বড় স্ত্রী রয়েছেন যশোরে। ছোট স্ত্রী ধুরিয়ায়। দু’ জনকেই সমান মাপের দুটো সেমি পাকা ঘর করে দেয়া হয়েছে যাতে তিনটি করে কামরা রয়েছে। তোতাল বিবি পাচ্ছেন মাসে ৫৪.৭৫ টাকার পেনসন। মাসে রেশন পাচ্ছেন আট সের চাল, ষোল সের আটা, দুই সের তেল ও দেড় সের চিনি। আর পাচ্ছেন বিডিআর – এর কল্যাণ তহবিল থেকে ১০০ টাকার মাসিক ভাতা। ফজিলাও পাচ্ছেন একই রকম।

এ পর্যন্ত সাহায্য পেয়েছেন ৫০০০০ টাকার বাড়িটি, ৫০ হাজার টাকার প্রাইজ বন্ড ও ৫ হাজার টাকা। বীর শ্রেষ্ঠের পদকটি রয়েছে বড় স্ত্রীর কাছে।

নূর মোহাম্মদের যা কিছু সম্পত্তি ছিল, দু ভাগে ভাগ হওয়ায় সামান্যই জুটেছে। বড় স্ত্রী যে ৫ কাঠা জমির ওপর বাড়ি করেছেন, তা কিনেছেন নিজে ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে। টাকা এখনও সম্পূর্ণ শোধ হয়নি। ছেলে গোলাম মোস্তফা ক্লাশ নাইনের ছাত্র। কাজেই অনটন নিত্য সঙ্গী। ছোট স্ত্রীরও তিনটি মেয়ে। প্রত্যেকেই পড়ছে। তারও একই ব্যাপার।

বিদায় নেয়ার সময় উভয়েই বলেছেন, এদের পড়াশোনা কি হবে? আর কিভাবেই বা বাঁচবো?

বড় স্ত্রীর জমি নিয়ে উপরন্তু মামলা চলছে। তিনি বলেছেনঃ এ জমি টুকু উদ্ধার না হলে কোথায় দাড়াবো?

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ূর রহমান

মনিপুরিপাড়ার বাড়িটিতে এখনো আছে প্রাণের স্পন্দন। আছে চারটি মানুষ। কিন্তু নেই আনন্দ। সকল আনন্দ কেড়ে নিয়ে গেছেন একজন। বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। মতিউর রহমান জীবন উৎসর্গ করেছেন এদের সহ এদেশের সকল মানুষের সুখ সমৃদ্ধির জন্য। কিন্তু তা’ হয় নি।

মেয়ে মাহিন, তুহিন আর বিধবা মিলি রহমানের হারানোর বেদনা যেমন আছে, তেমনি আছে বঞ্চনার দুঃখ। আর্থিক সাচ্ছন্দ্য হয়ত নেই, কিন্তু একেবারে যে চলছে না এমন নয়। কিন্তু আছে মানসিক যাতনা। আর এই যাতনাতেই দগ্ধ হচ্ছেন মিলি রহমান – মাহিন, তুহিন।

মতিউর রহমান ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে অবশিষ্ট বাঙ্গালী অফিসারদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত। অন্ততঃ পাক কর্তৃপক্ষের কাছে। এ সুবাদেই সবচেয়ে ভয়ংকর অথচ মহান উদ্যোগটি নেয়া সম্ভব হয়েছিল মতিউর রহমানের পক্ষে।

মতিউর রহমান বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন খেয়ালের বশেই। তবে মতিউর ছিলেন এডভেণ্চারিস্ট। মিলি রহমানের ভাষায়, সব শেষের করুণ পরিণতির উদ্যোগটি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের কারণেই। এর দু – দুবার তিনি মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। একবার বিমান এবং পুনর্বার গাড়িতে। কিন্তু দু’ বারই বেঁচে গিয়েছেন অলৌকিক ভাবে। তাই বিশ্বাস করতেন, তিনি বিমান দূর্ঘটনায় মারা যাবেন না। কাজের সফলতা সম্পর্কে এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন মতিউর রহমান যে জন্য তিনি সঙ্গে পিস্তলটি পর্যন্ত নেননি শেষ আত্মরক্ষার জন্য।

‘৭১ এর ২০ ই অক্টোবর ছিল মতিউর রহমানের অপারেশনের তারিখ। উদ্দেশ্য ছিল স্যবর জেট নিয়ে করাচি থেকে চলে আসবেন ভারতে। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু কোন পরিকল্পনার কথাই খুলে বলেন নি মিলিকে। ১৯ তারিখের রাতে একটি স্বপ্ন দেখার কথা বলেছিলেন মতিউর। স্বপ্নটি ছিলঃ প্লেনে চড়ে স্টার্ট নিচ্ছেন কিন্তু কে যেন পেছন থেকে টেনে ধরছে। তিনি আর যেতে পারছেন না। যাবার আগের রাতে মিলিকে কিছুই বলেননি তিনি। মিলি রাতে দু’ তিন বার জেগেও দেখেছেন মতিউর বসে। ভোরে একবার মিলির কাছে শুলেও উঠে গেছেন কিছুক্ষণ পরই। কিছুই বলা হয় নি। এর পরই যাত্রা শুরু। অন্যান্য দিনের মত মিলি খোদা হাফেজও বলতে পারেন নি। কারণ মতিউর পেছন ফিরে গাড়িতে বসেছিলেন, আর ফিরে তাকান নি।

মতিউর ২৫ শে মার্চের পর চলে গিয়েছিলেন দেশের বাড়ি। এ সময় মিলিকে রেখে যান তার বাপের বাড়ি। পরে অবিশ্যি মিলিকে নিয়েই চলে যান করাচী। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মতিউর দেখেছিলেন একজন অসহায় শিশুর কান্না। এই কান্নাই তাকে প্ররোচিত করে পাকিস্তানীদের ঘৃণা করতে। এমনকি তারা কেউ সালাম জানালেও প্রত্যাখ্যান করত সে।

