You dont have javascript enabled! Please enable it! 1980.05.09 | শেরে বাংলা'র পুনঃমূল্যায়ন | ডাঃ সিরাজুল ইসলাম | সাপ্তাহিক বিচিত্রা  - সংগ্রামের নোটবুক

শেরে বাংলা’র পুনঃমূল্যায়ন | ডাঃ সিরাজুল ইসলাম | সাপ্তাহিক বিচিত্রা 

পত্রিকা খুললে প্রথমে চোখে পড়ে মৃত্যুর খবর, মৃত মহান ব্যক্তিদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীর খবর, মৃত ব্যক্তির স্মৃতি সংসদের খবর, স্মৃতিসৌধ নির্মাণের খবর। মৃত্যু যেন জয় করে নিয়েছে জীবনকে। স্মৃতি সভায় স্মৃতি কারদের মনমুগ্ধকর বক্তৃতা শুনে প্রশ্ন জাগে মনেঃ যে দেশে এতসব মহাপুরুষদের আবির্ভাব, যে দেশের গুণী-জ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিকদের সংখ্যা শুমার করা যায় না, যে দেশের বীরদের বীরগাঁথা শেষ করা যায় না, যে দেশ পেল এতসব ‘অতন্ত্র প্রহরীর’ প্রহরা -সে দেশের এমন করুণ অবস্থা কেন? কারণ, যা শোনানো হচ্ছে তার বেশিরভাগই কিংবদন্তী, সত্য থেকে অনেক দূরে। কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবে আর কিছুটা অজ্ঞতাবশতঃ ইতিহাসের নির্মম সত্যকে তুলে ধরে প্রচার করা হচ্ছে অবাস্তব উপাখ্যান। এ কারসাজির অনেক কারণ -মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সর্বোপরি রাজনৈতিক।
জাতীয় নেতা আমাদের অনেক। ইতিহাসে তাদের স্থান যা-ই থাক না কেন জনসমক্ষে নেতাদের আপেক্ষিক স্থান স্থায়ী নয়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন হয় তাদের আপেক্ষিক স্থানও। বিশেষ সময়ে বিশেষ নেতা বিশেষভাবে গুরুত্ব পান। এমনি একজন মুকুটহীন রাজা তিনি এ,কে, ফজলুল হক। সব নেতারাই কোনো-না-কোনো সম্মানসূচক পদবী থাকে -যেমন আচার্য, মহামতি, নেতাজি, দেশপ্রিয়, দেশবন্ধু, বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি। ফজলুল হকের পদবী ‘শেরে বাংলা’। তবে আমরা তাকে ‘শেরে বাংলা’ বলতে ইচ্ছুক নই। কেননা পদবী দিয়ে ডাকা মানে ঐতিহাসিকভাবে পক্ষপাতিত্ব করা। তাছাড়া আমাদের নীতি ও পদবীর বিরুদ্ধে। পদবী ডিএনএ থাকে তার সঙ্গী সাথী অনুসারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবতার আসনে বসিয়ে পূজার আয়োজন করা হয় মাত্র। যিনি দেবতা তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে, আর যিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে তিনি ঘিরে থাকা স্তাবকদের দ্বারা বিপথগামী হন, কারণ তখন তিনি জনগণ থেকে, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। এ, কে, ফজলুল হককে ‘শেরে বাংলা’ বলার আমাদের আরেক আপত্তি ‘শের’ শব্দটি। শের বা বাঘ একটি রক্তপিপাসু পশু। সে হিংস্রতার প্রতীক, আক্রমণের প্রতীক, স্বেচ্ছাচারী রাজার প্রতীক। যারা ‘হক’কে এ পদবী দেয় তারা এমন অঞ্চলের লোক যেখানে হিংস্রতা শ্রদ্ধা কুড়ায়। তাছাড়া যারা হককে শেরে বাংলা বলে স্তাবকতা করেছেন তারাই আবার তাকে ধূর্ত শেয়াল, গাদ্দার বলে আখ্যায়িতও করেছে। চল্লিশের দশকে তাদের হাতে হক এত নির্যাতিত, অপমানিত হন যে তাদের দেয়া অশোভন শের পদবীতে হককে ডাকা মোটেই উচিত নয়। ভালোবাসার আতিশয্যে কোন নবীর পদবী যদি দিতেই হয় তবে তা হওয়া উচিত সংস্কৃতি সম্মত।
ইদানিং ‘শেরে বাংলা’ পদবীর আগে আরও দুটি বিশেষণ যোগ করে ডাকা হয় কিংবদন্তীর নায়ক শেরে বাংলা ফজলুল হক বলে। ভক্তির বন্যায় বেসামাল হয়ে ভক্ত যখন ভাষা জ্ঞান হারায় তখন দেবতা হয়তো প্রীত হয়, কিন্তু নিরপেক্ষ সমালোচক তা মার্জনা করেন না। যা কিছু জনশ্রুতি, অপ্রমাণিত কাহিনী, অসত্য, কল্পনাসৃষ্ট তাকে বলা হয় কিংবদন্তী, উপাখ্যান, উপকথা, ইংরেজিতে যাকে বলে মাইট, ট্রেডিশন, নাবিক সিন্দাবাদ, হারকিউলিস, আমির হামজা, গাজী কালু, রাবন প্রভৃতি চরিত্র কিংবদন্তির নায়ক হতে পারে। কিন্তু বাকেরগঞ্জ নিবাসী মৌলভী মোহাম্মদ ওয়াজেদের পুত্র এ,কে, ফজলুল হক কিংবদন্তীর নায়ক হতে যাবেন কেন? (১৯৩৭ সন পর্যন্ত তাকে আহবান করা হতো মৌলবী বলে।) তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র, তার কীর্তিকলাপ আমাদের জানা। অবশ্য হক সম্পর্কে যেভাবে সত্যকে বিকৃত করা হচ্ছে, যে কল্পনা সৃষ্ট কৃতিত্ব তার উপর আরোপ করা হচ্ছে, তার অতুলনীয় মহা ভাবমূর্তি নির্মাণে বীর পূজকদের আয়োজন তাতে মনে হচ্ছে একে ফজলুল হক সত্যি সত্যি ইতিহাসকে অতিক্রম করে কিংবদন্তির মহানায়ক হতে যাচ্ছেন।
