’৭১—এর রণাঙ্গন – সৈয়দাবাদ গোলন্দাজ ঘাঁটি আক্রমণ
২ নম্বর সেক্টর, দেবীপুর সাব-সেক্টর | ক্যাপ্টেন (অবঃ) হুমায়ূন কবীর, বীর প্রতীক | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩ জানুয়ারি ১৯৯৭
মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কর্নেল গাফফার মন্দভাগ/কোনাবন এলাকার দায়িত্বভার গ্রহণ করে চলে যান। আমার ওপর ন্যস্ত হয় কসবা দেবীপুর সাব-সেক্টরের দায়িত্ব। আমার অধীনে ছিল দুই কোম্পানীর অধিক সৈন্য। একটা ইপিআর কোম্পানী, আর ৪ ইস্ট বেঙ্গল ও কিছু অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আর এক কোম্পানীর সৈন্য।
সৈয়দাবাদ গোলন্দাজ ঘাঁটি আক্রমণ
মে গড়িয়ে জুন মাস আসলো। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএন্ডবি রোডের পূর্ব পাশ থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা মোটামুটি আমাদের রণাঙ্গন। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো বেছে বেছে পাকিস্তান আর্মি তাদের ঘাঁটি গেড়েছে। পাকা সড়কে তারা কনভয় আকারে টহল দিত আর আর দু’পাশের গ্রামগুলোতে নেমে অত্যাচার চালাত। ইন্ডিয়ান বর্ডার বেল্ট ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণে, আর এর মধ্যবর্তী জায়গাতে হতো সংঘর্ষ। সুযোগ-সুবিধা মতো আমরা তাদের চলাচল এবং টহল পার্টিতে চোরাগুপ্তা আক্রমণ করতাম ও গেরিলা নীতি অনুসারে সবরকমের হয়রানি করতাম। সে সময় সিএন্ডবি রোডে তারা মোটামুটি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতো। আমাদের জন্য তখন ভীষণ একটা দুশ্চিন্তার কারণ ছিল সৈয়দাবাদের একটি গান পজিশন। এখানে আমাদের জানামতে ছিল ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের চারটা ১০৫ মিলিমিটার হাউইটজার। এই কামানগুলো আমাদের একটা শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের ঘাঁটিগুলোর অবস্থানের ব্যাপারে পাক আর্মির একটা মোটামুটি ধারণা ছিল এবং তারা যখন তখন আমাদের উপর শেলিং করত এবং আমাদের তরফ থেকে কোনো রকম মুভমেন্টের আভাস পেলেই বৃষ্টির মত শেলিং শুরু হয়ে যেত। আমাদের ট্রুপস এবং অনিয়মিত যোদ্ধাদের জন্য এটা ছিলো খুব ডিমরালাইজিং। আর্টিলারীর শেল যখন মাথার উপর বাতাস কেটে শীস দিয়ে উড়ে যেত তখন সবার মনেই দারুণ প্রতিক্রিয়া ও ভয়ের সঞ্চার করে। আমরা এর কোন প্রতি উত্তর দিতে পারতাম না। আমাদের কাছে ছিল শুধু ৩র্র্ মর্টার যার রেঞ্জ ছিল অনেক কম। সৈয়দাবাদ পজিশন থেকে নিরাপদে তাই এই পাকিস্তানী গানগুলো উত্তরে নরসিংগড় থেকে দক্ষিণে শালদা নদী পর্যন্ত শেলিং চালিয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক করলাম এই গানগুলোর উপর আক্রমণ করবো। যুদ্ধের তখন দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। প্রাথমিক সংঘর্ষের পর পিছু হটে আমরা সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছি। পাকিস্তান আর্মি ও স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানগুলো দখল করে তাদের পাকা ঘাঁটি গেড়েছে। বর্ডার এলাকায় সীমিত রেইড ও এম্বুশের মাঝেই সংঘর্ষ সীমিত। এই গান পজিশন আক্রমণ হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের একটা বড় ধরনের প্রতি-আক্রমণ।
