সংবাদ
৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
সংগ্রামী ছাত্র-সমাজ কর্তৃক গোলটেবিলের আগে পূর্বশর্ত পূরণের আহ্বান
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
‘হাজীগঞ্জ হত্যার’ প্রতিবাদে শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কার্জন হল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদ সভায় শহীদের রক্তলেখা ১১ দফা বাস্তবায়ন সাপেক্ষে ঐক্যবদ্ধ দুর্জয় গণ-আন্দোলন অব্যাহত রাখার সংকল্প গ্রহণ করা হয়।
সভায় সম্ভাব্য গোলটেবিল বৈঠকের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে পূর্বশর্ত স্বরুপ কতিপয় দাবী পেশ এবং উহা বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত বিরোধীদলসমূহের প্রতি কোনরূপ আলোচনা বৈঠকে মিলিত হওয়া হইতে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়। এই পূর্ব শর্তসমূহ হইল অবিলম্বে জরুরী আইন প্রত্যাহার, ছাত্র শ্রমিক কৃষক সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, রাজবন্দী বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্যের মামলা সহ সকল প্রকার মামলা মোকদ্দমা প্রত্যাহার, রাজনৈতিক মামলার প্রদত্ত দণ্ড মওকুফ, গ্রেফতারী পারোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং সংবাদপত্রের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। উপরোক্ত পূর্বশর্তসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আলোচনা সভার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করিলেই কেবল বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বৈঠকে মিলিত হইয়া বিভিন্ন গণদাবী দাওয়ার প্রশ্নে আলোচনা করিতে পারেন।
সভায় এই মর্মে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয় যে, বিগত দশকে জনসাধারণের দুর্গতি চরম সীমায় উপনীত হইয়াছে। বিভিন্ন দাবীদাওয়া আদায়কল্পে ছাত্রজনতা বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করিয়াছে। ছাত্র-জনতার দুর্জয় আন্দোলনের ফলেই গণবিরোধী সরকার আলোচনা বৈঠকের প্রস্তাব দিয়াছেন। সুতরাং ছাত্র-জনতার মূল দাবী-দাওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণমুক্ত করার দাবী কোনরকম চাতুর্যপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করিয়া বানচাল করিলে দেশের যুব-সমাজ বিরোধীদল এবং জননেতাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করিবে বলিয়া সভায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি জনাব তোফায়েল আহমদ। বক্তৃতা করেন সর্বদলীয় কেন্দ্ৰীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য জনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী, জনাব সামসুদ্দোহা, জনাব মাহবুবউল্লাহ ও জনাব ফখরুল ইসলাম প্রমুখ।
বক্তাগণ হাজিগঞ্জ সহ বিভিন্ন স্থানের ছাত্র গণহত্যা এবং দমননীতির বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া বলেন যে, বুলেট-বেয়নেট-ব্যাটন গণআন্দোলন প্রতিহত করার উপায় নয়, গণদাবীর বাস্তবায়নই গণআন্দোলন প্রশমিত করার একমাত্র পথ। তাহারা সম্ভাব্য গোলটেবিল বৈঠকের উল্লেখ করিয়া বলেন যে, গণবিরোধী সরকার ঠেলায় পড়িয়া একদিকে গোলটেবিলের টোপ ফেলিয়াছেন অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীলতার বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক গুলী, লাঠি, কাঁদুনে গ্যাস, ধরপাকড় প্রভৃতি অব্যাহত গতিতে চালাইয়া যাইতেছেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দ আরেক কথায় বর্তমান ক্ষমতাসীন মহলের সত্যিকার চেহারাটি বিস্মৃত না হওয়ার আহ্বান জানান। তাহারা বলেন যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুর্বলতায় যদি জনসাধারণের বঞ্চনা থাকিয়াই যায় তাহা হইলে যুবসমাজ তাহা বরদাশত করিবে না।
ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাঁহাদের ১১ দফার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তাঁহারা বলেন যে, ১১ দফা ইতিমধ্যে প্রদেশবাসীর অন্তরে আশার আলো প্রজ্বলিত করিয়াছে। তাহাদের এই আলো নির্বাপিত হইতে দেওয়া চলিবে না। ১১-দফার জন্য ছাত্র সমাজ যে কোন ত্যাগ ও নির্যাতন বরণ করিতে প্রস্তুত।
ছাত্র নেতৃবৃন্দ সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতি ক্ষমতাসীন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলেন যে, আসাদুজ্জামানের আত্মবলিদানের পর প্রদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হইয়াছে, গুলীতে প্রাণ দিয়াছে, লাঠ্যাঘাতে মস্তক ফাটিয়াছে, কাঁদুনে গ্যাসে ও বেয়োনেটের খোঁচায় অসংখ্য আহত হইয়াছে কিন্তু দমিত হয় নাই। আন্দোলন দুর্বার হইয়াছে। সরকারী নির্যাতন নীতি অব্যাহত থাকিলে আন্দোলন আরও প্রচণ্ড শক্তি ও গতিশীল হইবে বলিয়া তাঁহারা ঘোষণা করেন।
ছাত্র-নেতৃবৃন্দ আপামর জনসাধারণের প্রতি ত্যাগের অধিকতর মনোবল লইয়া আন্দোলনে আগাইয়া আসার আহ্বান জানান। এবং বলেন যে, অনাহারে তিলে তিলে মৃত্যুবরণের চাইতে বুলেটের আঘাতে বীরের মৃত্যুবরণ অধিকতর শ্রেয়।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