মিলি মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন ২১ তারিখে। এর পর মিলিকে নিয়ে যাওয়া হয় মালি ক্যাম্পে। সেখানে আড়াই বছরের মাহিন ও তুহিনকে কোলে নিয়ে নির্জন এক ঘরে এক নাগাড়ে ৭ দিন জেরা করা হয় তাকে। বাসায় যে বাঙ্গালী ছেলেটি ছিল অত্যাচারে তার দুটো কানই নষ্ট হয়ে যায়।

পরে মালি ক্যাম্প থেকে তাকে নামিয়ে দেয়া হয় শুন্য অবিন্যস্ত বাসায়। এ সময় কোন পাকিস্তানীই ঠাঁই দিতে চায় নি মিলিকে। মিলি আশ্রয় নেন পরে তার বোনের বাসায়।

‘৬৮ সালের ১৯ এপ্রিল মতিউরের সঙ্গে মিলির বিয়ে হয় মনিপুরী পাড়ার এই বাসাটিতেই। বি, এ পাশ মিলি এখন শিক্ষকতা করেন ঢাকার একটি স্কুলে। সে স্কুলেই পড়ে মাহিন ও তুহিন। একজন এবার ক্লাশ সিক্সে এবং অন্য জন ক্লাশ ফোরে পরীক্ষা দিয়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠের বিধবা পত্নী মিলি রহমান এ পর্যন্ত যা সাহায্য পেয়েছেন তা’ হচ্ছেঃ শেখ মুজিবের আমলে প্রথম পাওয়া ৫০০০/- টাকা। তা শ্বাশুড়ীর কাছে জমা রাখেন তিনি। পরে অবিশ্যি তা বাচ্চাদের নামে ব্যাংকে জমা রাখেন তিনি।

এ ছাড়া বিমান বাহিনীর তরফ থেকেও এককালীন কিছু টাকা পেয়েছেন। এখন পাচ্ছেন দুই মেয়ের জন্য ৫০/- টাকা করে ১০০/- টাকা এবং নিজের জন্য ১০০০/- টাকা মাসে। প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্রুপ ইন্সুরেন্সের টাকা আজো পান নি। তবে পেয়েছেন পারসোনাল ইনসুরেন্সের টাকা ৩০০০০/-। বাচ্চাদের এ্যালাউন্স এবং এই ৩০০০০ /- টাকাও বাচ্চাদের নামেই ব্যাংকে রেখেছেন মিলি রহমান। বীমার টাকা পেতেও ডেথ সার্টিফিকেটের কারণে তাকে হয়রানি হতে হয়েছে বহুদিন।

মিলি রহমানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, দিন চলে কেমন করে? তিনি জানান, শিক্ষকতা থেকে পাই মাসে ৭০০/- টাকা আর টিউশনি করে পাই ৫০০/- টাকা – এই দিয়েই চলছে। বাসা পেয়েছি বাবার। তাই তার ভাড়া লাগে না। তবে বর্তমানে দুর্মূল্যের বাজারে সম্ভবত আর চলবে না।

মতিউরের স্মৃতি আজ মিলি রহমানের কাছে যন্ত্রণা। ‘৭১ এর ১৯ মার্চ মতিউরের এক বন্ধু মারা যায় দূর্ঘটনায়। বন্ধুর স্ত্রীকে সাদা শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে তার মনে প্রতিক্রিয়ার জন্ম নেয়। মিলিকে তিনি বলেছিলেন, আমি যদি মারা যাই তবে এ রকম সাদা শাড়ি পরো না। মতিউরের আরো ইচ্ছে ছিল তার মেয়েরা ভালো স্কুলে পড়বে। মেয়েরা সেই পছন্দ করা স্কুলেই পড়ছে। কিন্তু মতিউর নেই। আরো একটি ঘটনা মিলি রহমানকে আজো নাড়া দেয়। তা হচ্ছেঃ ২৩ তারিখে মতিউর মারা যান। এর আগে ১৬-১৭ তারিখে মিলিকে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে কিনে দেন সালোয়ার কামিজ।

এ সবই এখন মিলির কাছে স্মৃতি। এই বিষাদময় স্মৃতির মাঝেও গর্বিত স্মৃতি হচ্ছেঃ এর আগে একদিন মিলিকে নিয়েই ফ্লাই করতে চেয়েছিলেন মতিউর। বিমানে উঠেছিলেনও কড়া পাহাড়ার মধ্যে। কিন্তু ফ্লাই করতে পারেন নি। মিলির এ ব্যাপারে আপত্তি ছিল। কারণ, প্লেনে বাইরে থেকে ‘ইগনিশন’ না করলে ওড়ার চান্স থাকে শতকরা ৫০ ভাগ। এই ৫০ ভাগ বিপদের ঝুঁকি নেয়ার ব্যাপারেই আপত্তি ছিল মিলির। এজন্য মতিউর মিলিকে তিরস্কারও করেছিলেন। মতিউরের সাহস ও দেশপ্রেমের এই গর্বিত স্মৃতিটি মিলি রহমানকে আজও আন্দোলিত করে।

মিলির অনুশোচনা রয়েছে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে৷ বাস্তব কারণে একান্ত বাধ্য হয়েই করেছিলেন দ্বিতীয় বিয়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। মতিউরের মেয়ে মাহিন তুহিনও এখন দাদু বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন।

মিলি বলেছিলেন, প্রথম ক্লাশ ফোরে পড়াতে গিয়ে মতিউর সম্পর্কে পড়াতে হত। বর্তমান কারিকুলামে তা’ নেই। এজন্য তিনি দায়ী করেন নিজেকে৷ মিলি খুশী হয়েছেন, খুশী হয়েছে মাহিন-তুহিনও, যশোরে মতিউরের নামে এয়ার বেস হওয়ায়। মাহিন – তুহিনও যশোরেই থাকতে চেয়েছিল।

সব কিছুর পরও মিলি বলছেন, ওরা বড় হচ্ছে। খরচ বাড়ছে। আর কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। কি যে করব?