আমাদের সোর্স কাজে লাগিয়ে এবং আমাদের রেকি পার্টি পাঠিয়ে খবর সংগ্রহ শুরু করলাম। সৈয়দাবাদ গ্রামের পূর্ব পাশে তান্তর বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে একটা ব্রীজ আছে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কের উপর যেটার নাম তীনলাখপীর ব্রীজ। এরই দক্ষিণ পার্শ্বে এই গান পজিশনে মোট চারটি কামান, দু’টি উত্তরমুখী ও দু’টি দক্ষিণমুখী করে বসানো। গানগুলোর নিরাপত্তার জন্য আছে এক কোম্পানীর বেশি সৈনিক।
জুনের প্রথম সপ্তাহে আমাদের প্ল্যানিং প্রিপারেশন শেষ হলো। ঠিক করলাম আক্রমণ করে ঘাঁটি দখল নয়, আমরা গান পজিশনটা রেইড করবো। যতটুকু সম্ভব ম্যান ও ম্যাটেরিয়ালের ক্ষতি করার চেষ্টা করবো। দুটো প্ল্যাটুন রেডি করলাম। খন্ডকালীন নৈশ আক্রমণের জন্য। যেখানে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা নেই, সেখানে এরকম সংখ্যায়ই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সুবিধাজনক। প্ল্যাটুন দু’টির নেতৃত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার সাত্তার ও শহীদ। যাদের কথা মনে পড়ছে এর মধ্যে এনসিওরা ছিলেন ফজলু, হাসেম, জিয়াউল, সিরাজ, বাচ্চু ও আরো অনেকে।
এর আগে দু’দিন ধরে গান পজিশনের স্যান্ড মডেলের উপর প্ল্যাটুন কমান্ডার ও সিনিয়ার এনসিওদের কার কি করণীয় ও কর্তব্য সব কিছুর উপর সম্যকভাবে ব্রিফিং করেছি। সবার মধ্যেই সঞ্চারিত হয়েছে একটা চাপা উত্তেজনা ও টেনশন। এই প্রথম একটা বড় ধরনের আক্রমণের জন্য যাচ্ছি। আমাদের যাত্রার দিন রাতের খাওয়ার পর থেকেই প্রিপারেশন শুরু হয়ে গেছে। হাতিয়ার পরিষ্কার করা হয়েছে। রাতের উপযোগী হরেক রকমের পোশাক। কেউ পরেছে লুঙ্গি, কালো গেঞ্জি, কারো পরনে হাফপ্যান্ট। আমাদের সাথে আছে একটা দখল করা পাকিস্তান আর্মির এমজি ওয়ান এ ৩, চারটা এলএমজি, রাইফেল আর স্টেনগান। সন্ধ্যার সাথে সাথেই একটা প্যাট্রোল সেকশন পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যাদের দায়িত্ব ছিলো ব্রাহ্মণগাঁও—মজলিশপুর এলাকার প্যাট্রোলিং করার, যাতে ইমামবাড়ি—নিয়মতাবাদ থেকে কোন পাকিস্তানী প্যাট্রোল এসে আমাদের বিপত্তি ঘটাতে না পারে। রাত সাড়ে এগারটার দিকে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং আকাবপুর, চন্দ্রপুর, দুরাইত হয়ে প্রায় একটার দিকে মজলিশপুরের পশ্চিমে বিজনা নদীর ফেরি ক্রসিং পয়েন্টে পৌঁছলাম, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় গুদারা ঘাট। আমাদের লোক ও নৌকা ঠিক করা ছিল।
নির্বিঘ্নে নদী পার হলাম। যতই আমরা শত্রু অবস্থানের নিকটবর্তী হচ্ছিলাম ততই টেনশন ও সতর্কতা বাড়ছিল। চারদিকে সুসুপ্ত রাত, কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ। সিঙ্গল ফাইলে স্কাউট সামনে রেখে নিঃশব্দে পার হয়ে যাচ্ছি।
