মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে পালাচ্ছে পাক সেনা
মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণ অভিযান গােটা দেশের সর্বত্র হানাদার পাকসেনাদের কোণঠাসা করে। ফেলেছে এবং সাফল্যের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিবাহিনীর এই আঘাতে বিভিন্ন রণাঙ্গনে বহু পাক সেনা নিহত ও আহত হবার খবর পাওয়া গেছে। | পূর্ব রণাঙ্গণ থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে যে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ জেলায় মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাক-সেনারা ময়মনসিংহ জেলার ঘােষগাও এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এরপর পাক-সেনারা হালুয়াঘাট এলাকা থেকেও পিছু হটে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। টুকার বাজার এলাকায় আমাদের গেরিলাদের আক্রমণে আট জন পাকসেনা এবং রাজাকার নিহত হয়েছে। সাতীগাঁও এলাকায়ও ন’জন পাকসেনা আমাদের গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে। শ্যামগঙ্গা এলাকায়ও বারজন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়েছে। এখানকার সংঘর্ষে দু’জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হয়েছে। পাকসেনাবাহী তিনটি জীপের ওপর আক্রমণ চালিয়ে পিয়ার পুর এলাকায় আমাদের গেরিলারা কয়েকজন পাক সেনাকে নিহত করেছে এবং শত্রু সেনাদের তিনটি রাইফেল ছিনিয়ে নিয়েছে।
গত পনের তারিখে নােয়াখালির ছাগলনাইয়ার পাক ঘাটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তি বাহিনীর পাঁচজন পাক সেনাকে নিহত করেছে। এর আগে কাবিলপুর এলাকায় একজন অফিসার, আটজন পাকসেনা নিহত এবং সাত জন আহত হয়েছে। সতের তারিখে মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার চান্দালায় অবস্থিত পাক ঘাটিটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে ছ’জন পাক সেনাকে নিহত করেছে। এই ঘাটির দুটি বাঙ্কারও মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এর দুদিন আগে আড়াইঘর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর হাতে দু’জন পাক-সেনা নিহত এবং আহত হয়েছে। জয়নগর এলাকায় দুদিনের গেরিলা আক্রমণে চারজন পাক সেনা নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছে। বিলম্বে পাওয়া এক খবরে জানা গেছে যে, আমাদের গেরিলারা চট্টগ্রামের কাপ্তাই অঞ্চলে। অনেকগুলাে বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই এলাকায় মুক্তি যােদ্ধাদের আক্রমণে সাতজন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়েছে। উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পাক সেনাদের ঘাটিগুলাের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী এখন পাক সেনাদের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এই অংশে মুক্তিবাহিনী বিস্তৃর্ণ এলাকা শত্রু কবল মুক্ত করেছে। এর মধ্যে খুলনার সাতক্ষীরা, ডেমরা কলারােয়া এলাকা থেকে পাক সেনারা সম্পূর্ণ ভাবে বিতাড়িত হয়েছে। রংপুর জেলার জগদ্দল, অমরখানা, রায়গঞ্জ, হাতীবাধা এবং বড়কাটা এলাকাও শত্রু কবল মুক্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী যশাের ক্যান্টনমেন্টের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী জেলার গোদাগড়িতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে দু’জন পাক সেনা নিহত এবং চারজন আহত হয়েছে। গত মােল তারিখে মুক্তিবাহিনী এই সাফল্য লাভ করেছে। এর আগের দিন টহলদানরত তিনজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। শান্তহার আদমদীঘির মধ্যে একটি পাক সেনাবাহী বিশেষ ট্রেন গেরিলাদের মাইনের আঘাতে লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এখানে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। কুষ্টিয়ার আলমডঙ্গায় পাক ঘাটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সতেরজন পাক-সেনাকে খতম করেছে। এখানে দু’জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আব্দুলবাড়িয়া থানায় বাঙালী পুলিশদের সাহায্যে কোন রকম কাজ চালাতে ব্যর্থ হয়ে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ আমদানী করে নিয়ােগ করা হয়েছিলাে। আমাদের গেরিলারা এই থানার ওপর আক্রমণ চালিয়ে বারজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে নিহত করেছে। এর আগে মুক্তিবাহিনীর মাইনের আঘাতে একজন রাজাকারসহ দশজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। গান্তি এলাকায় মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে সাতজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। গােরপাড়া এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে সাতজন পাকসেনা এবং বহু রাজাকার নিহত হয়েছে। খােজাইরপুরে মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রচণ্ড সংঘর্ষে তেরজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। এর মধ্যে একজন ক্যাপ্টেনও রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষেও তিনজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়েছে; সাকুরা এবং মােহনপুরের ঘাটিগুলার ওপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদের বাহিনী বহু রাজাকার এবং পাকিস্তানী চরকে নিহত করেছে।
এই সমস্ত ঘাটিগুলাে থেকে সাতান্নটি রাইফেল এবং অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী কামারখালীঘাটের একটি ফেরী নৌকা ধ্বংস করে দিয়েছে। পাক-সেনাদের সরবারাহ ব্যবস্থা নষ্ট করে দেবার জন্যেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। রায়পাড়া এলাকাতে মুক্তিবাহিনীর সাথে রাজাকার বাহিনীর একপ্রচণ্ড সংঘর্ষে চল্লিশজন রাজাকার নিহত হয়েছে। গত তের তারিখে রাজাপুরে মুক্তিবাহিনীর হাতে ছ’জন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়েছে। চৌগাছা যশােরের মধ্যবর্তী রেল-সড়কের বহু কালভার্ট তুলে ফেলে রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা অকেজো করে দিয়েছে।
বাংলার মুখ : ১০
২৬ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