মতিউর নেই। সে উত্তরাধিকার গোটা জাতির। সমগ্র জাতি কি করছে তা’ মিলি জানেন না৷ কিন্তু মিলি রহমান এবং মাহিন-তুহিন সে দুঃসহ স্মৃতি বহন করে চলেছেন৷ আর তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছেন হারানোর শোকে।

***

সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা

বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফার স্ত্রী পুত্র এখন আর বাড়ীতে থাকেন না। বরিশাল জেলার দৌলৎখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে সে বাড়ীতে এখন থাকেন পিতা, মাতা, ভাই-বোন।

শীতের বিকেলে তার বাড়ীতে পৌছে দেখতে পেলাম উঠোনে উঠেছে নতুন ধান৷ কয়েকটি মুরগী হাঁস নে ধান খুটে খুটে খাচ্ছে।

বাড়ীতে একটিই ঘর। টিনের চাল, আলকাতরার প্রলেপ দেয়া কাঠ ও বাঁশের বেড়া। সামনের বসার ঘরটিতে একটি হাতলঅলা চেয়ার, একটি চৌকি৷ চৌকিতে নতুন একটি তোশক গুটিয়ে রাখা। এ ঘরেরই অর্ধেক অংশ বেড়া দিয়ে ধানের গোলা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফার বাবা অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাড়ীতে ছিলেন না। তার মা বিলাপ করে করে বাড়ীর ভেতরের ঘর থেকে কথা বলছিলেন।

পুত্র শোকের চেয়ে তার কাছে বড় শোক, নাতিকে কোলে কাখে নিতে পারেন নি – লালন করতে পারেন নি। জানালেন মোস্তফা যখন মারা যান তখন তার ছেলের বয়স মাত্র দেড় মাস। তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর কয়েক দিন ঘুরে আসার জন্য তার স্ত্রী বাপের বাড়ী যান৷ কিন্তু কোন দিন আর ফিরে আসেন নি।

বাড়ীতে এখন মোস্তফার ছোট ভাই, দুই সন্তানসহ এক বোন এবং বাবা মা থাকেন। ছোট ভাই চাষাবাদ করেন৷ লেখাপড়া কিছু করেন নি।

কিছুক্ষণ পর হাবিলদার হাবিবুর রহমান ফিরে এলেন। তিনি জানান মোস্তফা সেনাবাহিনীতে যোগ দেন বাড়ী থেকে পালিয়ে। মোস্তফার বাল্যাবস্থায় পিতা সেনাবাহিনীর হাবিলদার থাকা কালে দু’ বার সপরিবারে চাকরীস্থলে ছিলেন। তখন থেকেই মোস্তফার মনে ফৌজপ্রীতি জাগে। ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে বাড়ী থেকে পালিয়ে চট্টগ্রাম যান এবং সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন।

মোস্তফার বিয়ে হয়েছিল বাল্যাবস্থায়। মাতামহির আগ্রহে মামাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মোস্তফার পড়াশোনা বেশী দূর এগোয় নি। প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে দু’ এক বছর লেখা পড়া করেন। তিনি ছিলেন গ্রামের দস্যি ছেলে। এই ডানপিটেন দস্যিপনায় পাড়ার সবাই তটস্থ থাকতেন। তবে চাকুরী পাওয়ার পর গ্রামের সবার সঙ্গেই সদ্ভাব রেখে চলতেন। ছিলেন খুব ফুর্তিবাজ মানুষও।

মোস্তফার মায়ের কথানূযায়ী তার স্ত্রী মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মন খারাপ হয়ে যায় বলে বাপের বাড়ী যান। সেখানে ‘পাঁচজনে তাকে খারাপ করে।’ তার বাবা মা ভাবেন যে মোস্তফার স্ত্রী এখন ‘মোটা টাকা’ পাবে। সেই লোভে তাকে তারা আর আসতে দেন নি। তার পর থেকে নাতিকে দেখতে পান নি।

মোস্তফার স্ত্রী তার বাড়ীতে না থাকায় মোস্তফার উত্তরাধিকারী কে হবেন তা নিয়ে সংকট দেখা দেয়। মোস্তফার পরিবার থেকে বলা হচ্ছে, ‘মোস্তফার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর দু’ বার বিয়ে হয়। প্রথম বার মোস্তফার শ্যালক জোর করে বিয়ে দেন। সে বিয়ে মাত্র কয়েকদিন টেকে৷ তারপর মোস্তফার স্ত্রী নিজে ‘পছন্দ ‘ করে বিয়ে করেন। তাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ‘ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। মোস্তফার পরিবার থেকে কাবিন নামার অনুলিপি পর্যন্ত নাকি আদালতে দাখিল করা হয়। মোস্তফার স্ত্রী বিয়ে করেন নি বলে আদালতে দাবী করেন।

মোস্তফার পরিবার থেকে তার ছেলে বাচ্চুকে পিতৃকুলে নিয়ে আসার জন্য নাকি ৫-৬ বার চেষ্টা করা হয়। ছেলেকে দিয়ে দিলে মোস্তফার স্ত্রী সরকারের দেয়া টাকা পয়সার কিছুই পাবেন না, সেই ভয়েই ছেলেকে ছাড়ছেন না। মোস্তফার স্ত্রী তার (স্ত্রীর) ভাইয়ের ছেলের কাছে খুলনায় থাকেন। ভাইয়ের ছেলের খুলনায় কাঠের কারখানা আছে। ছেলে বাচ্চু খুলনায় লেখাপড়া করে।