এদেশের রাজনৈতিক জাগরণে জাতীয় চেতনা সৃষ্টিতে, স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐতিহাসিকভাবে অবদান রেখেছেন যেসব অসংখ্য নেতা তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য -আব্দুল লতিফ, আমির আলি, খাজা সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, আব্দুর রহিম, আকরাম খাঁন, এ,কে, ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। এদের সবার সৃষ্ট ইতিহাস কে সামগ্রিকভাবে না দেখে শুধু একজনকে নেতৃবৃন্দের কাতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে অতিরিক্ত মর্যাদা দেয়া, অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া, কল্পনাপ্রসূত কৃতিত্ব অর্জন করে তার মিথ্যা ভাবমূর্তি নির্মাণ করা অন্যায়। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকের কাছে অনভিপ্রেত প্রচেষ্টা ধরা পড়বেই, কিংবদন্তির নায়ক তখন মত্যজগতে ফিরে ইতিহাসের প্রস্থানে দাঁড়াতে হবেই।
বক্তৃতামঞ্চে, পত্রপত্রিকায়, প্রচারপত্রে অহরহ শোনানো হচ্ছে যে হক ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী, শোষিত নির্যাতিত দরিদ্র কৃষক মজুর উদ্ধারকর্তা, মুসলমান সমাজের শিক্ষাদাতা ইত্যাদি। এসব সিদ্ধান্তের তথ্যভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণ করতে চাই এ প্রবন্ধে। এর আগে হকের রাজনৈতিক জীবনের প্রধান ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা দরকার।
১৯১৩ঃ নবাব সলিমুল্লাহ পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে যোগদান -সলিমুল্লার ন্যায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী -বঙ্গীয় তথা ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা – মুসলিম রাজনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার । ১
১৯১৫ঃ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একই সঙ্গে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত।
১৯১৬ঃ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সংশোধন করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শুরু এবং এর ফলশ্রুতিতে লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষর -হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন।
১৯১৮ঃ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি ও একই সঙ্গে ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত।
১৯২০ঃ কংগ্রেস ত্যাগ ও চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ দলের যোগদান।
১৯২৩ঃ স্বরাজ দলের টিকেট এবং দিওয়ানি পরিষদের নির্বাচিত। ২
১৯২৪ঃ স্বরাজ দল পরিত্যাগ সহকারী মন্ত্রী দলে যোগদান ও শিক্ষামন্ত্রীর গ্রহণ। (মন্ত্রী দল নামে কোন দল ছিল না। যারা মন্ত্রী হওয়ার জন্য ব্রিটিশদের সমর্থন দিত তাদের ব্যঙ্গ করে বলা হতো মিনিস্ট্রিয়াল পার্টি) ।
১৯২৯ঃ নবগঠিত ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি তে যোগদান – নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সহ-সভাপতি নির্বাচন।
১৯৩৫ঃ নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি । কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র।
১৯৩৬ঃ কৃষক প্রজা পার্টি গঠন -দলের নেতা নির্বাচিত – ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি ত্যাগ। কৃষক প্রজা পার্টি ও ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির মধ্যে আঁতাত -আঁতাত ভঙ্গ।
১৯৩৭ঃ নির্বাচনে জয়। আইন পরিষদে তার দল তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। কংগ্রেসের সঙ্গে প্রজা পার্টির কোয়ালিশন সরকার প্রসঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ -মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন -নিজে প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম লীগে যোগদান -বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি।
১৯৩৮ঃ কৃষক প্রজা পার্টির অনাস্থা -প্রজা পার্টি থেকে পদত্যাগ।
১৯৪০ঃ লাহোর প্রস্তাবের প্রস্তাবক।
১৯৪১ঃ জিন্নাহের পূর্ব অনুমতি না নিয়ে ভাইসরয়ের ওয়ার কাউন্সিল -এ যোগদানের অপরাধে হককে লীগ থেকে পদত্যাগের নির্দেশ (আগস্ট) -পদত্যাগ -পদত্যাগের পর আবার মার জন্য প্রার্থনা (নভেম্বর)-লীগ থেকে পদত্যাগ প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ গঠন মন্ত্রী থেকে পদত্যাগ (ডিসেম্বর)।
১৯৪২ঃ লাহোর প্রস্তাবের বিরোধিতা -প্রজা পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক হিন্দু মহাসভার সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন ও প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ গ্রহণ।
১৯৪৩ঃ গভর্নর কর্তৃক জগাখিচুড়ি সরকার নিন্দা জোরপূর্বক হককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করণ। বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায়।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
উপরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে হকের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বেরিয়ে আসে। বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছেঃ তিনি দু-তিন বছরের অধিক কোন দল বা মতাদর্শে আকৃষ্ট থাকতে পারেনি। কিসের সন্ধানে যেন তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলছেন একদল থেকে অন্য দলে, একমতাদর্শ থেকে অন্য মতাদর্শে। এমনকি তার নিজের গড়া কৃষক প্রজা পার্টি তে পর্যন্ত দু বছরের অধিক নিশ্চিত থাকতে পারেন নি। কেন এই অস্থিরতা? কেন তিনি বারবার নতুন মতাদর্শ দীক্ষিত হন এবং অক্ষচ্যুত উল্কার মতো করে জৌলুস দেখিয়ে শূন্যে বিলীন হয়ে যান? অনেকে মনে করেন হকের এ অস্থিরতার কারণ ক্ষমতার লোভ। স্বীকার করি ক্ষমতার লোভ। ক্ষমতার মোহ কোন রাজনীতিকের নেই? বলতে পারেন হকের একটু বেশি ছিল। সমস্যাটি আসলে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হয় যে হক ছিলেন স্বভাবগতভাবেই অস্থির ও চঞ্চল। কিন্তু দুর্ভাগ্য অস্থির চরিত্রের জন্য তাঁকে এবং জাতিকে অনেক সময় চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
হকের চরিত্রে আরেক মজার দিক সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ। এম,এ, পাস করেই তিনি চাকরি শুরু করেন। তারপরে বি, এর, পাশ করে ওকালতি। ওকালতি থেকে বঙ্গভঙ্গের পর আবার চাকরি (১৯০৬-১৯১২)। চাকরি ছেড়ে শুরু করেন রাজনীতি (১৯১৩)। ১৯২০ এর দশকে বিশেষ করে মন্ত্রিত্ব যাবার পর (১৯২৪) থেকে রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে একটি মনপুতঃ চাকরির সন্ধান করাও ছিল তার একটি কাজ। বিশেষ করে জজের চাকরির প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। হাইকোর্টের কোন যশোর পদ খালি হতে তিনি চেষ্টা-তদবির করতেন তা পাবার জন্য। বিদেশে চাকরি লাভ করতে হলে প্রয়োজন ছিল উচ্চতম পর্যায়ের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সে পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্য তিনি ১৯৩১ সনে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের আইন সদস্য তেজ বাহাদুর সপ্রুকে এক পত্র দেন।
পত্রটি এইঃ
Calcutta
24-5-1931
Dear Dr. Sapru
There is a strong rumour that some Additional Judges are going to be appointed in the Calcutta High Court. In all probability; one of these will be taken from the Vakil Bar. As you know very well that on the last occasion my claims were wholey overlooked and one Barrister was appointed to fill up the vacancy. This is simply because I had no one in the Government of India who could have taken up my case on his own accord; nor did I write to you to see that my claims were properly considered. May I request you to be so good as to look into the matter and see if you can help me this time in any way. I don’t wish to say more on a matter like this.
Soliciting a line reply.
I remain with best regards
Yours sincerely
A. K. Fazlul Huq
চেষ্টা করলে হবে কি? ভাগ্যে যে তাঁর জজের পদ নেই, আছে বাংলার প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ।১৯৪১ সনের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগ, তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করলে তিনি পাঁচটি পুরো বিপরীতধর্মী দল উপদল নিয়ে একটি টলমল জগাখিচুড়ি সরকার গঠন করেন। যেকোনো সময় মন্ত্রীত্ব চলে যেতে পারে এ সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন। অতএব, এবার ক্ষমতায় থাকতেই ভবিষ্যৎ ব্যবস্থার জন্য তিনি চেষ্টা শুরু করেন। চাকরি চাই। কিন্তু ৭০ বছর বয়সে কি চাকরি করবেন তিনি? কোন রাজনৈতিক চাকরি ছাড়া অন্য চাকরি করা সম্ভব নয়। ভাইসরয় লিনলিথগোকে হক জানান তাকে বিদেশে কোন কূটনৈতিক চাকরি দেয়া যায় কিনা (৪)। ভাইসরয় সেক্রেটারি অফ স্টেট আমেরিকে অনুরোধ করেন হকের জন্য কানাডা অস্ট্রেলিয়ায় কোনো কূটনৈতিক পদ প্রদানের জন্য। কিন্তু কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ভারতের সঙ্গে হাইকমিশনার বিনিময় আপাততঃ সম্ভব না হওয়ায় হককে কূটনৈতিক চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়নি(৫)। অচিরেই হকের মন্ত্রীত্ব চলে যায়, চলে যায় তার বয়সও। কিন্তু অব্যাহত থাকে তার চাকুরী করার স্পৃহা। দেশবিভাগের পর ৮০ বছর বয়সে ঢাকা হাই কোর্টের অ্যাডভোকেট জেনারেলের পদ গ্রহণ করে তিনি প্রমাণ করেন যে মনে তারুণ্য থাকলে বার্ধক্য বাধ সাজতে পারেনা।
গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী!
