You dont have javascript enabled! Please enable it! 1979.03.02 | সংসদ নির্বাচন ৭৯ কারচুপি বিচিত্রা অভিযুক্ত | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

1979.03.02 | সংসদ নির্বাচন ৭৯ কারচুপি বিচিত্রা অভিযুক্ত | সাপ্তাহিক বিচিত্রা

সংসদ নির্বাচন ৭৯ কারচুপি বিচিত্রা অভিযুক্ত
বিচিত্রার নীল-নকশা নির্বাচন-উত্তর যেসব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ঘটার আশঙ্কা করা গিয়েছিল, যে ঘোষণা আওয়ামী লীগ (মালেক) দিয়েছিল, তাই ঘটেছে। এবং মাঝখান থেকে অভিযুক্ত হয়েছে সাপ্তাহিক বিচিত্রা।
গত ১৮ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর পরই সারাদেশ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জয়ী ও পরাজিত রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ও ব্যাক্তিবর্গ ঢাকা শহরে এসে হাজির হয়েছেন। লক্ষ্য সাংবাদিক সম্মেলন। নির্বাচনে যিনি পরাজিত হয়েছেন, যিনি বিজয়ী হয়েছেন এবং যারা জামানত খুইয়েছেন, তাদের সবই সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন একই কথা । এবারের নির্বাচনে, তার বিরদ্ধে যে কারচুপি হয়েছে তার কোনো নজির ইতিহাসে নেই। অনেকেই এও বলেছেন যে, ৭৩এর কারচুপিও এর কাছে ম্লান হয়ে গেছে।
গত ২২শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় তিনটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে নির্বাচনে পরাজিত মালেক গ্রুপ আওয়ামী লীগ নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান বলেন যে, সরকারি বল প্রয়োগের মাধ্যমে ও ব্যাপক কারচুপি করে তার আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে জিতিয়ে দিয়েছেন। একই দিন আর এক সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে জয়ী শাহজাহান সিরাজ মালেক উকিল সাহেবের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে বলেছেন যে, নির্বাচনের পূর্বে সরকার যে নীল নকশা তৈরি করেছিলেন তাই বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিবাদসহ নির্বাচনের রায় মেনে নিয়েছি। ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচন ও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের মধ্যে তেমন কোন তফাত নেই। বরং বলা চলে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।” তিনি বলেন, সরকার ব্যাপক কারচুপি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অশ্রয় নিয়ে একটি রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট গঠনের মাধ্যমে দেশে এক নায়কতন্ত্রী ফ্যাসীবাদী শাসন কায়েম রাখার সর্বাতন্তক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি সকল আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা ঘোষণা করেন। ঐ দিন ডাক ও তার মন্ত্রী এবং বিএনপির টিকেটে নোয়াখালী থেকে আওয়ামী লীগ (মালেক) প্রধান জনাব অবদুল মালেক উকিলকে পরাজিত করে নির্বাচিত জনাব মওদুদ আহমেদ বলেন, বাকশালপন্থী আওয়ামী লীগই নির্বাচনের দিন গোলযোগ ও কারচুপির অপচেষ্টা করে। তিনি কতকগুলো স্থানের নামোল্লেখ করে বলেন যে, সেসব স্থানে বাকশালপন্থীরা অন্য কোনো দলের কর্মীদের ঢুকতে দেয়নি। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচনের পরও বিএনপি কর্মীদের ওপর হুমকি ও হামলা চলছে।
এরপর ২৪শে ফেব্রুয়ারী টাঙ্গাইল-৪ নির্বাচনী এলাকা থেকে জাসদের শাহজাহান সিরাজের বিরুদ্ধে পরাজিত প্রতিদ্বন্দী মালেক গ্রুপ আওয়ামী লীগের মিসেস লায়লা সিদ্দিকী অভিযোগ করে বলেন যে, তিনিই ঐ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু অস্ত্রের মুখে জনগণের রায় মার খেয়েছে। মিসেস সিদ্দিকী বলেন, “নির্বাচনী প্রচারণায় জাসদ সমর্থিত গণবাহিনী সন্ত্রাস সৃষ্টি হুমকি ও জোর জবরদস্তিকেই অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিল।”