সিএন্ডবি মহাসড়কের পাশে যখন থামলাম তখন রাত প্রায় দুটো। এই মহাসড়ক থেকে পাকিস্তানীদের নিরাপদ সীমানা শুরু। সড়ক ব্যবহারে তাদের ভয় নেই, মুক্তিবাহিনী এখানে তাদের আক্রমণ করবে এটা তারা কখনো ভাবে না। আমাদের রাস্তা পার হতে হবে, সবাই লাইং পজিশন নিয়ে আছে। আমি একে একে সব সৈনিকের কাছে গেলাম, দু’একটা করে মৃদু কথা বার্তা বললাম, সাহস দিলাম, কারো কারো পিঠ চাপড়ে দিলাম। এনসিওদের তাদের করণীয় আবার স্মরণ করিয়ে দিলাম, তারপর প্ল্যাটুন কমান্ডারদের নির্দেশ দিলাম আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করতে এবং পূর্ব পরিকল্পনা মত মাটির উঁচু—নিচু আড়ালের যেখানে যেটা সম্ভব সাহায্য নিয়ে যতটুকু কাছে সম্ভব অবস্থান নিতে। আমার প্রথম গুলিই হবে আক্রমণের নির্দেশ।
মহাসড়কের পূর্ব পাশে শুধু একটা সেকশন রেখে গেলাম যারা বেশ উত্তরে গিয়ে অবস্থান নিল, যাতে কোনক্রমেই তাদের ছোঁড়া গুলি আমাদের মূল আক্রমণকারী দলটির উপর এসে না পড়ে। তারা উত্তরের ফ্ল্যাংক প্রটেকশনের দায়িত্বে থাকবে এবং সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে উইথড্র করবে সবার শেষে, নিজেদের বিবেচনায়। মূল আক্রমণকারী দলটি আক্রমণ করবে মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে। রাত তিনটার ভেতরে আমরা পজিশনে পৌঁছে গেলাম নিঃশব্দে ও নির্বিঘ্নে। আমাদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে, ছোট ছোট কিছু নালা আর খালের পাড় আর বড় আইল পেলাম এবং আমরা স্থানভেদে প্রায় শত্রুর ১৫০ থেকে ২৫০ গজের মধ্যে অবস্থান নিতে পারলাম। পাকিস্তানীরা বোধ হয় কোন রকম আক্রমণের চিন্তাও করেনি, কোন বিশেষ সতর্কতা চোখে পড়ল না। সেন্ট্রি পজিশনগুলো চিহ্নিত করতে চেষ্টা করলাম, দু’চারটা টুকরো টুকরো শব্দ ভেসে আসছে। কিছু নড়াচড়ার আভাসও পাচ্ছি। অন্ধকারে যতটুকু সম্ভব আঁচ করার পর তিন ভাগে ট্রুপসকে পজিশন করলাম। দুটো এলএমজি দুই পাশে আর মধ্যখানে এমজি ও একটি এলএমজি। একটি এলএমজি রেখে এসেছি রাস্তার পূর্ব পাশে। আমি মধ্যখানে মূল দলের সঙ্গে একটা খালের পাশে বাঁশ ঝাড়ের তলায় অবস্থায় নিলাম। তখন প্রায় পৌণে চারটা বাজে। অন্ধকার মনে হয় একটু ফিকে। নিকটতম সেট্রি পজিশনে নড়াচড়া, সামান্য আলো, সিগারেটের হতে পারে। আল্লাহর নাম স্মরণে নিয়ে নিশানা করে গুলি ছুঁড়লাম, মুহূর্তেই সব পজিশন থেকে গগণবিদারী শব্দে গর্জে উঠল এলএমজি, রাইফেল, স্টেন। পাকিস্তানী পজিশন থেকে ভেসে উঠল চিৎকার। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় আমরা আক্রমণ করতে পেরেছি। প্রথম কয়েক মিনিট কোন প্রত্যুত্তর পেলাম না। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানীরা গুলি করা শুরু করল। লক্ষ্যহীন এলোপাতাড়ি গুলি। আমরা পজিশন নিয়ে অনবরত গুলি করছি, শুনতে পারছি পাকিস্তানীদের চিৎকার। এভাবে ঘন্টাখানেক ধরে চলল প্রচন্ড গোলাগুলি। চারদিক ক্রমেই ফর্সা হয়ে উঠছে। পাকিস্তানীরা বেশ কয়েকটা এমজি চালু করেছে। তাদের নিশানাও এখন অনেকখানি সুবিন্যস্ত হয়ে আমাদের পজিশনের দিকে ছুটে আসছে।