মোস্তফার মা দাবী করেন কিছুদিন আগেও তারা নাতিকে দেখার জন্য পিঠা, ইলিশ মাছ, কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে খুলনা যান। মোস্তফার স্ত্রী সেসব কাপ চোপড় রেখে দিয়েছেন কিন্তু নাতিকে এক পলকের জন্যও দেখতে দেন নি। মোস্তফার মা মনে করেন ছেলে- বৌ ঘরে থাকলে, নাতি চোখের সামনে থাকলে তিনি পুত্র তিনি পুত্রশোক কিছুটা ভুলতে পারতেন।

মোস্তফার পেনশন থেকে তার মা পান মাসে ২৮ টাকা, ছেলে পায় ৩০ টাকা। এছাড়া মোস্তফার বাবা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার পর ৫ হাজার টাকা এবং সামরিক বাহিনীর শহীদদের জন্য প্রদত্ত দু’ হাজার টাকা পান। তা দিয়ে কিছু জমি তারা কিনেছেন। ৪০ শতাংশ কিনেছেন মোস্তফার ছেলের নামে। মোট জমির পরিমাণ ২ একরের কিছু বেশী। জমির আয়ই এ পরিবারের একমাত্র আয়। এতে সংসার চলে না৷ সরকার থেকে তাদের জন্য বাড়ী তৈরী করে দেবেন বলে সম্প্রতি জরীপ হয়ে গেছে।

সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার আছে কিনা জানতে চাইলে মোস্তফার পিতা হাবিবুর রহমান (স্থানীয় ভাবে হাবিব মিলিটারী বলে পরিচিত) জানান, ‘আসমানের চান নামাইয়া দিলে সেগুলিন দিয়া ছেলেরে ভুলতে পারুম না। লাখ টাকা দিলে খুশী হই না। ‘

আমাকে মোস্তফার পিতা মনে করেছেন গোপন অনুসন্ধানী সংস্থার সদস্য। মোস্তফার মায়ের পেনশনের টাকা বন্ধ করার জন্য তদন্ত করতে আমি গিয়েছি মোস্তফার স্ত্রীর কোন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। নয়তো যে বিল্ডিং সরকার করে দেবে সে বিল্ডিং করার মত জায়গা তাদের আছে কিনা দেখতে। আমার পরিচয়পত্র দেখানোর পরও আমাকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সন্দেহ ও ভয় ছিল বলেই মোস্তফার পিতার সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় স্থানীয় দু’ জন গণ্যমান্য লোক সঙ্গে রেছেছিলেন।

***

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

পুত্র যার বীরশ্রেষ্ঠ, যা সন্তানের রক্তে মুক্ত এ দেশ, তাকে এখন সান্তনা দেয় এ দেশের সাধক কবির গান। বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের পিতা আবদুল মোতালেব হাওলাদার কবিয়াল মুকুন্দ দাসের গানকেই অবলম্বন করে বেঁচে আছেন। সুন্দর সুরেলা কন্ঠে তিনি গাইলেন – ‘আমি চাই এমন মানুষ / আমি চাই এমন প্রাণ / বক্ষে যাহার আকাশ খানি / চক্ষে যাহার স্নেহের খনি / আমি চাই এমন মানুষ এমন প্রাণ / হবে কি গো এমন মানুষ / হবে কি গো এমন প্রাণ।’

আবদুল মোতালেব হাওলাদার। বয়স সঠিক বলতে পারেন না। আনুমানিক ষাটের ওপর, সারাজীবন পিতৃ ভিটায় বাস করেছেন। ছেলে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ায় তার মনে কোন আক্ষেপ, অভিযোগ, আনন্দ ছিল না। তবে এটা বেশ বোঝা যায়, পুত্রশোকে বৃদ্ধ ম্রিয়মাণ হয়ে গেছেন। নিয়তির হাতে সমর্পণ করেছেন ভাগ্যকে। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায়, মনে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে বললেন, ‘মাবুদরে ডাকি আর কই, মাবুদ বড় ঘরে তুমি ফালাইলা, আমি তো কোন দিশা পাই না।’ ধর্মের দিক্ষা থেকে অর্জিত বিশ্বাসে বলেন, ‘জাতির জন্য আমার ছেলেকে কোরবানি দিলাম, এতে আমার কোন কষ্ট নাই।’

বরিশাল শহর থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে আবদুল মোতালেব হাওলাদারের বাড়ি। পিতামহ আবদুর রহিম হাওলাদার বেশ প্রতাপশালী সম্মানী লোক ছিলেন। গ্রামের নাম তারই নাম অনুসারে। জনাব মোতালেব হাওলাদারের তিন ছেলে, তিন মেয়ে ছিল। একটি ছেলে তিন বছর বয়সে মারা যায়।

বড় ছেলে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৬৬ সালে আইএসসি পাশ করে বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু চোখের কারণে বিমান বাহিনীতে যোগ দিতে পারেন নি। পরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদান করেন।

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর ছোটভাই মন্জুরের লেখাপড়া বেশী দূর এগোয় নি। কলা বিভাগে এইচএসসি পাশ করে এখন সংসারের হাল ধরেছেন।

তিন বোনের মধ্যে বড় বোনের স্বামী নৌ বাহিনীতে চাকরীরত। তার তিন মেয়ে তিন ছেলে। মেজ বোনের স্বামী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য। ছোট বোন খালিদা রেবা বরিশাল সরকারী ব্রজমোহন কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে সম্সান পরিক্ষার্থী।

আবদুল মোতালেব হাওলাদার ওরফে কালা মিয়ার সংসার চলে ৫ একর ১৬ শতাংশ জমির আয়ের ওপর। ছেলের পেনশন পান প্রতিমাসে ২০০ টাকা। এ টাকা আমৃত্যু পাবেন। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই বোনদের লেখাপড়ার জন্য আর্মি হেডকোয়ার্টার এস ও পি ফান্ড থেকে পাওয়া যায় ১২৫ টাকা মাসে। শর্ত হলো এদের বয়স ২০ বছরের বেশী হলে সে টাকা আর পাওয়া যাবে না। ছোট ভাই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। ছোট বোন রেবা এখনো পড়ছে। ১৯৭৫ সালে এ টাকা পাওয়ার পর তিনটি চিঠি পেয়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বয়স প্রমাণের সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য। পরে অবশ্য দেখা গেছে বয়স ২০ বছর পার হয়ে গেলেও যে দিন থেকে এ টাকা দেয়া হচ্ছে তার পর দশ বছর পর্যন্ত সে টাকা পাওয়া যেতে পারে। তাই এ টাকা এখনও পাওয়া যাচ্ছে।