এদিকে ২৪শে ফেব্রুয়ারী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের (উকিল) কাছে পরাজিত ইউপিপি প্রধান কাজী জাফর আহমদ, ন্যাপ (রহমান-জাহিদ) প্রধান নুরুর রহমান বলেছেন যে “কাদের পাস করানো হবে এবং ফেল করানো হবে তার একটি নীল নকশার আওতায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।” উভয়েই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। ২৫শে জানুয়ারী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক রাশেদ খান মেনন এক সাংবাদিক সম্মেলনে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন যে, “এবারের কারচুপি ৫৩-এর সংসদ নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী জনাব মেনন বলেন, একটি স্বাক্ষীগোপাল সংসদ গঠনের মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বাধীনতার পূর্বাপর শত্রু” শ্লােগানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ এবং আইডিএলর সঙ্গেও ঐক্য গড়ে তোলার তিনি পক্ষপাতী। এখানে তিনি অবশ্য তার সম্ভাব্য মিত্রদের ভেতর জাসদের নাম উল্লেখ করেননি।
একই সময়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন রংপুর থেকে বিজয়ী মুসলিম লীগ-আইডিএল প্রার্থী কাজী কাদের। তিনি বলেছেন যে, নির্বাচনে সরকারী দল ব্যাপক কারচুপি করেছে। এবং এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ, সদস্যরা সংসদে শপথ নাও নিতে পারেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারী ৭৫ পর্যন্ত গোপন বর্তমানে প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (মাঃলেঃ) নেতা জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনে দুর্নীতি ও কারচুপি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তিনিও বিএনপি প্রার্থীদের পাস করানোর একটি নীল নকশা ছিল বলে উল্লেখ করেন।
নির্বাচন পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলন সিরিজে এই কারচুপি আর নীল নকশার অভিযোগ উত্থাপন করেন পরাজিত আওয়ামী লীগ জনাব আবদুল মালেক উকিল। ২০শে ফেব্রুয়ারীর সাংবাদিক সম্মেলনে কারচুপির অভিযোগে সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে জড়িয়ে তিনি বলেন যে, “এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কয়টি আসন পাবে সরকার তা নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার মাধ্যমে আগেই জনগণকে জানিয়ে দিয়েছেন। যেমনভাবে গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল উক্ত পত্রিকাটি জানিয়ে দিয়েছিল।”
নির্বাচন পরবর্তী কারচুপি আর দুর্নীতির অভিযোগ আমাদের দেশে অভিনব কিছু নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও ব্যাপক কারচুপির এই অভিযোগ এসেছিল। কিন্তু এবারের অভিযোগে খানিকটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এবারে সংসদে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্য বিরোধী দলের। ফলে যে প্রার্থী যার কাছে হেরেছেন, নির্বাচনোত্তর সাংবাদিক সম্মেলন-বিবৃতি সিরিজে পরাজিত প্রার্থীরা জয়ী প্রার্থীদের বিরদ্ধে কারচুপির অভিযোগ করেছেন। এই সিরিজে আওয়ামী লীগ করেছে জাসদের বিরুদ্ধে, বিএনপির বিরুদ্ধে, মুসলিম লীগ করেছে বিএনপির বিরুদ্ধে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা করেছেন নানাজনের বিরুদ্ধে। তবে মোহাম্মদ তোয়াহা থেকে শুরু করে আইডিএল পর্যন্ত সবার অভিযোগের মূল বিষয় এক। সবাই কথা বলছেন নির্বাচনে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল মালেক গ্রুপ আওয়ামী লীগ সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে। আইডিএল-জামাত-মুসলিম লীগ থেকে মেনন পর্যন্ত সবাই ঐক্যের কথাও বলছেন একই ভাষায়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় যারা আওয়ামী লীগেরই বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সবচেয়ে বেশি। এই প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবেই হয়তো ন্যাপ (রহমান-জাহিদ) প্রার্থী প্রচণ্ড বাকশাল বিরোধী এনায়েতউল্লাহ খান বৈঠকে বসেন বাকশালপন্থী মালেক আওয়ামী লীগের সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। এই আওয়ামী-বাকশালীদের প্রতি নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করার জন্যই তিনি পদত্যাগ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার মন্ত্রিসভা থেকে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নেতা খান এ সবুর ২৬শে ফেব্রুয়ারী এক সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন :
