You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.26 | রাতের বেলায় সারা বাংলাদেশে কায়েম হয় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ত - সংগ্রামের নোটবুক

রাতের বেলায় সারা বাংলাদেশে কায়েম হয় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ত

ঢাকা থেকে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজ উইক’-এর বিশিষ প্রতিনিধি সিনিয়র সম্পাদক আর নাে দ্য বােরচা গ্রাফ বাংলাদেশের অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা খুবই নির্ভরযােগ্য ও বিশ্ববাসীর কাছে তা বাঙলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিশেষভাবে তুলে ধরতে। বাঙলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর এখন মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে। পাকসেনারা এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের পথে। সারা বাঙলাদেশে এখন ১ লক্ষের উপর গেরিলা সৈন্য খান সেনাদের খতম করবার কাজে নিয়ােজিত। চরম আঘাত হেনে শত্রুকে ধরাসায়ী করবার সময় আজ সমাগত। সারা বাঙলাদেশের মানুষ আজ বলেছে, আমরা প্রতিশােধ চাই। ঘরে ঘরে আজ সত্যই দুর্গ গড়ে উঠেছে। অবিচল বাঙালী আজ যুদ্ধ করছে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাঙলাদেশের সত্তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। জয়ের চরম লগ্ন আজ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রান্তে। বাঙালী অনুভব করছে বিজয় লক্ষ্মির হাতছানি।  সাংবাদিক বােরা লিখেছেনঃ “আমি ও লন্ডন ডেলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ক্লার হােলিং ঢাকা থেকে ৫ মাইল দূরে মুক্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতা যােদ্ধাদের সদর দফতরে আমরা দেখতে গেলাম, যােদ্ধারা প্রকাশ্যেই তাদের আস্তানার চার ধারে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছে। ওদের কোন ভয় নেই পাক-ফেীজের জন্য। প্রত্যেকেই ওরা পরস্পরের সাথে কথা বলছিল সাধারণ কণ্ঠস্বরে। গেরিলা নেতা আবদুল মান্নান আমাদের বলেন, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা তাই ভয় পাই। পাক-ফেীজ আসছে এই খবর পৌছে যায় আমাদের কাছে। যথাসময়ে জনসাধারণ আমাদের হুঁশিয়ার করে দেয় পাক ফৌজের আগমন সম্পর্কে। আমরা কেউই এখন পাক-ফৌজের কোন আক্রমণের আশংকা করছি না।’ মান্নানের বয়স ৪৩ বৎসর। এক সময় সরকারী চাকুরে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি এই মুক্ত এলাকার ১৫০০০ লােকের শাসন পরিচালক ও গেরিলা নেতা।