আমার কাছেই এলএমজি ২ নম্বর সহকারীর উরুতে বুলেট লাগলো, সে কাতরে একপাশে পড়ে গেলো। একজনকে বললাম তাকে দেখতে। গোলা বিনিময় হচ্ছে। পাকিস্তানীরা ব্যারাক ছেড়ে বাংকারে, ট্রেঞ্চে ঢুকে গেছে। আমাদের গুলিও এখন তাদের লাগছে না। তাদের গুলির বেশির ভাগই আমাদের মাথার উপরে, গাছপালার বাঁশঝাড়ে লাগছে। হঠাৎ আমরা চমকিত হয়ে উঠলাম, আরেকটা বিকট আওয়াজ শুনে, প্রায় ভোর হয় হয় সময়। মাথার উপরে প্রচন্ড শব্দ করে উড়ে গেলো সেবর জেট, এক ঝাঁক গুলি বৃষ্টি। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের মিশন শেষ, যেটুকু করার সেটুকু আমরা করেছি। এখন উইথড্রয়াল। পেছনে নেমে আন্দিরপাড় আর খিদিরপুরের মাঝ দিয়ে সিএন্ডবি রোড ক্রস করে ক্যাম্পের পথে ফিরে যাবো। কিন্তু তা করতে গিয়ে দেখলাম অসুবিধায় পড়ে গেছি। আমাদের পেছনে কভার কম, খোলা মাঠ বেশি, এর মধ্যে বেশ আলো হয়ে গেছে। বিকট শব্দে প্লেন আবার ঘুরে আসছে, এই আলোয় খোলা মাঠে আমাদের দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই। এর মধ্যে খবর পেলাম আমার বাম দিকের পজিশনে আরেকজন আহত হয়েছে।
দু’জন মেসেঞ্জার দুই পজিশনে পাঠালাম নতুন নির্দেশ দিয়ে যে আগের প্ল্যান বাতিল। সিএন্ডবি ক্রস করব না, মিলিটারী কায়দায় এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করে খাল ও ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে আমরা পশ্চিম দিকে সরে যাবো। সেখান দিয়ে গেলে আমাদের উপর থেকে দেখতে পাবে না। দুটো এলএমজি ফায়ার করতে থাকল। আমরা দ্রুত ছোট ছোট গ্রুপ ক্রল করে পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকলাম। ১৫/২০ মিনিটের ভেতরেই আমরা স্থান ত্যাগ করলাম।
গ্রামের ঘর—বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে অনেক উৎসাহী ভীত সন্ত্রস্ত মুখ, পাকিস্তানীরা তখনও গোলাগুলি করছে আর আমাদের ছেড়ে দেয়া পজিশনের উপর গোলা বর্ষণ হচ্ছে প্লেন থেকে। আহতদের নিয়ে আমরা দ্রুত বাদৈর গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন দিনের আলো ফুটে উঠেছে। বাদৈর গ্রামের মাঝামাঝি গিয়ে এক গৃহস্থের বড়ো উঠানে থামলাম। প্রথমেই আহত দু’জনকে দেখলাম। একজনের আঘাত সামান্য, কোমরের উপরে লেগেছে, ফ্লেশ উন্ড। যার উরুতে লেগেছে তার বেশ রক্তক্ষরণ হয়েছে। পা ফুলে গেছে ও যন্ত্রণা হচ্ছে। তার হাতিয়ার ও এম্যুনিশন আরেকজনকে দেয়া হল। গ্রামবাসীরা আমাদের ঘিরে ভিড় করছে। বলার পরও সরে যাচ্ছে না, আমাদের সাথে কথা বলতে চায়, হাত মিলাতে চায়, ছুয়ে দেখতে চায়। যুদ্ধের নয় মাসে গ্রাম বাংলার মানুষের যে পরিচয় পেয়েছি তার তুলনা হয় না। বিশেষ করে আমার রণাঙ্গন কসবা এলাকার লোকদের ভূলব না। কি সাহস দেখেছি তাদের মধ্যে, পাকিস্তানীরা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ধরছে, মারছে, তাতেও তাদের ভয় নেই, মুক্তিযোদ্ধাদের তারা সাহায্য করছে সর্বোতভাবে।
আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি। বিভিন্ন বাড়ি থেকে আমাদের জন্য চলে আসতে থাকলো নাস্তা, চিড়া, মুড়ি, গুড়। দু’চারজন মুরুব্বির সঙ্গে আলাপ করলাম, রাজাকারদের আনা গোনা আছে শুনলাম। পাকিস্তানীরা সার্চ পার্টি পাঠাতে পারে ভেবে ঠিক করলাম আরো পশ্চিমের হাতুরাবাড়ির দিকে সরে যাবো, যেখানে চলাচলের রাস্তা খারাপ। পাকিস্তানীরা আসলেও নিচু বিলের মত জায়গা পার হয়ে গ্রামে পৌঁছতে হবে।