“বঙ্গবন্ধু একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। ভবিষ্যতে দেশ তার নিকট হতে অনেক কিছু অর্জন করতে পারত। আমরা তার হত্যার বিচার চাই। সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্যান্য হত্যারও বিচার চাই।” তিনি বলেন, একাত্তরে আমরা এমন কোনো কাজ করিনি যে, তার জন্য অনুতপ্ত হব।” জনাব সবুর দালাল আইনে গ্রেফতার হন। পরে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান।
সাংবাদিক সম্মেলন আর বিবৃতি সিরিজে রয়েছেন নির্বাচন বর্জনকারী রাজনৈতিক দলসমূহও। বাংলাদেশ পিপলস লীগ রাজী গ্রুপের সভাপতি প্রাক্তন ভাসানী ন্যাই নেতা এবং গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বাকশালী জোটের অন্যতম অঙ্গনেতা ডঃ অলীম আল-রাজী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি কিংবা কারচুপি হয়েছে বলে যেসব বিরোধী দল এখনও অভিযোগ করছেন তাদের প্রতি সমবেদনা জানান। তিনি বিরোধী দলগুলোর প্রতি বলেন সে, আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে—এটা জেনেও কোনো ব্যক্তি আগুনে হাত দিয়ে হাত পড়লে তার জন্য সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কি করতে পারি?” এই প্রেক্ষিতে জনাব রাজী পার্লামেন্টকে প্রতিনিধিত্বশীল নয় বলে দাবি করেন। বর্জনবাদী অন্যতম দল জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়নও বলেছে যে, এই সংসদ প্রতিনিধিত্বশীল নয়। দলের সম্পাদক গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৃতীয় স্রোতের নেতা জনাব সিরাজুল হােসেন খান বলেন যে, “গত পার্লামেন্ট নির্বাচনে রাজনীতির নামে সর্বোচ্চ দুর্নীতি, প্রহসন ও অসাধুতার প্রতিফলন ঘটেছে।
এবারে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিরদ্ধে অভিযোগের প্রশ্ন। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও বিচিত্রা সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছিল। সে পূর্বাভাস সফল হয়েছিল। এবারের সংসদ নির্বাচনেও জরিপ চালিয়ে বিচিত্রা আরও বেশি সফল হয়। বিচিত্রা মনে করে যে, এর দশ লক্ষাধিক পাঠক দেশের সংবাদপত্র পাঠকদের সবচেয়ে সচেতন অংশ। বিচিত্রা বর্তমান সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অনুসন্ধানের সঙ্গে এর পাঠক ও বিচিত্রা ফোরাম ক্লাবের ৬ হাজার সদস্যের মধ্যে ৩ হাজার সদস্যের সাহায্য দেশব্যাপী একটি জরিপ চালায় এবং একশটি আসনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য ফলাফল প্রণয়ন করে। বিশ্বের সফল দেশের সাংবাদিকদেরই এই স্বাধীনতা রয়েছে। গণতান্ত্রিক যেকোনো দেশের নির্বাচনের প্রাক্কালে সংবাদপত্র মতামত জরিপ করে থাকে এবং তা যথারীতি প্রকাশিত হয়। সুষ্ঠুভাবে জরিপ কাজ চালাতে পারলে তার ফলাফলও সঠিক হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালপ পল হ্যারিস পল প্রভৃতি সংস্থা এই কাজে সব সময় নিয়োজিত রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে বিচিত্রা জরিপের ফলাফল শতকরা প্রায় একশ ভাগ সঠিক হয়। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দক্ষ কর্মী থাকলে এ ধরনের সঠিক জরিপ সম্ভব।
নির্বাচন পূর্বে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলেরও অনুমান ছিল যে, বিএনপির শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ প্রার্থী জয়লাভ করবে। পর্যবেক্ষক মহলের এই ধারণার সহজ হিসেব হচ্ছে : বিএনপি জয়লাভ করবে, কিন্তু সেই সঙ্গে পাস করে আসবে বিরোধী দলের বেশ কিছু প্রার্থী ব্যক্তিগত পরিচিতিতে।
বিচিত্রার জরিপ দাঁড়িয়ে আছে অঙ্কের উপর, বাস্তব ভিত্তির উপর। তথ্যের বিন্যাসকে সত্যকে নিজের মত না হলে অস্বীকর করা রাজনীতি নয়—বলা যায় উটপাখির মত বালুচরে মুখ লুকানো।
হুমকিঃ বৈঠকখানায়
সংসদ নির্বাচনে কারচুপি সম্পর্কে পূর্বান্হেই আভাস দান, আন্দোলনের হুমকি, প্রতিবাদসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র, ইত্যাদি কথামালার পরও নির্বাচন যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর জনসাধারণের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না হলেও নির্বাচনের পর বিরোধীদল সরকারী দলের প্রতি, বিরোধী দল বিরোধী দলের প্রতি এবং সরকারী দল বিরোধী দলের প্রতি যথারীতি নির্বাচনে কারচুপি, দুর্নীতি, ভীতি প্রদর্শন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। অবশ্য পূর্বে নির্ধারিত কর্মসূচী অনুসারে ১৯শে ফেব্রুয়ারী থেকে প্রধান বিরোধী দল