হক ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী, গণতন্ত্রের অগ্রদূত, গণতন্ত্রের মানসপুত্র, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাংলার বার্ক, গণমানুষের মনীষী ইত্যাদি। ভাষা থেকে বোঝা যায় এসব বক্তৃতার কথা, প্রচার মাধ্যমের কথা, এসব ভক্তের ভক্তিব্যঞ্জনা। ঐতিহাসিক সত্য এই যে হকের যুগে সব রাজনীতিকের কাম্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন স্বাধীনতা আর সে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে লাভ করতে হবে স্বায়ত্বশাসনে উপযুক্ততা ও দক্ষতা। সে উপযুক্ততা শিক্ষাদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের নীতি ছিল ক্রমে ক্রমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ। বলাবাহুল্য যে প্রতিনিধিত্বমূলক আঞ্চলিক সাহিত্য শাসন প্রতিষ্ঠা (তথা পৌরসভা, জেলা বোর্ড, ইউনিয়নবোর্ড), আইন পরিষদ, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার, আদালতে জুরি প্রথা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী। যখনই সরকার কোন শাসনতান্ত্রিক সংস্কার-নীতি ঘোষণা করেছেন দেশের রাজনীতিকগণ এর পক্ষে বা বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন মাত্র। যেমন ১৯২৪ সনে ফ্রান্সিস ইনকোয়ারি কমিটি যখন জনমত যাচাই করছে চলতি সীমিত ভোটাধিকার সংশোধন করে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার প্রবর্তন করা যায় কিনা এখন এ,কে, ফজলুল হক মত প্রকাশ করে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে তার মতে গ্রাম্য অশিক্ষিত লোকদের প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞার কাজ (৬)। অভিমান তিনি লন্ডন গোলটেবিল বৈঠকেও যোগদান করেন। (৭)
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন অনুসারে কাউন্সিলে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল সংখ্যালঘু , যদিও জনসংখ্যা মুসলমানরা সংখ্যাগুরু। আগামী শাসনতান্ত্রিক সংস্কারে কাউন্সিলে মুসলমানদের সংখ্যানুপাতিক সীট দেওয়া উচিত কিনা এমন প্রশ্ন করলে হক বলেন যে মুসলমানরা যতদিন অনুন্নত থাকবে ততদিন তাদের সংখ্যানুপাতিক সীট দেয়া ভুল হবে (৮)। হকের এ অভিমতের কারণ লখনৌ চুক্তি (১৯১৬) । হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য সম্পাদিত লখনৌ চুক্তি মোতাবেক কাউন্সিলে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য আসন বরাদ্দ করা হয় ৪০ শতাংশ যদিও তখন মুসলিম লোক সংখ্যা ছিল ৫২.৮ শতাংশ। কংগ্রেসের পক্ষে চুক্তিতে প্রস্তাব করেন এ, রসুল এবং মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ওই প্রস্তাব সমর্থন করেন এ,কে, ফজলুল হক। এ অগণতান্ত্রিক অন্যায় চুক্তি বাংলার অন্যান্য মুসলিম নেতারা প্রত্যাখান করেন এবং এর বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে নবাব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। হট একাই ছিলেন লখনৌ চুক্তির পক্ষে।
হকের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ঠিক কি ছিল বলা কঠিন। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে হকের যে ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় তাতে মনে হয় তিনি সার্বজনীন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বোধহয় বিশ্বাস করতেন অ্যারিস্টোটলীয় মডেলের এক ধরনের সীমিত গণতন্ত্র যেখানে যোগ্য লোক শাসন করবে অযোগ্যের কল্যাণের জন্যে। লখনৌ চুক্তি তিনি এজন্য সমর্থন করেছিলেন যে যদিও সংখ্যায় বঙ্গীয় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু যোগ্যতায় তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক নিচে, অতএব, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে অযোগ্যদের কর্তৃত্ব দেয়া ঠিক নয়। বরং যেসব অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব দেশে অধিক আসন দেওয়া দরকার যেন সেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।