হাতুরাবাড়িতে গিয়ে উঠলাম এক বাড়িতে যার চতুর্পাশে খোলা জায়গা আছে। সেন্ট্রি মোতায়েন করলাম দু’জন, বাকিদের রেস্ট। যেহেতু আমরা ক্যাম্পে ফিরো যাবো ভেবেছিলাম আমাদের সঙ্গে কোন খাবারের বন্দোবস্ত নেই। কিন্তু তাতে কি, আমাদের দুপুরে খাওয়ানোর জন্য অতি উৎসাহে কয়েক বাড়ির লোক ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিশোররা ব্যস্ত হয়ে উঠল ডাব পেড়ে আমাদের খাওয়ানোর জন্য। গ্রামের এক ডাক্তার এসে আমার আহত সৈনিকদের ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। অনেক স্বেচ্ছাসেবক জুটে গেল আমাদের খেদমতে। কয়েকজনকে পাঠালাম গ্রামের প্রান্তে সেন্ট্রি ডিউটি করতে। আর দু’জন গেল সৈয়দাবাদ গ্রামের উদ্দেশে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। দুপুরে খেলাম, সারাদিন রেস্ট করলাম, কিন্তু মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ আক্রমণ সফল, কিন্তু প্ল্যান মাফিক ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারিনি। রসদ নেই এম্যুানিশন ফুরিয়ে গেছে। যে কোন মুহূর্তে যে কোন দিক থেকে বিপদ আসতে পারে। প্লেন ও হেলিকপ্টারের আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি, দূরে চক্রাকারে ঘুরছে।
যাহোক, আর কিছু ঘটল না। খবর পেলাম কুটির দিক থেকে বেশ ট্রুপস মুভমেন্ট হয়েছে সৈয়দাবাদের দিকে। একটি বাস ও দু’টি ট্রাক মৃতদেহ নিয়ে গেছে সৈয়দাবাদ থেকে কুমিল্লার দিকে।
সিদ্ধান্ত নিলাম, মহাসড়ক পার হব রাত গভীর হলে। সাধারণত বিশেষ প্রয়োজন না হলে রাতে মুভমেন্ট পাকিস্তানীরা এড়িয়ে যেত। সন্ধ্যা নামার পর হাতুরাবাড়ি থেকে বের হয়ে যাত্রা শুরু করলাম এবং শিকারপুরের মধ্য দিয়ে পূর্ব দিকে মহাসড়কের দিকে দেখে শুনে অগ্রসর হলাম। উদ্দেশ্য সৈয়দাবাদ ও কুটির মাঝামাঝি জায়গা খিদিরপুরের সোজাসুজি রাস্তা পার হব। মহাসড়ক থেকে আধা-মাইল দূরে দুই বাড়িতে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাত ন’টার দিকে মোটামুটি সব নিঝুম হয়ে আসল। গাড়ি চলাচলেরও কোন আওয়াজ নেই। ডানদিকে ও বাঁ দিকে দুটো ছোট গ্রুপ পাঠালাম মহাসড়কের পাশে গিয়ে অবস্থান নিতে ও চারদিকে লক্ষ্য রাখতে, আমি গেলাম ডানদিকের গ্রুপের সঙ্গে। আমার সৈনিকদের মনোবল দেখলাম দারুণ তুঙ্গে। এমনকি যারা আহত তাদেরও উৎসাহী মনোভাব। ঘন্টা দুয়েক এভাবে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকলাম। এরপর ৫/৬শ’ গজের ব্যবধানে দুটো এলএমজি লাগালাম আর নির্দেশ দিলাম এর মধ্যখান দিয়ে সবাই পেরিয়ে যাবে এবং রাস্তা পার হয়ে ৫০০ গজ পূর্বে একত্রিত হবো। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে নিরাপদেই সবাই পার হয়ে এলাম। চন্দ্রশ্বর, চাপিয়া, গুরাইত হয়ে নিরাপদেই ফিরে আসলাম। ক্যাম্পের পথে চন্দ্রপুরের কাছে দেখা হল আমার ক্যাম্পের এক প্যাট্রোল পার্টির সঙ্গে যারা উৎকন্ঠিত হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কি আনন্দের সেই মিলন। শুনলাম আমরা ফিরে না আসায় দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। হেড-কোয়ার্টার থেকে স্বয়ং সেক্টর কমান্ডার এসে সারা বিকেল বসেছিলেন এবং যাওয়ার সময় নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যেন আমি আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ারলেস ম্যাসেজ দেই এবং সেক্টর হেড-কোয়ার্টারে রিপোর্ট করি। ক্যাম্পে যখন ফিরি তখন রাত তিনটা হবে। সবাইকে সাবাশ দিয়ে এবং আহতদের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করে অপারেশন শেষ ঘোষণা করি।
শুনলাম ব্যতিক্রমী একটা দিন কেটেছে আমাদের রণাঙ্গনে, সারাদিন কোন শেলিং হয়নি। সৈয়দাবাদের গান ছিল নিশ্চল। পরদিন সকালে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত রিপোর্ট একত্র করলাম। আমাদের এই অতর্কিত আক্রমণে শত্রুর ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৮০/৯০ জন পাকিস্তানী সৈন্য মারা গেছে। দুটো গান অকেজো হয়ে গেছে। পাকিস্তানীদের এই বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে একটা অদ্ভূত যোগসূত্রের কারণে। আমরা যেদিন আক্রমণ করব সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রায় ২/৩ প্ল্যাটুন সৈন্য কুমিল্লায় যাওয়ার পথে সেইখানে রাতের জন্য যাত্রা বিরতি করে এবং তারা বেশির ভাগই ছিল অরক্ষিত অবস্থায়।
মনতলী ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর আইনুদ্দীন তার নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স সূত্রে পাওয়া এই ঘটনার একটা আলাদা রিপোর্ট সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাঠান। যেখানে উল্লেখ ছিল যে, আমাদের আক্রমণে মোট ৯৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায় এবং যার মধ্যে দু’জন ছিল অফিসার। তার রিপোর্ট অনুযায়ী দু’টি বাস ভর্তি করে পাকিস্তানীরা মৃতদেহগুলো কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়। এই ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন আর্টিলারী শেলিং থেকে আমরা নিশ্চিন্তে ছিলাম।
পরদিন সেক্টর হেডকোয়ার্টারে গেলাম দুপুর নাগাদ। আমার এই এ্যাকশনের রিওয়ার্ড আমি যুদ্ধের সময়েই পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার সেই স্নেহ মিশ্রিত তিরস্কার, কেন আমি এই রকম একটা বিপজ্জনক কাজ করেছি তার পারমিশন না নিয়ে। যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে এত দূরে পাকিস্তানী পজিশনে আক্রমণ এই প্রথম তার এলাকায়। সবার তখন চোখ ওঠা রোগ ধরেছে। আমাদের সেক্টরের ডাক্তারকে ডেকে বললেন, এই ছেলের চোখ লাল হয়েছে ওষুধ দাও। তার ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট খুলে আমার মত একজন জুনিয়র অফিসারকে সিগারেট অফার করলেন সেক্টর কমান্ডার স্বয়ং। প্রিয় পাঠক, প্রিয় দেশবাসী, আমার মত একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোন খেতাব নয়, সেটিই ছিল সবচেয়ে পরম পাওয়া।