ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, উপস্থিত অথিতিবৃন্দ আপনারা আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করেন। গত কাউন্সিল সভায় আপনারা যোগদান করেছিলেন। সেবারে আমরা যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম এবং যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম তা কার্যকর করতে আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের বড় ভাই এবং সহকর্মী যাদের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল, যাদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘ ২৩/২৪ বৎসর কাজ করেছি, সে অনেক কর্মী এবং অনেক নেতা আজ আমাদের মধ্যে নাই, তারা শহীদ হয়েছেন। শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা, সরকারি কর্মচারীরা, সৈনিকবাহিনীর ভাইয়েরা, পুলিশবাহিনীর ভাইয়েরা, শ্রমিক ভাইয়েরা, ছাত্র ভাইয়েরা, বিশেষ করে যাকে আমরা বিডিআর বলি, বাংলাদেশ রাইফেলসের কর্মীরা। ওদের ফিরে পাব না। ওরা আর পৃথিবীর বুকে ফিরে আসবে না। ওদের ডাক দিয়েছিলাম সংগ্রাম করার জন্য, ওরা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল। ইতিহাস আমি বেশি তর্জমা করতে চাই না, তবে কিছুটা ইতিহাসের প্রয়োজন আছে। হঠাৎ স্বাধীনার সংগ্রাম শুরু হয় নাই। স্বাধীনতা শুরু হয়েছে অনেকদিন পূর্বে এবং সকল সময়ে সকল কথা বলা যায় না। আন্দোলনের মধ্যে থেকেই বুঝে নিতে হয়। এটা আপনারা জানতেন এবং বুঝতেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে তাদের জীবন বাজি রেখে নৌকা চালাতে হয়েছে। কোনোদিন তারা ভাটিতে নৌকা চালাতে পারেন নাই- কয়েক মাস ছাড়া। আওয়ামী লীগের ত্যাগ তিতীক্ষার ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই জন্য আজ লেখা থাকবে যে, আজ বাংলাদেশ স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। লেখা থাকবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পুলিশবাহিনীর ইতিহাস। যারা শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। কর্তব্য রয়েছে দেশবাসীর, কর্তব্য রয়েছে আওয়ামী লীগ কর্মীদের। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমনি কষ্টকর। স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া যেতে পারে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পাওয়া গেলে রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে যায়। ইতিহাস ও ছয় দফার পেছনেও অনেকটা ইতিহাস ছিল। এই কথা সত্য যে, শুধু শহীদ এই সংগ্রামেই হয়েছে তা নয়। বাংলার মানুষ বারবার শহীদ হয়েছে। ১৯৫২ সালে শহীদ হয়েছে বাংলার ছেলেরা। ১৯৫৪ সালে হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং অনেকে মৃত্যু বরণ করেছিলেন ও শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হওয়ার পরেও আওয়ামী লীগের অন্যান্য দল ব্যান্ড হওয়ার পরেও সেখানে অনেকের জান দিতে হয়েছিল। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতার হওয়ার পরেও অনেকের জান দিতে হয়েছিল এবং অনেকে জেলও খেটেছিল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের ফলে ১৭ জুন তারিখে আমার ছেলেরা জীবন দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা আন্দোলনে ছাত্ররা যে আন্দোলন শুরু করে, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দেরা সেখানে গিয়ে তাদের সহযোগিতা করে আন্দোলন চালিয়ে যায়, তখন অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। বাংলার ইতিহাস যে শুধু রক্তের ইতিহাস তা নয়, বাংলার ইতিহাস যে শুধু নির্যাতনের ইতিহাস তা নয়। বাংলার ইতিহাস শুধু যে আন্দোলনে একবারেই আমরা সংগ্রাম করেছি তা নয়, এ সংগ্রাম শুরু হয়েছে অনেকদিন আগে থেকেই। শুধু জনগণের খালি আওয়ামীলীগের সংগ্রাম চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে এটা জনগণের ও সরকার, সাড়ে সাত কোটি মানুষ-মানুষেরও সরকার। এটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। আমাদের কাজ করতে হবে।বিরোধী দলে থাকা এক রকমের পন্থা এবং সেখানে গঠনমূলক কাজ দিয়ে মুলত এগিয়ে যেতে হবে। অত্যাচার-অবিচার যেন না হয়। জুলুম যেন না হয়। লুটতরাজ যেন না হয়। দেহের মানুষকে ভালোবেসে মন জয় করতে হবে। তোমাদের কাছে আমার নির্দেশ , তোমাদের কাছে আমার আবেদন, তোমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমাদের কাছে রাতের আরাম , দিনের উত্তাপ হারাম, আমাদের দুঃখী মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে হবে। ভাইয়েরা আমার, আওয়ামীলীগ ক্ষমতাই যেতে চাইলে অনেক বার যেতে পারত। ক্ষমতার জন্য আওয়ামীলীগ জন্ম গ্রহন করে নাই। বাংলাদেশে শোষণহিন সমাজ গঠন করার জন্যই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলুন। আমাদের নীতি বিপরীত। নীতির সঙ্গে আপোষ হয় না। সেই জন্য জীবনে নীতির সঙ্গে আপোষ করতে পারি নাই। দরকার হলে দলের লোকজন যদি বেইমানী করে তার সঙ্গেও আমি আপোষ করতে রাজি নই। নিয়মের উর্ধ্বে উঠতে হবে। নিয়ম যেখানে ধ্বংস সেখানে একবার যদি নীল হয়ে যান, সে জীবনে কোনোদিন আর মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবেন না। শুধু আপনার মুখে কালি দেবেন, কালি দেবেন এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে। যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীন হয়েছে, সেই আওয়ামী লীগের মুখ কালি হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ কর্মীদের দায়িত্ব যথেষ্ট রয়েছে। এই দায়িত্ব থেকে তারা রেহাই পেতে পারেন না। আমরা শৃঙ্খলা রাখতে চাই, আমরা গণতন্ত্র কায়েম করতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্র মানে উশৃঙ্খলা নয়। গণতন্ত্র মানে গোপনে পোষ্টার দিয়ে ষড়যন্ত্র নয় এবং আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে সেটাও নয়। সেখানে সরকারের একটু শক্ত হতে হবে এবং শক্ত হবে, ভাল হইতে হবে সন্দেহ নাই এবং সেটাও আমরা করতে চাই না। জনগণই করবে সে বিশ্বাস আমার আছে। আর জনগণকে আমি চিনি, জনগণ আমাকে চিনে। জনগণ আমাদের ভালোবাসে, আমরা জনগণকে ভালোবাসি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, আমাদের বৈদেশিক নীতি পরিষ্কার। আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি পরিষ্কার এবং তা মেনে চলে। নিরপেক্ষ ইনডিপেনডেন্ট ফরেন পলিসি । আমাদের ফরেন পলিসি, বৈদেশিক নীতি পরিষ্কার। আমরা কোনো যুদ্ধ সংঘাতে বিভ্রান্ত হতে চাই না এবং করব না। আমরা সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে বাস করতে চাই। আমরা সহবস্থানে বিশ্বাস করি। আমরা দুনিয়ার দুঃখী মানুষ যেখানে সংগ্রাম করবে, তার পক্ষে বাংলাদেশ দাঁড়াবে। কারণ আমরা দুঃখী, আমরা কষ্ট সহ্য করেছি। আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে স্বাধীনতা নিয়েছি। আমরা যেখানে দুনিয়ার সকল মজলুম মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, আমরা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াব।
রেফারেন্স: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