যোগ্যতার প্রতি হকের পরম ভক্তি পরিলক্ষিত হয় ১৯১৮ সালের লীগের অধিবেশনে তার সভাপতির ভাষণে। তিনি স্বায়ত্বশাসনের প্রতি জোর দিয়ে বলেন যে স্বায়ত্তশাসন এর ফলে যদি মুসলমানরা অধিকতর যোগ্য হিন্দু কর্তৃক চাকরির জগৎ থেকে আপাততঃ বিতাড়িত হয় তবুও ভালো। তার মতে, স্বরাজের ফলে চাকরি হারাবে সর্বোচ্চ শতকরা ৩ জন মুসলমান কিন্তু স্বরাজ এর ফলে লাভবান হবে বাকি শতকরা ৯৭ জন মুসলমান। যারা হচ্ছে চাষী, মজুর, কারিগর ইত্যাদি। অতএব স্বরাজের ভয় কেন? হকের বিশ্বাস , যোগ্য শাসন করবে অযোগ্যের কল্যাণের জন্য। যোগ্য ব্যক্তির উপর আস্থা পুনর্বার তিনি ব্যক্ত করেন গোলটেবিল বৈঠকে। সাইমন কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার চালু করার সরকারি সিদ্ধান্তের উপর আলোচনাকালে এ নীতির সমালোচনা করেন এবং এর বিরুদ্ধে ভোট দান করেন। তার মতে অশিক্ষিত অজ্ঞ গরিব চাষি মজুরের হাতে ভোটাধিকার গেলে সে অধিকার তারা বিচক্ষণতার সাথে ব্যবহার করতে পারবে না। উনিশ শতকের উপযোগবাদী দের (ইউটিলিটারিয়ানস) মতো হকের ও রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল ‘যোগ্য নেতৃত্বের’ মাধ্যমে দুর্বলের কল্যাণ সাধন। যোগ্য নেতৃত্ব পেতে হলে ভোটাধিকার শুধু তাদেরই থাকা উচিত যারা জানে ভোট মানে কি। অর্থাৎ যারা অশিক্ষিত, গরিব, দুর্বল, সম্পদহীন তাদের হাতে রাজনৈতিক অধিকার দেয়া ঠিক নয়।
হকের রাজনৈতিক বিশ্বাস পূর্ণ প্রতিফলন হয়েছে কৃষক প্রজা পার্টির ম্যানিফেস্টোতে। ১২ দফার ম্যানিফেস্টোতে একদফা গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতা সম্পর্কে ছিল না। প্রায় সব দফাই ছিল বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে, বিশেষ করে জমিদার প্রজা সম্পর্কে। যে যেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের লোকেরা ব্যঙ্গ করে হকের দলকে বলতো রাজভক্ত জোতদার সমিতি (১৯)।
১৯৩৭ সনের নির্বাচনী ফলাফল ছিল নিম্নরূপঃ -কংগ্রেস ৪৭, মুসলিম স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩, মুসলিম লীগ ৩৯, কৃষক প্রজা পার্টি ৩৬, হিন্দু স্বতন্ত্র প্রার্থী ২৭ , অন্যান্য ৫৮ এবং মোট ২৫০ ।
সংসদের পার্লামেন্টারি দলগুলোর মধ্যে কৃষক প্রজা পার্টির স্থান তৃতীয়। ১৯৩৭ সনের শেষ নাগাদ ১৭ জনপ্রিয় দল সদস্য হকের উপর আস্থা প্রত্যাহার করলে সংসদে হকের সমর্থক সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৯ জনে। এ ১৯ জন অনুগত সদস্যকে পুঁজি করে হক দু’দফায় প্রায় সাত বছর পর্যন্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ অলংকৃত করেন। কি করে সম্ভব করতে পারলেন তিনি অসম্ভব কাজ? গণতান্ত্রিক পন্থায় না অন্য উপায়ে? কিভাবে পেরেছিলেন তা এক অবিশ্বাস্য অবিস্মরণীয় কাহিনী। প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের জন্য এবং লাভ করে তা বজায় রাখার জন্য অহর্নিশ যে দলীয় কোন্দল কৌশল দেখিয়েছেন দলমত পরিবর্তনের যে পরিমাণ ন’নতা প্রদর্শন করেছেন, যেমন ভাবে খোলাখুলি ভোট কেনার ব্যবস্থা করেছিলেন তার তুলনায কোথায়? এসব অগণতান্ত্রিক ক্রিয়াকান্ডে হক যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে কোন নেতার মধ্যে সেটাই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান
১৯১৩ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত সংসদের ভেতরে এবং বাইরে হকের বক্তৃতা বিবৃতি প্রস্তাবসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ১৯৩০ সন পর্যন্ত হকের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মুসলমান সমাজে শিক্ষা বিস্তারে। এরপর তার দৃষ্টি বেশি পড়ে কৃষি ও কৃষকের সমস্যার উপর। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিই যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের মাপকাঠি হয় তবে বলতে হবে হক ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা দরদী, কিন্তু কথার উপর গুরুত্ব যদি কাজের উপর বেশি গুরুত্ব দেই তাহলে হক এর কৃতিত্ব ম্লান হয়ে আসে।
শিক্ষাক্ষেত্রে হকের অবদান আলোচনা করতে গিয়ে সবাই সে একই কথা বলে গৌরববোধ করেন যে তিনি স্থাপন করেছেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, লেডি বের্বোন কলেজ, চাখার কলেজ ইত্যাদি। ইসলামিয়া কলেজ হকের শিক্ষামন্ত্রীত্ব (১৯২৪) গ্রহণের অনেক আগেই সরকারি পরিকল্পনায় ছিল এবং এর জন্য জমি ও অর্থ বরাদ্দ ঠিকঠাক ছিল। হকের ছ’মাসের মন্ত্রিত্ব যাবার অনেক পর কলেজটি উদ্বোধন হয়। তেমনি লেডি বের্বোন কলেজের পরিকল্পনাও নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিত্বের সময় নেয়া হয় কিন্তু কলেজ উদ্বোধন হয় হকের মন্ত্রিত্বের সময় (১৯৩৮)। আসল কথা হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে দু’চারটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করলেই কি শিক্ষা প্রসারী