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বিয়ে করেননি বলে রেশন পেতে পারেন না। কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থায় তার পরিবারকে রেশন দেয়া হচ্ছে ৫ম ও ৭ম রিভেরাইন ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটেলিয়ন থেকে। দুটো ব্যাটেলিয়ন এক মাস পর পর পালা করে রেশন দেয়ার কথা। এর মধ্যে ৫ম ব্যাটেলিয়ন থেকে নিয়মিত রেশন পাওয়া যায়। ৭ম ব্যাটেলিয়ন থেকে তা নিয়মিত পাওয়া যায় না।

মরহুম জাহাঙ্গীরের পিতা ছেলের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুই হাজার টাকা, গ্রাচুইটি আট হাজার চারশ টাকা, বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবের জন্য দশ হাজার টাকা, ১৯৮০ সালের সেনাবাহিনী দিবসে পাঁচ হাজার টাকা, আর্মি বেনেভোলেন্ড ফান্ড থেকে ১৯৮০ টাকা, ৬ মাসের বকেয়া বিল চার হাজার পাঁচশ টাকা এবং ১৭ শ বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে এক হাজার টাকা, মোট ৬২ হাজার আটশ আশি টাকা পেয়েছেন। এ থেকে এখন আছে হাজার দশেক টাকা। বাকি টাকা খরচ হয়ে গেছে।

অধিকাংশ টাকাই খরচ হয়েছে মরহুম জাহাঙ্গীরের মায়ের চিকিৎসার জন্য। মা সাফিয়া খাতুন পুত্রশোকে তালকানা হয়ে গেছেন অনেকটা। উনুনে জ্বালানী কাঠের বদলে পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তার একার চিকিৎসার জন্যই মাসে প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা পিতা মাতা দুজনেরই আছে। দুজনের কারও চিকিৎসা আশেপাশে দু চার গ্রামের মধ্যে হয় না। জেলা সদরে যেতে হয়, তাই খরচও কিছুটা বেশী।

আবদুল মোতালেব হাওলাদার মায়ের অত্যন্ত আদরের ছেলে ছিলেন। মা তাকে লেখাপড়া বিশেষ শিখতে দেন নি। মাইনর পাশ করেছিলেন। যখন তার বয়স ৫ বছর তখন তার মা তাকে বিয়ে করান – কণের বয়স ছিল তিন বছর। তার সে স্ত্রী অল্প বয়সেই মারা যান। পরে তিনি বর্তমান স্ত্রীকে বিয়ে করেন।

জন্মের পর থেকে পিতৃ ভিটায় আছেন – মাঝে মধ্যে দু’ চার জনের অনুরোধে বেড়িয়ে গেছেন ঢাকা বা আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে। বাপ দাদার ভিটের বাংলা ১৩২১ সনে স্থাপিত একটি এক তলা দালান আছে। তিনি তার এক অংশের মালিক। সে অংশে দুটো শোবার ঘর, একটি খাবার ঘর ও ১ টি বসার ঘর। সব মিলিয়ে মেঝের আয়তন ৪০০ বর্গফুট হবে। বসার ঘরে সামান্য রোদের আলো আসে৷ শোবার ঘর দুটো অন্ধকার। ঠাউরে চলতে হয়। তা না হলে তক্তপোষ ও অন্যান্য পুরান মলিন আসবাবে ঠোকর লাগার সমূহ সম্ভাবনা। এই দালানের ওপর অংশীদার থাকার কারণে এবং অর্থাভাবে সংস্কার হয় না। চুনকামের বদলে মাটি লেপে দেয়া হয়েছে। তাতেই ঝুলছে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের মুক্তিযোদ্ধা থাকাকালীন সময়ের বিবর্ণ ছবি। ফ্রেমে আটা বিবর্ণ ছবি দেখেই দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় বৃদ্ধার, বৃদ্ধের।

শহীদ জাহাঙ্গীরের আরও কিছু স্মৃতি চিহ্ন আছে বরিশাল শহরে তার মামা মতিউর রহমান খানের বাসায়। আছে কয়েকটি বই – রক্তে রাঙা লাওস, বিপ্লবী চে গুয়েভারা, ইয়েনান থেকে শ্রীকাকুলাম, চট্টগ্রাম বিপ্লব, কম্বোডিয়া নয়াফ্রন্ট, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রসঙ্গে। আছে একটি ব্যাগ, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি পেন্সিল টর্চ। ব্যাগে জাহাঙ্গীরের রক্তমাখা একটি চেক জামা ছিল। তার মা ঐ জামা নিয়ে কান্নাকাটি করতেন বলে জামাটি পরে নষ্ট করে ফেলা হয়। এ জিনিসগুলো এখনো পারিবারিক ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ – এর নামানুসারে চাঁপাই নবাবগঞ্জের নাম রাখা হয়েছিল জাহাঙ্গীরাবাদ। এখন সে নাম নেই।

রহিমগঞ্জে একটি জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় মরহুমের নামে। ছাত্র সংখ্যা ১১১। স্কুলটির অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়।

১৯৭৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্কুল টেক্সট বুকরবোর্ডের সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে শহীদের একটি কাহিনী ছিল৷ বইটির নতুন সংস্করণ প্রতি বছরই বেরুচ্ছে। এখন তাতে তার নামও নেই।

খালিদা রেবার কাপড় আছে দুই সেট, পাঠ্যবই তিনটি, একটি কলম ও একটি ঘড়ি। মাসে ৫ দিস্তা কাগজ লাগে।

