আজাদ
৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
ভাসনী মুজিব ভুট্টো ছাড়া আলোচনা হইলে ‘ডাক’ নেতৃবৃন্দের মুখোশ উন্মোচিত হইবে
(আজাদের ‘পিণ্ডি অফিস হইতে)
২রা ফেব্রুয়ারী। -মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব এবং ভুট্টো ছাড়াই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব প্রস্তাবিত আলোচনা বৈঠকে অংশ গ্রহণ করিলে ‘ডাক’ নেতৃবৃন্দের মূখোশ উন্মোচিত হইয়া যাইবে।
বর্তমান সরকারের আমলে যাহারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উপকৃত হইয়াছেন কেবলমাত্র তাহারা ব্যতীত সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের কোন মহলই প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাবে অনুকূল সাড়া দেন নাই।
ট্যাক্সী ড্রাইভার হইতে শুরু করিয়া রাজনীতিবিদ পর্য্যন্ত গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করিতেছেন। রেষ্টুরেন্ট ও বিভিন্ন দোকানে সাধারণ মানুষ প্রেসিডেন্টের মাস পহেলা বেতার ভাষণ শ্রবণ করিয়া গৃহাভিমুখে গমনের সময় তাহাদিগকে বিরূপ মন্তব্য করিতে শোনা যায়। প্রত্যেকেই মাস পহেলা বেতার ভাষণে অন্ততঃ কোন নাটকীয় ঘোষণা আশা করিয়া ছিল, যাহা দেশে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিবে।
চৌধুরী মোহাম্মদ আলী প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে ‘দ্ব্যর্থবোধক’ বলিয়া অভিহিত করেন এবং বলেন যে, ইহা চোখে ধুলা দেওয়ার সামিল।
আসগর খান
এয়ার মার্শাল আসগর খান কোন রকম মন্তব্য প্রকাশ করিতে খুব বিব্রত বোধ করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব সম্পর্কে বেশ সন্দেহ পোষণ করিতেছেন। এমন কি তিনি এই মৰ্ম্মে আশঙ্কা পোষণ করিতেছেন যে, উক্ত প্রস্তাব সমস্ত আন্দোলনকে ব্যাহত করিতে পারে।
ডাকে উভয় সঙ্কট
ডাক প্রকৃতপক্ষে ‘ডাঙ্গায় বাঘ জলে কুমীর’ দশার সম্মুখীন হইয়াছে। তাহাদের পক্ষে এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যতটুকু অসুবিধাজনক, ততোধিক অসুবিধাজনক হইতেছে ইহা প্রত্যাখ্যান করা।
তাহাদের ভয়, যদি আন্দোলন একবার বন্ধ হইয়া যায়, তাহা হইলে ইহাকে পুনরুজ্জীবিত করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেন না, তাহারা এই আন্দোলনের হোতা নন। তাহাদের ব্যক্তিগত অদূরদর্শিতা এবং সম্মিলিত দুর্ব্বলতার দরুন তাহারা এই মর্ম্মে শঙ্কাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন যে, তাহারা লোভের শিকারে পরিণত হইতে পারেন অর্থাৎ গোল টেবিল বৈঠকে সরকারের পক্ষ হইতে যাহা ব্যক্ত করা হইবে, তাহারা ইহার ফাঁকে পড়িয়া যাইতে পারেন।
ডাকের যাহারা ঝানু রাজনীতিবিদ তাহারা চোরাবালির ফাঁদের আভাস পাইয়াছেন। তাহারা ঠিক বুঝিতে পারিয়াছেন যে, কোথায় তাহাদিগকে ফাঁদে আবদ্ধ করা হইবে। তাই তাহারা বারবার বলিতেছেন যে, প্রেসিডেন্ট যদি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্ব্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হন, তাহা ইইলে মৌলিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্ব্বাচিত হইলে তাহাদের কোন আপত্তি থাকিবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের জনগণ এই ধরনের কোন প্রস্তাব মানিয়া লইতে পারে না। কেননা, এই ধরনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হইলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবই পুনরায় ক্ষমতাসীন হইবেন। ডাকের বিরুদ্ধে এই মৰ্ম্মে অভিযোগ রহিয়াছে যে, ডাক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটিকে জলাঞ্জলি দিয়াছে।