ব্যক্তিত্ব বলা যায়? এসব কাজ তো আদতে সমাজসেবীদের সমাজ সেবার আওতায় পড়ে। সমাজসেবীর কাজ আর রাজনীতিকের কাজ ভিন্ন। রাজনীতিকের কাজ জাতীয় স্বার্থে সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণ করা ও তা কার্যকর করা। সুষ্ঠু নীতি কার্যকর হলে গোটা জাতি উপকৃত হয়, আর সমাজসেবীদের কাজে উপকৃত হয় বিশেষ স্থান ও শ্রেণীর লোক। আমাদের দেখতে হবে হকের কোন জাতীয় শিক্ষা নীতি ছিল কিনা, যদি থাকে এর স্বরূপ কি? শিক্ষার ব্যাপারে হকের কোন নির্দিষ্ট দর্শন বা নীতি ছিল বলে মনে হয় না। শেখার ব্যাপারে তিনি সংসদে অজস্র বক্তৃতা দিয়েছেন, বিতর্ক করেছেন সত্যি, কিন্তু বক্তৃতাই শুধু। প্রচেষ্টা চাইতে প্রচারই তিনি পছন্দ করতেন বেশি।এ মতের সমর্থনে দু’একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯২৬ সনি গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল স্থাপনের জন্য রুরাল প্রাইমারি এডুকেশন বিল নামে একটি সরকারি বিল উত্থাপন করা হয় সংসদে। বিলটির পক্ষে ছিল প্রায় সমস্ত মুসলমান সদস্যরা আর বিপক্ষে ছিল প্রায় সমস্ত হিন্দু সদস্যরা। বিলটির বিপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত থাকায় এটি প্রতিবছর সংসদে পেশ করা হতো আর প্রতিবারেই তা নাকচ হয়ে যেত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সদস্যদের ভোটে। বিলটির পক্ষে হক জোরালো বক্তব্য রাখেন। কিন্তু ১৯৩০ শনে খাজা নাজিমুদ্দিন যখন বিলটি সংসদে পেশ করেন এবং এর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট লাভে আশ্বস্ত হয়ে বিলটি ভোটে দেন তখন এ,কে, ফজলুল হক ভোট দানে বিরত থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করেন (১২)। স্যার আব্দুর রহিম হকের ভোটদানে বিরত থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন যে এ বিল পাস হলে কৃষকদের উপর শিক্ষা করবে। তবে আগে বিলটি তিনি সমর্থন করেছিলেন কেন? বিল পাস হবার সম্ভাবনা যখন ছিল না তখন তিনি এর সমর্থনে বক্তৃতা দিয়েছেন, এবং যখন বিলটি পাস হবার উপক্রম হয় তখন তিনি নিরপেক্ষ থাকেন। আসল কথা হচ্ছে এই যে বিলটি জমিদার, জোরদার ও ধ্বনি কৃষকদের উপর কর আরোপ করেছিল।
১৯৩১ সনের বাজেটের উপর বক্তৃতা করতে গিয়ে হক এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন মুসলমানদের শিক্ষার ব্যাপারে। বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন কীভাবে সরকার মুসলমানদের শিক্ষা দিতে অবহেলা করছে। বক্তৃতা শেষে তিনি প্রস্তাব করেন মুসলমানদের জন্য বাৎসরিক ন্যূনপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে। হকের প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য সরকার এ্যাডভাইজারী কমিটি অন মুসলিম এডুকেশন নামে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। হককে করা হয় কমিটির প্রথম সদস্য। কমিটির দায়িত্ব ছিল মুসলমান সমাজের শিক্ষার সমস্যা সরেজমিনে তদন্ত করে সরকারকে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট দান। চার বছর পর্যন্ত কমিটির কঠোর পরিশ্রম করে একটি সুন্দর প্রামাণিক তথ্য বহুল রিপোর্ট তৈরি করেন। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হক কোনদিন কমিটির কাজে সহায়তা করেননি; কমিটির মিটিং এ যোগদান করেননি (১৩)।
সবচাইতে পরিতাপের বিষয় শিক্ষা নিয়ে হকের রাজনীতি। জমিদার, জোরদার, ধনী কৃষকদের কাছে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তিনি নাজিমুদ্দিনের আনীত ফ্রি প্রাইমারি এডুকেশন (১৯৩০) – এর পক্ষে ভোটদানে বিরত থাকেন। জনগণকে তিনি আশ্বাস দেন যে ক্ষমতায় এলে শিক্ষা করারোপ ছাড়াই তিনি ফ্রি প্রাইমারি শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন। কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে অঙ্গীকার করা হয় যে ক্ষমতায় এলে তিনি বিনা করে বিনা বেতনে বাধ্যতামূলক প্রাইমারি শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন। মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির চাপে প্রধানমন্ত্রী হবার পরও তিনি সংসদে অঙ্গীকার করেন যে তিনি পূর্ব প্রতিজ্ঞা (অস্পষ্ট) বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাইমারি শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন (১৪)। কিন্তু অর্থ কোথায় এ নীতি কার্যকর করার? জমিদার, জোরদার, ধনী কৃষকদের উপর শিক্ষা কর না বসিয়ে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার উপায় নেই, কিন্তু কিছুতেই কর তিনি বসাবেন না; কর একটি অতি অপ্রিয় পন্থা। গ্রামের রাজনীতি ও ক্ষমতা যাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তারা জমিদার, জোরদার, ধনী কৃষক। কর বসিয়ে তাদের কাছে অপ্রিয় হওয়ার রাজনৈতিকভাবে অবাঞ্ছনীয়। অতএব, টাকা নেই এ অজুহাতে হক ফ্রি প্রাইমারি এডুকেশন আইন (১৯৩০) আপাততঃ স্থগিত ঘোষণা করেন এবং প্রচার করেন যে সেকেন্ডারি এডুকেশন হচ্ছে মুসলমানদের প্রকৃত শিক্ষা সমস্যা।(১৫)
