বগুড়ায় বঙ্গবন্ধুর বিপুল সম্বর্ধনা
বগুড়া। উত্তরবঙ্গ সফরের শুরুতে সোমবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বগুড়াতে এসে পৌছেছেন। হেলিকপ্টারে করে প্রধানমন্ত্রী পুলিশ ময়দানে অবতরণ করলে তাকে বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বিপুল জনতার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রী ড. মফিজ চৌধুরী, আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতৃবৃন্দ ও লাল বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। রাত্রি থেকে যে বিপুল সংখ্যক জনতা বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল প্রধানমন্ত্রী একটি পাইলট মটরকারে উঠে তাদেরকে ঘুরে ঘুরে দেখেন। এখানে পৌছানের পর পরই বঙ্গবন্ধু স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। চার দিন ব্যাপী উত্তরবঙ্গ সফরের উদ্দেশ্যে হলিকপ্টারে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল সকালে ঢাকা ত্যাগ করেন। রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সাথে রয়েছেন। উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে- বঙ্গবন্ধু বগুড়া। সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের রুখে দাঁড়ান। এসব দুষ্কৃতকারীকে নির্মূল করতে পুলিশবাহিনীর সাথে সক্রিয় সহযোগিতা করুন। আজ বিকেলে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের প্রতি এই আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু জনগণকে হুশিয়ার করে নিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় এমন কিছু সংখ্যক লোক বিদেশি শক্তির সাথে যোগসাজসে
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, এসব ষড়যন্ত্রকারী যদি বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায় তাহলে গণঅভূত্থানের জন্য তিনি আবার জনগণকে ডাক দেবেন। কঠোর হস্তে ও সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র দালালদের রুখে দাঁড়াবার জন্য, প্রতিহত করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ এখানে মোজাফফর ন্যাপ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তারা আমার সাথে রয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি দেশবাসীর নিকট কৃতজ্ঞ। কারণ তার ডাকে দেশের জনগণ তাদের যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে একটি সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছে। প্রধানমন্ত্রী সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। এসব সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ধরনের সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ চালাচ্ছে, ডাকাতি করছে। তিনি এর আগে বলেছেন যারা তার আদেশ অমান্য করে অস্ত্রশস্ত্র দেয়নি, তারাই হলো আলবদর, রাজাকার। তাই তিনি তাদের পাকড়াও করে পুলিশের হাতে অর্পণের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এসব সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী আপনাদের ওপর নির্যাতন চালালে আপনারা অবশ্যই তাদের রুখে দাঁড়াবেন। এক পর্যায়ে তিনি শ্রোতামন্ডলীকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কি তাদের রুখে দাড়াবেন না? উপস্থিত শ্রোতামন্ডলী সমস্বরে হ্যা বলে সম্মতি জানান।
উৎপাদন বাড়ানোর ডাক : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ উত্তর বাংলায় গণসংযোগ সফরের প্রারম্ভে তার সোনার বাংলার স্বপ্নকে সার্থক করে তোলার জন্য উৎপাদন আরো বাড়াতে উদাত্ত আহ্বান জানান। বিশ্বে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে নজীর স্থাপনের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কঠোর পরিশ্রম করার জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি ডাক দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। শোষকদের শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এখন দেশবাসীর কাজ হলো দেশ গড়ার। পাকিস্তানের বন্দিখানা থেকে মুক্তির পর একদিনের জন্যও বিশ্রাম নেন নি বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, তিনি এসে এমন একটা দেশ লাভ করেন যা বিধ্বস্ত। যেখানে মানুষ অনাহারক্লিষ্ট। শত্রুরা দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে গেছে, গুদাম পুড়িয়ে দিয়েছে, সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের এক মহৎ গুণ রয়েছে, তা হলো সব রকম সমস্যাকে জয় করার দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, লোকের মুখে আবার হাসি ফুটবে, আমরা আবার সুখী হবো।
শ্রীমতি গান্ধির প্রশংসা : বঙ্গবন্ধু দখলদার পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর কুকীর্তিকে ইতিহাসে নজীরবিহীন বলে উল্লেখ করেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি ও জনগণের ভুয়সী প্রশংসা করেন। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর তথাকথিত মুসলমানরা নির্বিচারে আমাদের নারী জাতির ওপরে যে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, যেভাবে তাদের মান ইজ্জত নষ্ট করেছে ও হত্যা করেছে তার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এসব নরপশুদের শিকার হয়ে লাখ লাখ মহিলা আজ বিভিন্ন শিবিরে এক উদ্বিগ্ন জীবন যাপন করছেন।