মাস পহেলা বেতার ভাষণের মধ্য দিয়া প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সুস্পষ্ট মনোভাব প্রকাশ পাইয়াছে। ইহা পরিস্কারভাবে বুঝা যায় যে, প্রেসিডেন্ট নির্ব্বাচনের জন্য যদি একটি পৃথক নির্ব্বাচকমণ্ডলী দাবী করার ইচ্ছা না থাকিত, তাহা হইলে মাস পহেলা বেতার ভাষণে তিনি আসন্ন নির্ব্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার কথা ঘোষণা করিতেন।
তাহা হইলে সকলের পছন্দমত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হইত।
ডাক যদি আলোচনা বৈঠকে অংশ গ্রহণ করিয়া নিজেদের মূল দাবীগুলি পূরণ করিতে না পারে তাহা হইলে তাহাদের কোন লাভ হইবে না। তদুপরি, তাহারা যদি মওলানা ভাসানী, ভুট্টো এবং শেখ মুজিবকে ছাড়াই আলোচনা বৈঠকে অংশ গ্রহণ করেন তাহা হইলে তাহাদের মুখোশ আরও উন্মোচিত হইয়া পড়িবে।
আতাউল্লা খান মোঙ্গল
এপিপি পরিবেশিত এক খবরে জানা যায় যে, সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য সরদার আতাউল্লা খান মোঙ্গল জনগণের মৌলিক দাবীসমূহের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য বিরোধী দলীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন।
ইস্পাহানী
সাবেক নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য জনাব এম, এ, এইচ, ইস্পাহানী জনগণের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়ার জন্য সরকার ও বিরোধীদলগুলির প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। প্রস্তাবিত বৈঠক অনুষ্ঠানের পূর্ব্ব শর্ত হিসাবে তিনি সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দানের কথা উল্লেখ করেন।
মীর লায়েক আলী
হায়দরাবাদের সাবেক উজিরে আলা মীর লায়েক আলী এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা দফতরের সাবেক উপদেষ্টা বলেন, কোন ব্যক্তি অথবা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবর্গের সহিত যে কোন রকম সমঝোতা জনগণের মৌলিক দাবীসমূহ মিটাইতে সক্ষম হইবে না।
মেজর জেঃ জিলানী
মেজর জেনারেল এম, জি, জিলানী দেশের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানাইবার আহ্বান জানান।
জমিয়াতুল উলেমা
পশ্চিম পাকিস্তান জমিয়াতুল উলেমা প্রস্তাবিত বৈঠকে ইহার যোগদান সম্পর্কে দুইটি শর্ত আরোপ করিয়াছেন। শর্ত দুইটি হইতেছে, সকল অনৈসলামিক আইন বাতিল ও ওয়াকফ বিভাগ বিলোপ।
চৌধুরী নাজির আহম্মদ
সাবেক এটর্নী জেনারেল চৌধুরী নাজির আহম্মদ প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবকে শুধু নৈরাশ্যজনকই নয় দুর্ভাগ্যজনক বলিয়াও অভিহিত করিয়াছেন।
করাচীর ছাত্র নেতৃবর্গ
পিপিআই পরিবেশিত খবরে বলা হয়, করাচীর তিনজন ছাত্র নেতা বলেন যে, সকল ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি ও ছাত্র সমাজের মতামত প্রকাশের অধিকার না দেওয়া পর্য্যন্ত সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোন আলোচনা অনুষ্ঠিত হইতে পারে না।
বেলুচ ছাত্র সংস্থার অস্থায়ী চেয়ারম্যান মুনীর আহম্মদ বালুচ, করাচী ছাত্র সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান মীর গওহর খান এবং সিন্ধী ছাত্র ফেডারেশনের কনভেনর প্রেম আগাস্থা তাহাদের উক্ত বিবৃতিতে বর্তমান গোলযোগপূর্ণ পরিবেশে সরকারের সহিত আলোচনায় প্রবৃত্ত না হওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির প্রতি আহ্বান জানান।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