মায়ের ৫-৬ টি সাধারণ শাড়ী আছে ভাই ও মেয়েদের কাছ থেকে পাওয়া। বাবার তিনটি পাঞ্জাবী আছে ট্রেটনের। মেয়েরা তা দিয়েছে। বাচ্চুর ২-১ টি প্যান্ট সার্ট আছে।

সরকার এদের বাসস্থান করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। সার্কেল অফিসার সে বিষয়ে তদন্ত করছেন। বাড়ীর পরিকল্পনা নাকি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ করে দেবে।

বাচ্চুকে নিজের পায়ে দাড়াতে সাহায্য করার জন্য কয়েক জন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা তাকে সরবরাহ ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। বাচ্চু সম্প্রতি সেনাবাহিনীতে স্টেশনারী দ্রব্যাদি সরবরাহ করে হাজার দুয়েক টাকা লাভ করেছেন। এর অর্ধেক পাবেন যিনি টাকা দিয়েছেন ব্যবসা করার জন্য।

সংসারটি সচ্ছন্দে চলছে না। অন্তত যতখানি সচ্ছন্দে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আত্মদান করেছিলেন, ততখানি সচ্ছন্দে তো নয়ই। গ্রামে এদের বাড়ী করে দিতে সরকার আগ্রহী হয়েছেন, এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু গ্রামের বাড়ী তাদের শুধু মাথার ওপর আচ্ছাদনই দেবে। অন্য কোন উপকার তাদের হচ্ছে না। অন্তত বরিশাল শহরেও যদি একটি বাড়ী করে দেয়া যেত, তবে তাদের কষ্টের কিছুটা লাঘব হতো।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের পরিচয় তার এলাকায় জাহাঙ্গীর ভাই হিসেবে। ছেলে বুড়ো সবাই এক নামে চেনে।

তার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল নিজ ভূবনে সম্রাজ্ঞী একজনের। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তিনি একজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ীর সহধর্মিণী হয়েছেন।

***

মোহাম্মদ রুহুল আমিন

মোঃ রুহুল আমিন (বীর শ্রেষ্ঠ), নৌবাহিনী নব প্রতিষ্ঠিত নৌবাহিনীর জাহাজ ‘পলাশ’ এ থাকাকালীন অবস্থায় শত্রু হামলা ও গোলাগুলি উপেক্ষা করে শত্রুর আক্রমণ থেকে জাহাজকে ভাসমান রাখতে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। জাহাজটি শত্রু ঘাটি খুলনা আক্রমণ করার অভিযানে নিয়োজিত ছিল। তার এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ইতিহাসে সাহস ও বীরত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

***

ল্যান্সনায়েক মুনসী আবদুর রউফ

‘আমার রউফ চিঠি লিখেছিল, মা আর ক’ টা দিন সবুর করো। ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হোক। আমি নতুন শাড়ি নিয়ে বাড়ি আসবো। কিন্তু রউফ বাড়ি ফেরেনি।’ সে স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন বীর শ্রেষ্ঠ মুনসী আবদুর রউফের মা মুকিদুন নেছা।

শীতের শুকনো নদীর মতো চোখ। স্মৃতিতে ধূ ধূ করে স্বপ্নের চোরাবালি। ৬৫ বছরের থুত্থুরে বুড়ি। শরীরের ত্বক কুঞ্চিত হয়ে গেছে বয়সের ভারে। তিনি বললেন, আমার রউফ বড় কষ্টে মানুষ হয়েছে। ওর বাবা মারা যান ১৯৫৫ সালের জৈষ্ঠ মাসে। তখন রউফের বয়স ছিল ১১ কি ১২। ভীষণ দুষ্ট ছিল ও। যখন সে দেখলো, তার বাবাকে চাদর মুড়িয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে, তখন প্রশ্ন করেছিল রউফ, ‘মা, সত্যি কি বাবা মারা গেছেন?’ আমি তখন কিছু বলতে পারিনি। শুধু বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিলাম।

রউফের বাবা মুনসী মেহেদী হোসেন ছিলেন বাড়ির কাছে মসজিদের ইমাম। সামান্য জমি ছিল তার। বড় ছেলে রউফ, দুই মেয়ে জহুরা (২৮) ও হাজেরাকে (২৪) সংসারে রেখে মারা যান তিনি। এরপর এদের ভরন পোষণের ভার পড়ে মা মুকিদুন নেছার ওপর। এই অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, তিনি নিত্যদিন অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে। সংসার চলত না, তাই পরের বাড়ির কাঁথা সেলাই করতাম, শিকা তৈরী করতাম। তাতে কোনরকমে সংসার চলত। আর স্বপ্ন দেখতাম, দূর ভবিষ্যতের। রউফ বড় হবে। বড় হয়ে চাকরী করবে। তখন আর আমাদের সংসারে এ কষ্ট থাকবে না। আস্তে আস্তে রউফ বড় হয়েছে। মেট্রিক পাশ করার আগেই সংসারের টানে চাকরী নিতে হয়েছে।

১৯৬৩ সনে মুনসী মোহাম্মদ আবদুর রউফ চাকরী নেয় বি ডি আর – এ। তখন প্রতিবেশীরা অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তার মা বলেন, তবু আমার ছেলেকে চাকরীতে পাঠিয়েছি। বুকের ছেলেকে ঠেলে দিয়েছি যুদ্ধে। কিন্তু আজ আর আমার মনে দুঃখ নেই। আমার রউফ যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। শ্রেষ্ঠ বীর হয়েছে। কিন্তু আমার বুক তো খালি হয়েছে। বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বীরের মাতা!