মান্নান বলেন, ‘পাক-সামরিক বাহিনীর এখানে আসবার সাহস নেই। আমরা ইচ্ছা করলে যে কোন জায়গায় যেতে পারি। দিনের আলােতেই যেতে পারি।” সন্ধ্যায় মান্নানের সাথে ভাত খেতে খেতে আমাদের আরাে অনেক কথা হয়। মান্নান বলেন, কদিন আগে আমরা একট্রাক পাকফৌজকে খতম করেছি। ১৯ জন সৈন্য ছিল ট্রাকে। আমাদের ডুবুরিরা ক্যাপ্টেন কে, এম, সাজাহানের নেতৃত্বে দুটি পাকসামরিক জলযান ডুবিয়ে দিয়েছে। ২৫ বছর বয়সের কমান্ডাে নেতা কথার মধ্যে পাক ফৌজকে বিদ্রুপ করে বলে ওঠেন, ‘ওরা কাপুরুষ। ওদের মত ভীতু সৈনিকের কথা কল্পনা করা যায় না। আমরা যদি নদীর এপর থেকে একটা ফাকা আওযাজ করি তবে ওরা নদীর অপর পারে যেয়ে আশ্রয় নিতে চায়। আর তখনই ওরা গিয়ে পড়ে নদীর অপর পারে আমাদের লুকিয়ে থাকা অন্য গেরিলা দলের হাতে। সব খতম হয় ওরা… গেরিলারা গর্ব করে বলেন, কদিন আগে ওরা ৩১ জন পাক-ফৌজ ও রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে ফেলেন এবং পরে তাদের গুলি করে মারেন। শত্রু সৈন্যকে বন্দি করে রাখবার মত কোন সংগতি নেই আমাদের। তাই গুলি করে মারতে হয় আমাদের যুদ্ধ বন্দিদের। তবু রাখতাম যদি ওরা আমাদের ধৃত বন্ধুদের অমনভাবে গুলী করে হত্যা করত।” মান্নান আমাদের বুঝিয়ে বলেন, “গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই ভােটের বিজয়কে করে পদদলিত। সামরিক বাহিনী আমাদের উপর চালায় অকথ্য অত্যাচার। আমরা   এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। শক্রর অত্যাচার আমাদের করে তুলেছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা যুদ্ধ করছি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি, একটি নতুন দেশ গড়বার জন্য। নিউজ উইকের খ্যাতনামা সাংবাদিক আরাে লিখেছেন ?  “পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক সময় গােলাবারুদ ও অস্ত্রে গেরিলাদের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এখন এই শক্তি ক্ষয়ের পথে । তারা আর এদিক থেকে গেরিলাদের চাইতে উচ্চমান সম্পন্ন নয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের ভরসা ছিল, আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাবে। তাই তার অস্ত্র ও গােলাবারুদের ঘাটতি হবে না। কিন্তু আমেরিকার সামরিক সাহায্য বন্ধ করায় পাক রণসজ্জায় দারুণ আঘাত লেগেছে।  বাংলাদেশে এখন সব সরকারী কর্মচারী, গ্রামের মােড়ল, সকলেই গােপনে সাহায্য করছে। মুক্তিবাহিনীকে। কম পক্ষে বাঙলাদেশের চারভাগের এক ভাগ অঞ্চলে এখন পুরাপুরি মুক্তিবাহিনীর প্রশাসন চালু হয়েছে। রাতে বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায়ই চলে যায় গেরিলাদের অধিকারে। এখন খেয়া ঘাটে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে কদাচিৎ পাক-ফৌজ চোখে পড়ে। সহরগুলাের বাইরে সাধারণতঃ পাক ফৌজরা এখন খুব কমই টহল দিয়ে বেড়ায়।

পাক সামরিক বাহিনীর নানা অত্যাচারের কাহিনী আমি শুনেছি। একটি গ্রামে ১০ বছরের একটি মেয়ের উপর বলকার করে ১২ জন পাক-সৈন্য। তার পর তাকে হত্যা করে তারা। এক গ্রামে সৈন্যরা গিয়ে দু’জন যুবতি মেয়ে দাবী করে। গ্রামবাসী জানায় ফৌজি বড় কর্তাকে। দুজন ফৌজকে ধরে নিয়ে যাবার আদেশ হয়। পরদিন সেনাবাহিনীর লােক এসে পুড়িয়ে দেয় সারা গ্রামটাকেই । ৩৮ জন লােক নিহত হয় এই ফৌজি হামলায়। যেখানেই আমি গিয়েছি মুক্তিবাহিনীর লােক ও সমর্থকরা সর্বত্রই বলছে, শেষ চূড়ান্ত বিজয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। একটা নদীর খেয়া ঘাটে দেখতে পেলাম একজন পাক সামরিক কর্মচারী একজন সাধারণ লােককে ছড়ি দিয়ে পিটাচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে, মার বন্ধ করেন অফিসারটি। পরে সেই মার খাওয়া লােকটি আমাকে বলেছিল ও রােজ রােজ এমনি অনেক ঘটনাই ঘটে। কিন্তু প্রতিশােধের দিন আসছে। আর সেদিনটা ওদের পক্ষে হবে ভয়ঙ্কর।” (নিউজ উইক, নভেম্বর ২২, ১৯৭১)।

জয়বাংলা (১) ১: ২৯

২৬ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