এশিয়ায় বৃহৎ শক্তির খেলা বন্ধ হোক- বঙ্গবন্ধু
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শনিবার বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবতই ষড়যন্ত্র চলছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশেই চালানো হচ্ছে একই ধরনের ষড়যন্ত্র। কারা এই ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে তা সবাই জানে। কিন্তু আমি এখন তাদের নাম বলতে চাইনা। আমি তাদের হাতেনাতে ধরতে চাই। আমার জনগণকে এ ব্যাপারে আমি সতর্ক রাখছি। আমার গোয়েন্দা বিভাগও এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে।
শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (এবিসি) প্রতিনিধি মি. পিটার জেনিংস ও মি. লুই শেকের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য প্রকাশ করেন। রোববার সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে এই বিশেষ টেলিভিশন সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হবে। এই সাক্ষাৎকার কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পিকিং সফর আর আসন্ন মস্কো সফর কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের জন্য চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, মি. নিক্সন তার নিজের স্বার্থেই বিভিন্ন দেশ সফর করে বেড়াচ্ছেন। তারা বৃহৎ শক্তি, তারা যে কোনো স্থানে যেতে পারেন, যে কোনো বিষয় আলোচনা করতে পারেন, সে সম্পর্কে আমার কি বলার থাকতে পারে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীন সফর আর বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর মি. নিক্সন সম্পর্কে তার মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে আমি খুশি। তবে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই স্বীকৃতি দিতে অনেক সময় নিয়েছেন। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, মার্কিন জনগণ, সাংবাদিক আর কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা আমাদের বরাবরই সমর্থন দিয়েছেন। আমার দেশের যে সব লোক বাধ্য হয়েছিল দেশত্যাগ করে ভারতে যেয়ে আশ্রয় নিতে, কিছু সংখ্যক মার্কিন নেতা তাদেরও দেখতে এসেছিলেন। আমি কৃতজ্ঞতার সাথে তাদের নাম স্মরণ করি। কিন্তু মি. নিক্সন আর মার্কিন সরকার সে সময় খোলাখুলিভাবে পাকিস্ত নিকে সমর্থন দিয়েছেন। আমি সে জন্য তাকে অভিনন্দন বা ধন্যবাদ জানাতে পারি না।
প্রশ্ন : কিন্তু এখন আপনার দেশে যেসব সাহায্য আসছে তারমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই এককভাবে সর্বাধিক সাহায্য দিচ্ছে। অনুমিত হচ্ছে ভবিষ্যতেও আমেরিকা এদেশকে এককভাবে সর্বাধিক সাহায্য দিবে। এ অবস্থায় সাধারণভাবে এই উপমহাদেশের সাথে, বিশেষভাবে আপনার দেশের সাথে আমেরিকার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক কি হবে বলে আপনি মনে করেন?
বঙ্গবন্ধু : যুক্তরাষ্ট্র একটা বৃহৎ শক্তি। আমাদের সাহায্যদানের ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু আমি একথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি যে এই সাহায্য হতে হবে সম্পূর্ণই শর্তহীন। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ‘আনরড’ এর মাধ্যমে এবং সরাসরিভাবেও আমাদেরকে কিছু সাহায্য দিয়েছে।
আরো সাহায্যের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ যাবৎ যে সাহায্য দিয়েছে তা সম্পূর্ণই শর্তহীন। আমার দেশ সাড়ে সাত কোটি অধিবাসী অধ্যুষিত একটি ছোট দেশ। আমার দেশে অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। আমি কোনো ব্লকে নেই। আমার নীতি অত্যন্ত পরিষ্কার। আমি স্বাধীনতা, জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার দেশের জনগণের পাশে দাড়িয়েছিল। আমি কৃতজ্ঞতার সাথে তাদের কথা স্মরণ করি। আমার বন্ধুদের বন্ধুত্ব আমি সানন্দে গ্রহণ করেছি।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে সোভিয়েত উপস্থিতি সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন? ভারত মহাসাগারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন নাকি চট্টগ্রাম বন্দরটি ব্যবহার করার অনুমতি চাইবে? অথবা এর মধ্যে নাকি তা চেয়েছেও?