গত চার মাসে সরকার যা করেছে : ক্ষমতা গ্রহণের চার মাস সময়কালে তার সরকার যে সব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তিনি তা উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ ও পরিবারের একশ বিঘা জমির সীমা নির্ধারণের বিষয় উল্লেখ করেন। সমাজতন্ত্রের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মূল শিল্প জাতীয়করণের বিষয়ও তিনি উল্লেখ করেন। জনগণ কঠোর পরিশ্রম করে নতুন দেশ গড়ে তুলবে বলে তিনি গভীর আস্থা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ক্ষমতা নয় আপনাদের ভালোবাসাই
আমার কাম্য। ক্ষমতা নয় আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে আমি মরে যেতে প্রস্তুত আছি। তিনি দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন, বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের দ্বার গোড়ায় অবশ্যই পৌঁছে দিতে হবে। তিনি বলেন, জনসাধারণকে তিন বছরের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে, আপনারা কিছুই পাবেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি রিলিফের অর্থের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন। এক পর্যায়ে তিনি জনসাধারণ কঠোর পরিশ্রম করতে রাজি আছেন কি না তা জানতে চান। উপস্থিত সকলে একযোগে হাত তুলে তার আহ্বানে সাড়া দেন। বঙ্গবন্ধু তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব সাহায্য পাওয়া যাবে, তা সব বন্টন করে নেয়া হবে। বাংলাদেশে শোষকদের স্থান নেই: বঙ্গবন্ধু আরো ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মাটিতে শোষকরা আর গজাতে দেয়া হবে না। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, রিলিফ দ্রব্যাদি বন্টনে যে কোন অব্যবস্থাপনাই কঠোর হস্তে দমন করা হবে। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, অসৎ ব্যবসায়ীদের চক্রান্তসহ কতিপয় কারণে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, লাইসেন্স বাতিলের জন্য তিনি যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তা শুধু তামাশা নয়। তিনি তাদেরকে সংশোধনের জন্য সময় দিয়েছেন মাত্র। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যেসব সরকারি কর্মচারী বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এসব পরজীবীদের শেষ করে দেওয়ার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানাবেন।২২ যমুনার উপর সেতু নির্মিত হবে- বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, যথাসময়ে যমুনা নদীর উপরে সেতু নির্মাণ হবে। তিনি সোমবার বিকালে বগুড়াতে জেলা স্কুল মাঠে এক বিরাট জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, সেতু নির্মাণের ব্যাপারে জাপান সরকারের সাথে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে একটি প্রাথমিক জরিপ দল বাংলাদেশ সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্মাণ কাজের আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য শীঘ্রই বিশেষজ্ঞদের একটি পুরো দল এখানে আসবে। এনার অপর এক খবরে বলা হয়, জাপানী নির্মাণ বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশ সরকারের কাছে যমুনার ওপর কতগুলো সুপারিশ করেছেন। এই সুপারিশে বলা হয়েছে, যমুনার ওপর ৪ মাইল দীর্ঘ সেতু হবে। এর উপরে রেল চলাচল ও রাস্তা থাকবে। এর ফলে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এই সেতুর উপর রেলওয়ে, ট্রাক, দুটি রাস্তা ও পথচারীদের জন্য একটি ছোট রাস্তা থাকবে।২৩ সাতক্ষীরায় প্রতি মন চাল ৮০ টাকা সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরা মহকুমায় এখন চাল প্রতিমণ ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এখানে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। স্থানীয় গণপরিষদের সদস্য জনাব এস, এম, আলাউদ্দীন ও সাতক্ষীরা মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব মোস্তাফিজুর রহমান পৃথক দুটি বিবৃতিতে এই খবরের সত্যতা স্বীকার করেছেন। অপরদিকে গত রোববার এক সাংবাদিক সম্মেলনে গণপরিষদ সদস্য ও সাতক্ষীরা মহকুমা রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ বখত বলেছেন, অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে দুর্ভিক্ষাবস্থায় নয় লাখ লোকের জন্যে প্রতি মাসে দেড় লাখ মন চাল ও তিন লাখ মন গমের প্রয়োজন। জনাব বখত রিলিফ বন্টনের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে বলেন, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি পুনঃরেশনীং প্রথা চালু করার দাবি জানিয়েছেন। শরণার্থীদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, অতি দ্রুত তাদের জন্য সাতশত ঘর নির্মাণ করা হবে। বি বি আর এস নামে একটি বিদেশি সংস্থা এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন বলে বখত জানান।
রেফারেন্স: ৮ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