ঢাকা থেকে ১০৮ মাইল দূরে কামারখালি ইউনিয়নের সালামতপুর গ্রামে শহীদ ছেলের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। গ্রামের লোকজনের শ্রম ও সামান্য জমিই হচ্ছে সম্বল। রউফদের পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতির দয়ার ওপর নির্ভরশীল তাদের জীবন। এ সম্পর্কে বললেন তার মা, আমাদের মোট চার / পাঁচ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ বাড়ির পরিমাণ। প্রায় সবটুকু ধানী জমিই ভেঙ্গে নিয়ে গেছে মধুমতী নদী। এখন আর তেমন কোন আবাদী জমি নেই। ‘৭৮ সালে একজন ক্যাপ্টেন লিখেছিলেন, ‘জেলা প্রশাসক ফরিদপুরের নিকট আপনার আর্থিক সাহায্য ও কিছু খাস জমি বরাদ্দ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল।’ এই চিঠি পাওয়ার পর চিঠির মর্মার্থ অনুযায়ী বোয়ালমারী থানা সার্কেল অফিসার (রাজস্ব) ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু খাস জমি আজও বরাদ্দ করা হয়নি। আমাকে বলা হয়েছে কোথায় জমি আছে, জানান। কিন্তু আমি মেয়ে মানুষ, বুড়ো হয়ে গেছি। এতো কিছু খবরা – খবর কি আমার পক্ষে জানা সম্ভব, কথায় খাস জমি আছে, কোথায় নেই। প্রায় প্রতি বছরই বন্যায় ফসল নষ্ট হয় সালামতপুর গ্রামের। এবার আমার জমিরও ফসল নষ্ট হয়েছে। প্রায় জমি ভেঙ্গে নিয়েছে। তাই কোন ধান পাইনি। আর তাই ছেলের পেনসন ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা আর মাসিক ভাতা ১০০ টাকাতেই সংসার চালাতে হয়। প্রতি মাসে পেনসনের টাকা আনতে হয় ফরিদপুর থেকে। প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর পাই ভাতা। আর এভাবেই বীর মাতা তার সংসারের অভাব অনটনের কথা বর্ণনা করলেন। এছাড়া প্রতি পনের দিন অন্তর পান রেশন। ৮ সের চাল, ৮ সের গম, আধা সের তেল, এক সের চিনি। সংসারে লোক সংখ্যা চার। রউফের নানী, মা, একজন কাজের মেয়ে ও একজন সাহায্যকারী ছেলে, সম্পর্কে ভাতিজা।

চারজনের সংসার সোয়া দু’ শ টাকায় চলে না। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, পঁচিশ হাজারের মত টাকা পেয়েছি বিভিন্ন খাত থেকে। এ টাকায় কিছু জমি কিনেছি। এখন হাতে টাকা নেই। চোখে কম দেখি। একটা চশমা দরকার। কিন্তু সংসারের টাকা থেকে চশমা কেনার সঙ্গতি নেই। তাই চশমাও কিনিনা। সরকারকে বলবেন, আমার একটি চশমা দরকার।

বীরের মা হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন তিনি৷ প্রতি বছরই বীর শ্রেষ্ঠের মা হিসেবে সেনাবাহিনী, বি ডি আর থেকে ডাক পড়ে তার। সম্মানিত হন, সেল্যুট পান, প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন।

বীর শ্রেষ্ঠ রউফের মার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপনি এখন কেমন আছেন?’ ‘ ভালো নেই বাবা, চার দিকে ডাকাতির খবর শুনছি। বিভিন্ন জায়গায় মানুষ খুন হচ্ছে৷ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করছে এজন্য। কেন শুনতে হচ্ছে এ কথা। কেন মানুষ রউফের মতো হাজার শহীদকে মনে রাখে না?

‘চারদিকে হাহাকার! এতো কথা শোনার পর ভালো থাকি কি করে বাবা? ক’ দিন আর বাঁচবো। রাতে শুলে ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে মেয়েরা এসে দেখে যায়। ছোট মেয়ের স্বামীর চাকরি নেই। গ্রাম্য মাদ্রাসায় চাকরী করে কিছু টাকা পায়। তাতে কি সংসার চলে? সরকারকে অনুরোধ করবেন, সরকার যেন আমার ছোট মেয়ের বরের জন্য প্রাইমারী স্কুলে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেয়। আমি মরলেই তো এ ঘরে বাতি জ্বালানোর মতো আর কেউ থাকবে না। এখন শুধু আল্লাহ করি। ‘

তিনি আরো বললেন, আমি বিষাদ সিন্ধু তিন বার পড়েছি। হাসান – হোসেনের মতো আমার ছেলেও শহীদ হয়েছে। তাদের মতো শহীদের দরোজা যেন আমার ছেলেও পায়। আমার ছেলেও তো দেশ জয় করে শহীদ হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ তো তাকে ভুলতে বসেছে। আপনারা মাঝে মাঝে দেখতে এলে বুক ভরে ওঠে। দুঃখের কথা আর কি বলবো? জন্ম দুঃখিনী আমি। বুকের ছেলেকে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছি। আহ! আমার মানিক। মায়ের বুকের হাহাকারের কথা কি আর শেষ হয়।

শহীদ ছেলের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন মুকিদুন নেছা। মধুমিতা নদীর তীরে বাড়ি। এক জীর্ণ কুড়ে ঘরে বসবাস করছেন। সরকার তার বাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছে একটি পাকা ঘর। আর একটি পায়খানা। এক বছরও হয়নি। তবু দেয়ালে ও ঘরের ভিতে ধরেছে ফাটল। পলেস্তারা উঠে গেছে অনেক জায়গায়। আগামী বর্ষায় হয়তো ভেঙ্গে পড়বে।

গত বছর ভাদ্র মাসে নদী নিয়ে গেছে দুই একর জমি। এখন চাষ যোগ্য জমির পরিমাণ সিকি একরের বেশী হবে না। রউফের বাবা যে জমি রেখে গিয়েছিল, এর এক ইঞ্চি জমিও মা বিক্রি করেনি। যদি ছেলে বড় হয়ে বলে বাবার সম্পত্তি বিক্রি করে তাকে মানুষ করেছে। এই ভেবে সে দুঃখ পাবে তা তিনি চান নি।