বঙ্গবন্ধু : আমি তো তা জানি না! আপনারা কোথকে এ খবর পেলেন? আপনার কাছেই দেখছি কিছু আগাম খবর আছে! সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমাদের চুক্তি শুধু বন্দর পরিষ্কার করার এবং তারা তাই করছে। আমার দেশের মাটি কিংবা সমুদ্র সীমা কাউকেই ব্যবহার করতে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। এ ধরনের কোনো অনুমতি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমার কিংবা আমার সরকারের কাছে তো চাইনি?
প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীন- এই তিন বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে আপনি মনে করেন?
বঙ্গবন্ধু : তারা সবাই সুখে থাকুক। আমারা শান্তিতে থাকতে চাই। আমি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। আমি অত বড় বড় কথা ভাবি না। এশিয়া নিয়ে কেউ আর খেলা না করুক, এটাই শুধু আমি চাই। আমি এই উপমহাদেশকে একটি শান্তির এলাকা বলে ঘোষণা করতে চাই। কেননা আমরা আমাদের জনগণকে উন্নত করতে চাই, আমরা খাদ্য চাই, আশ্রয় চাই, বাসস্থান চাই। আমরা কোনো বৃহৎ ব্লকে যাব না, কোনো বৃহৎ শক্তি জোটে যোগ দিতে পারব বলেও মনে করি না। আমরা কারো সাথে জোট বাঁধতেও চাই না। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা আশা করি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যপারেও কেউ হস্তক্ষেপ করতে আসবে না। আমরা ক্ষুদ্র হতে পারি কিন্তু অনুভূতিহীন নই। গর্ব করার মতো আমাদের সব কিছুই আছে। আমরা সংগ্রাম করেছি, ত্যাগ স্বীকার করেছি, স্বাধীনতার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, কেউ আমার অভ্যন্তরীণ ব্যপারে হস্তক্ষেপ করলে কিংবা করতে চাইলে আমরা তা প্রতিহত করবো- এটাই আমার নীতি।
প্রশ্ন : সবার কল্যাণের জন্যে এই উপমহাদেশেই আপনারা কোনো জোট বাঁধতে চান?
বঙ্গবন্ধু : জোটের কোনো প্রশ্নই নেই। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। অন্যের ব্যাপারে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
প্রশ্ন : আপনি বলছেন, মাত্র তিন বছর সময়ের মধ্যেই আপনি বাংলদেশকে গোলযোগ শুরু হওয়ার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন। এতোখানি আশাবাদি আপনি কি করে হচ্ছেন?
বঙ্গবন্ধু : আমি আমার জনগণের ওপর নির্ভর করি। তারা অত্যন্ত সৎ। তারা আমাকে মান্য করে। তাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। তারা কঠোর পরিশ্রম করছে, আর এ জন্যই আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি তিন বছরেই সব ঠিক করতে পারবো।
প্রশ্ন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দেশে ফিরে আসার চার মাসের মধ্যেই আপনার এবং দেশের গতিধারার সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনি হয়তো তা লক্ষ্য করেছেন? আগামি তিন বছরে কি জনগণ আরো হতাশ হয়ে পড়বে না?
বঙ্গবন্ধু : আমি স্বাধীনতা দিয়েছি। আমি দেশের অগ্রগতি সাধন করবো। আমার জনগণ কোনো সময়ই হতাশ নয়।
প্রশ্ন : আপনার সমালোচকদের আপনি থামাবেন কি করে?
বঙ্গবন্ধু : সমালোচকরা সব সময় রয়েছে। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আমার নীতি, আলোচনা ও সমালোচনা করার অধিকার আমি তাদের দিয়েছি। সমালোচনায় আমার আপত্তি নেই। কেননা আমি জানি জনগণ আমাকে ভালোবাসে আমিও তাদের ভালোবাসি। সামান্য কিছু সমালোচনায় আমার বা আমার দলের বা আমার জনগণের কিছুই এসে যাবে না। আমার চারটি নীতির কথা আপনারা জানেন। সেগুলো হলো, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্ম নিরপেক্ষতা। আমি কড়াকড়িভাবে এগুলো অনুসরণ করবো।
প্রশ্ন : বিরোধী দল গঠনে কি আপনি ইচ্ছুক?