অপ্রিয় কর প্রয়োগ ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে যা করা যায় তা করতে হক প্রস্তুত। শিক্ষা প্রশাসনে অধিকতর দক্ষতা অর্জনের জন্য স্যাডলার কমিশন (১৯১৭) সুপারিশ করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে সেকেন্ডারি এডুকেশন পৃথক করে একটি আলাদা সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড স্থাপন করার জন্য। হক সে সুপারিশ কার্যকর করে বেঙ্গল সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড স্থাপন করেন (১৯৪০)। নব্য গঠিত বোর্ডের কর্মচারী নিয়োগে পক্ষপাতিত্ব করা হয় মুসলমানদের প্রতি। ফলে হিন্দু মহলে সৃষ্টি হয় তুমুল অসন্তোষ। যতই হিন্দুরা হককে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বের জন্য আক্রমণ করে ততই হকের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় মুসলমান ও মুসলিম লীগ প্রিয়ভাজন হন তিনি তাদের কাছে যারা বোর্ডে চাকরি পেল। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা বিস্তারের কি হলো? সাম্প্রদায়িক ধূম্রজালে চাপা পড়ে যায় প্রাইমারি শিক্ষা ব্যাপারে হকের ব্যর্থতা চাপা পড়ে যায় সেকেন্ডারি শিক্ষা সম্প্রসারণ প্রশ্নটিও।
হকের প্রজাদলের প্রোগ্রাম ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ
কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হিসেবে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে দেশবাসীর কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে তিনি যেসব মহৎ কর্ম করতে বদ্ধপরিকর সেগুলো হচ্ছেঃ
১। বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা বিলোপ;
২। কৃষকের উপর খাজনা হ্রাস;
৩। জমিদারের প্রিয়েমশন অধিকার বিলোপ;
৪।জমিদারের সেরেস্তায় নজর সেলামি দিয়া বিলোপ;
৫। কৃষকের ঋণ সমস্যা সমাধান ;
৬। বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু ;
৭। মরা নদী ও খাল খনন ;
৮। প্রতি থানায় একটি করে হাসপাতাল স্থাপন;
৯। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা (স্বাধীনতার নয়);
১০। প্রশাসন খরচ হ্রাস;
১১। মন্ত্রীদের বেতন ১০০০ এ কমান; ও
১২। দমন আইনে রহিত করণ ও রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ হকের এ নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোকে ভোট ধরার জাল বলে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেয় এবং বলে যে জালে যদি মাছ ধরা পড়ে তবে সে ক্ষমতার মাছ নিয়ে হক সোজা বাড়ি চলে যাবেন ভুরিভোজন করে দেবেন ঘুম, ভুলে যাবেন জনগণের কথা কিন্তু বাংলার কৃষক মজুর বিশ্বাস করেছিল হককে। তারা ভেবেছিল এত সুন্দর বক্তৃতা করেন, গল্প করেন যিনি, এত বোধগম্যও আকর্ষণীয় ছাড় প্রোগ্রাম কাকে ভোট দিলে নিশ্চয়ই তাদের ‘ডাল-ভাতের’ সুরাহা হবে। হয়েছিল কি তাদের ডাল-ভাতের সুরাহা? তিনি তার নির্বাচনী প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ অপারগ, কেননা যে মুসলিম লীগের সমর্থন তিনি ক্ষমতায় আসেন সে মুসলিম লীগ ওই প্রোগ্রামের বিরোধী। তিনি যে ১১ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন সে মন্ত্রিসভায় নয় জনই ছিল জমিদার শ্রেণীর এবং প্রোগ্রাম বিরুদ্ধ। অতএব রোজা প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কংগ্রেস ও প্রজা দল (হক বিরোধী) চাপ দেয় জমিদারি প্রথা বিলোপ করার জন্য। বিরোধীদলের চাপে তিনি একটি কমিশন (ফ্লাউড কমিশন) গঠন করেন জমিদারি প্রথা বিলোপ করা যায় কিনা তা অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দেবার জন্য। কমিশন জমিদারি প্রথা বিলোপের পক্ষে সায় দেয়। কিন্তু নিরুপায় হক সে সুপারিশ কার্যকর করতে অপারগ। জমিদারদের নিয়ে মন্ত্রিত্ব করলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা যায় না। মুখ রক্ষা স্বরূপ বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সামান্য সংশোধনী এনে জমি কেনাবেচায় সেলামি প্রথা বিলুপ্ত করেন। যেখানে প্রজারা আশা করেছিল জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সেখানে বিলুপ্ত হলো মাত্র সেলামীর। পর্বতের এ মূষিক প্রসবকেই প্রচার করা একটি যুগান্তকারী সংস্কার বলে।