মুকিদুন নেছা বললেন, বড় মেয়ের বিয়েতে শাড়ি দিতে পারি নি বলে অনেক কেঁদেছিলাম। রউফ তখন আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিলো, ‘মা আমি বড় হয়ে অনেক শাড়ি এনে দেবো।’

এই কথা শোনা মাত্র বড় মেয়ে জহুরাও হু হু করে কেঁদে উঠলেন। প্রশ্ন করা সত্ত্বেও ভাই সম্পর্কে কিছু বললেন না তিনি। গলা জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে সালামতপুরেই। হোমিওপ্যাথ ডাক্তার তার স্বামী। মাঝে মাঝে মাকে দেখতে এই বাড়িতে আসেন।

মুকিদুন নেছা অভাবের কথা বললেন, স্মৃতি চারণ করলেন ছেলের। কোন অভিযোগের সুর ছিল না তার গলায়। তবু বললেন, ‘রউফের স্মৃতি হয়ে থাকবে যে বাড়ি, সে বাড়িটিই ভেঙ্গে পড়ছে। এই বাড়িতে একটিও টিউবওয়েল নেই। আমাকে বলা হয়েছিল বাড়িটি ঠিক হলেই টিউবওয়েল বসিয়ে দেয়া হবে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে বহুবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু কাজ হয় নি। ‘

সেই সঙ্গে আরেকটি কথা বললেন রউফের মা, ‘এখনো রউফের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পাইনি। কর্তৃপক্ষ বলছেন, কাগজ পত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তো জানি না প্রভিডেন্ট ফান্ডে তার টাকা ছিল কিনা। ‘ এ সম্পর্কে তার ছোট দেবর (মুনসী মোতালেব হোসেন, বিডিআর – এর হাবিলদার ছিলেন, এখন অবসর প্রাপ্ত) বললেন, ‘৬৫ সালে আমি যখন হাবিলদার ছিলাম, রউফের প্রভিডেন্টের ফরম পূরণ করে দিয়েছি। এ কথা স্পষ্ট মনে আছে।’

এ সমস্ত কথা তিনি বলতে চান না। তবু বলেছেন। তার কোন অভিযোগ নেই কারো উপর। তিনি বললেন, তবু কিছু বলতে হয়। বলে শেষ করা যাবে না দুঃখের কথা। সারা রাত ঘুমোতে পারি না। চোখ বুজলেই হঠাৎ মনে পড়ে রউফ নেই। এই স্মৃতি নিয়ে মা হয়ে কিভাবে আমি ঘুমাই? ‘ কিন্তু তিনি তো জানেন না, সেই গ্রামের লোকই রউফকে চেনে না।

***

আমাদের আবেদন

অপরাজেয় এই সৈনিকেরা সব চেয়ে প্রিয় জীবনকে উৎসর্গ করেছেন নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে। তাদের শোণিত আলো জ্বেলে আমরা ঘরে ফিরেছি। আর তারা নশ্বর জীবনের মূল্য দিয়ে জয় করে নিয়েছেন অমরতার জয়মাল্য। আমাদের উপহার দিয়েছেন সুন্দর ভবিষ্যৎ। হৃদয় নক্ষত্র জ্বেলে শুনিয়েছেন নতুন আলোর গান।

বিচিত্রার পাঠক যিনি বিশ্বাস করেন স্বাধীনতায়, বীরের স্মৃতি যাকে আলোড়িত করে, তার কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনি এই বীরদের এক বার স্মরণ করুন। বছরের যে কোন দিন হোক, তাদের পাঠান এমন কিছু, যা আপনার সবচে’ প্রিয়, সবচে’ সুন্দর।

শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (বীর শ্রেষ্ঠ), ইঞ্জিনিয়ার। উত্তরাধিকারী আবদুল মোতালেব হাওলাদার (পিতা), গ্রাম – রহিমগঞ্জ, ব্রাহ্মনদিয়া, থানা – বাবুগঞ্জ, জেলা – বরিশাল।

শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান (বীর শ্রেষ্ঠ), ইস্টবেঙ্গল। উত্তরাধিকারী – মোসাম্মৎ কায়সূন নেসা (মাতা), গ্রাম – খরোদা, খালিশপুর, পোঃ বাজার খালিশপুর, থানা – মহেশপুর, জেলা – যশোহর।

শহীদ সিপাহী মোঃ মোস্তফা (বীর শ্রেষ্ঠ), ইস্ট বেঙ্গল।
উত্তরাধিকারী হাবিলদার মোঃ হাবিবুর রহমান (পিতা) (অবসরপ্রাপ্ত), গ্রামঃ সৈয়দপুর, পোঃ দৌলত খাঁ, জেলাঃ বরিশাল।

শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ (বীর শ্রেষ্ঠ), বি ডি আর
উত্তরাধিকারী (১) তোতাল বিবি (প্রথম স্ত্রী), গ্রাম – নীলগঞ্জ বাজার, পোঃ যশোহর, জেলা – যশোহর।
(২) ফজিলাতুন নেসা (দ্বিতীয় স্ত্রী) গ্রাম – ধুরিয়া, পোঃ বাগ – শ্রীরামপুর, থানা – নড়াইল, জেলা – যশোহর।

শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ূর রহমান (বীর শ্রেষ্ঠ), বিমান বাহিনী।
উত্তরাধিকারী – মিলি রহমান (স্ত্রী), ১০৯-১১২, মনিপুরী পাড়া, ঢাকা।

আমরা দুঃখিত, বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, ইঞ্জিন রুম আর্টিফিশিয়ার, প্রথম শ্রেণী, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারি নি। এ সম্পর্কে পরে জানানোর চেষ্টা করা হবে।

– বিচিত্রা কর্মীবৃন্দ।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1980.12.19-bichitra.pdf” title=”1980.12.19 bichitra”]