বঙ্গবন্ধু : জনগণ যদি কাউকে ভোট না দেয় তাহলে তো আমি আর বিরোধী দল সৃষ্টি করতে পারছি। নির্বাচন দিলে যদি কেউ তাতে জয়ী হয়, তাহলে সে বিরোধী দলে বসবে, আমার তাতে আপত্তির কিছু নেই।
প্রশ্ন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কদিন আগে ঢাকা কটনমিলে এক ভাষণে আপনি বলেছেন, আমরা ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটাবো’-এতে আপনি কোন ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন?
বঙ্গবন্ধু : বিশ্বের সর্বত্রই ষড়যন্ত্র চলছে।
প্রশ্ন : এই প্রশ্ন আপনি এখন তুলছেন কেন?
বঙ্গবন্ধু : আমি জানি বিশ্বের সর্বত্রই ষড়যন্ত্র চলছে।
প্রশ্ন : আপনি আরো বলেছিলেন এসব ষড়যন্ত্রের পিছনে কোথাও কোথাও বিদেশি অর্থও রয়েছে। এটা কোন দেশের অর্থ?
বঙ্গবন্ধু : এখনই এ কথা আমি আপনাদের বলবো, তা আপনারা আশা করছেন কি করে? আমার গোয়েন্দা বিভাগ এ ব্যাপারে কাজ করছে। এদেশে গোলযোগ সৃষ্টির জন্যে কিছু সংখ্যক লোককে কারা অর্থ দেয়ার চেষ্টা করছে, আমি তা জানি। কিন্তু এ দেশের সব ঘরে আমার লোক আছে। কারো পক্ষে এখানে কিছু করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তবুও কিছু সংখ্যক লোক অসৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে এদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ এদেশে তা সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন : শুধুমাত্র ষড়যন্ত্র আর বিদেশি অর্থের কথা বললে গণমনে কি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে না?
বঙ্গবন্ধু : কোনো বিভ্রান্তিই নয়। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র চলছে, আমার জনগণ তা জানে। এটা একদিন বা দুই দিনের ঘটনা নয়। বড় বড় লোকেরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশেই ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনি কি বৃহৎ শক্তিবর্গের কথা বলছেন?
বঙ্গবন্ধু : আমি এখন তা বলতে চাইনা। আমি কাউকেই এখন তা বলবো না। কিন্তু আমার জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। আমি এই ষড়যন্ত্রকারীদের ধরতে চাই।
প্রশ্ন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি যা বলছেন, তা কি এই যে বর্তমান মুহূর্তে একটি বিদেশি শক্তি এই দেশে এক ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা চালাচ্ছে?
বঙ্গবন্ধু : তারা সব সময় এখানে আছেন। সর্বত্রই ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্রকারীদের বলতে আমি কাদের বোঝাচ্ছি তা আমার চেয়ে আপনারাই ভালো বোঝেন। আমি এদের সম্পর্কে সচেতন। আমি শিশু নই। ৩৫ বছর যাবৎ আমি রাজনীতি করছি। কিসে কি হয় আমি তা জানি।
প্রশ্ন : আপনি কি করে এদের মোকাবেলা করবেন? আপনার তো কোনো বৃহৎ পুলিশবাহিনী বা সেনাবাহিনী নেই?
বঙ্গবন্ধু : আমার বিরাট পুলিশ বা সেনাবাহিনীর দরকার নেই। জনগণ রয়েছে আমার পেছনে। আমার সরকারের প্রতি রয়েছে তাদের সমর্থন। জনগণই সত্যিকারের শক্তি। যার পেছনে ঐক্যবদ্ধ গণসমর্থন আছে। তাকে দমিয়ে রাখার শক্তি বিশ্বের কারো নেই।৪৬
রেফারেন্স: ১৩ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