প্রচারণার একটি মহাঢোল ঋণ সালিশী বোর্ড।১৯৩৫ শানে নাজিমুদ্দিনের পৌরহিত্যে ঋণ সালিশী বোর্ড আইন পাশ হয়। জানা উচিত যে ১৯৩০ এর মহামন্দা কে কাটিয়ে ওঠার জন্য তৎকালীন ভারত সরকার যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল প্রতি প্রদেশে ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপন এর অন্যতম। ভারতের প্রতি প্রদেশে ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপিত হয় অনেক আগেই, কিন্তু নানা কারণে বাংলায় বোর্ডে স্থাপনে দেরি হয় সমকালীন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের সুপারিশে ১৯৩৫ সনে ঋণ সালিশী বোর্ড আইন পাস। নাজিমুদ্দিন জানতেন যে ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপন কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত নীতি। সে নীতির মোতাবেক তিনি সরকারের নির্দেশে আইন প্রণয়ন করেছেন। অতএব, এতে কোনো ব্যক্তিগত কৃতিত্ব গ্রহণের কিছু নেই। কিন্তু এর পুরো কৃতিত্ব দাবি করেন হক। প্রজা প্রোগ্রামের ব্যর্থতা ধামাচাপা দেবার জন্য ঋণ সালিশী বোর্ডের সফলতাকে দিকে দিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে করে রাষ্ট্র করা হয় যে হক ঋণগ্রস্থ কৃষকদের বাঁচিয়েছেন। ঋণ সালিশী বোর্ড পরিচালনা যে মন্ত্রী (এমন, বি মল্লিক) তিনি কিন্তু কোন বাহবা পাচ্ছেন না, একতরফাভাবে বাহবা পাচ্ছেন হক, যার দায়িত্ব ছিলো শিক্ষা। বাহবা পাচ্ছেন না নবাব হাবিবুল্লাহ যদিও কৃষি মন্ত্রী হিসেবে তিনি ঋণ সালিশী বোর্ডের অপারেশনে সাহায্য করেছেন সরাসরিভাবে।
সর্বাধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ঋণ সালিশী বোর্ড কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা হয়েছে যত এর কার্যকারিতার ফলে দেশের সাধারণ লোকের উপকার হয়েছে অনেক কম। সাধারন গরিব কৃষকরা বরং এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কীভাবে? ঋণ সমস্যা সবচাইতে প্রকট ছিল ধনী ও মাঝারি কৃষকদের মধ্যে (১৬)। জমি বন্ধক দিয়ে এরা ঋণ করে পাটের ব্যবসা করতো, বিয়ে-শাদী করতো, জমি কিনতো ইত্যাদি। যাদের জমি ছিল কম বা যারা ভূমিহীন বর্গাদার কৃষক তারা খুব একটা ঋণগ্রস্থ ছিলনা কেননা এরা দরিদ্র বলে মহাজন এদের ঋণ দিত না। ঋণ দিলেও সে ঋণ ছিল ফসলের বন্ধকে। ফসল উঠার সঙ্গে সঙ্গে মহাজন’ তার ফসলের অংশ নিয়ে নিত। কিন্তু ধ্বনি ও মাঝারি কৃষকের ঋণ সমস্যা ছিল অধিকতর জটিল। ধনী কৃষক ঋণ করেছে পেটে খাবার জন্য নয়; জমি কেনার জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য। ঋণ সালিশী বোর্ডের অপারেশনে এসব ঋণী ধনী কৃষক লাভবান হয়, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষক। কেননা এর ফলে মহাজন’ ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেয় যার ফলে পুঁজির অভাবে দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকেরা বর্গা জমি চাষ করতে প্রায় অক্ষম হয়ে পড়ে। বর্গাদারের অক্ষমতার কারণে লক্ষ লক্ষ একর জমি পতিত পড়ে থাকে। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের জন্য বহু কারণ দায়ী। এর একটি কারণ ঋণ সালিশী বোর্ডের অপারেশন এর ফলে গরিব চাষিদের ঋণ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
উপসংহার –
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে যদিও হক তাঁর সমকালীন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তথাপি একথা মনে করা ঠিক নয় যে তিনি ছিলেন আমাদের জাতীয়তাবাদের পিতা, গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী, কৃষক-মজুরের উদ্ধারকর্তা, শিক্ষার দিশারী ইত্যাদি। এসব উচ্চ বিশেষণে হককে বিশেষায়িত করা মানে হকের উপর অন্যায় করা, কেননা অসত্য ভাষণ ইতিহাসে ধরা পড়বেই। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক, নির্ধারণ করবে ইতিহাসে কার কি স্থান। কম নয় বেশি নয়, যথার্থ প্রাপ্য স্থান। স্তাবকগণ বেশি কিছু দিতে চাইলে ইতিহাসতা গ্রহণ করবে না।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1980.05.09-bichitra-copy.pdf” title=”1980.05.09 bichitra copy”]