মালেক গ্রুপ আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরু করতে পারেননি। কারণ জনগণের ভেতরে নির্বাচন সংক্রান্ত এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ সম্পর্কে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া এখনো দেখা যাচ্ছে না। এত কিছু সত্ত্বেও বাস্তবে যা ঘটেছে তা হল প্রেসিডেন্ট জিয়ার জাতীয়তাবাদী দল সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে মোট ২০৫টি মালেক গ্রুপ আওয়ামী লীগ ৪০টি, আইডিএল মুসলিম লীগ জোট ১৯টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৯টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোট ১৭টি আসনে জয়লাভ করেছেন।
নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৮৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬৪। তার মধ্যে ভোট দিয়েছে এক কোটি একানব্বই লাখ ছয় হাজার একশ পচিশ জন। অর্থাৎ মোট ভোটারের শতকরা ৪৯.৭৩ জন এই ভোটে অংশ নিয়েছেন। ৭৮ সালের ৩রা জনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট প্রদান করা হয়েছিল শতকরা ৫৩•৫৯ ভাগ। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি এমন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, বিএনপি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। কারণ তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা ২৫ ভাগের মতো ভোট পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচনের পরে বঙ্গভবনে বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৪৯ ভাগ ভোট তার দল পেয়েছে। আর আটাশটি বিরোধী দল ও ৪২৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে পেয়েছেন মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৫১ ভাগ ভোট।
সাম্প্রতিক সংসদ নির্বাচনে একদিকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ব্যক্তিত্ব যেমন কাজ করেছে, তেমনি কাজ করেছে অঞ্চল ভিত্তিক জনগণের পছন্দ অপছন্দ। জনগণ তাদের রায় দিয়েছেন নিজেদের পছন্দ মতোই। তাই খুলনার তিনটি নির্বাচনী এলাকা থেকেই জয়লাভ করেছেন মুসলিম লীগের খান এ সবুর খান, জয়লাভ করেছেন রংপুরের নির্বাচনী এলাকা থেকে কাজী কাদের, পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে যার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
তবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমা দখল এবং আমাদের দেশের জনবিচ্ছিন্ন পরিশ্রমজীবী রাজনীতিকদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের সঙ্গে দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কোনো সংযোগ নেই। তাই ক্ষমতা দখলের স্বার্থেই এইসব রাজনৈতিক দল বা নেতারা আজ যে কথা বলেন, কাল তা সম্পূর্ণরুপে ভলে গিয়ে বলেন নতুন কথা। তাই দেখি, এক তরুণ রাজনীতিক ৭৮ সালে স্বাধীনতার পূর্বাপর শত্রুদের বিরোধিতা করার লক্ষ্যে দল ভেঙ্গে নতুন দল করে আবার সেই স্বাধীনতার পূর্বাপর শত্রুদের সঙ্গে আঁতাত করার বাসনা প্রকাশ করেছেন সংসদে নির্বাচিত হয়েই। এদের এই ধরনের স্ববিরোধী আচরণের ফলেই সাধারণ মানুষ রাজনীতির প্রতি ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন।
সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভানেত্রী মিসেস জোহরা তাজউদ্দীন ঘোষণা করেছিলেন যে, নির্বাচনে কোনো প্রকার অসদুপায় অবলম্বন করা হলে, পাকিস্তানের পিএনএ স্টাইলের অন্দোলন শুরু করবেন তারা। আর নির্বাচনের পর মুসলিম লীগের নেতা কাজী কাদের ঘোষণা করেছেন নির্বাচনে তথাকথিত বিপুল বিজয়ের বিরুদ্ধে পিএনএ স্টাইলের আন্দোলন হতে পারে। জনাব কাদের আওয়ামী লীগের সভাপতিকে জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। নির্বাচন পর্ববতী তৎপরতা এবং নির্বাচন পরবর্তী ড্রইংরুম আস্ফালনের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে কারচুপির অভিযোগ করেছেন ঠিকই, আস্ফালনও করছেন, কিন্তু আন্দোলনে যেতে পারছেন না।
দেশের সাধারণ মানুষ চান শান্তি, চান স্থিতিশীলতা, তারা ভোট দিয়েছেন এরই পক্ষে। ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে তাই তাদের অংশগ্রহণের প্রশ্ন ওঠে না। ফলে হুমকি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চার দেয়ালের মাঝে জনহীন জনসভায়, প্রতিদ্বন্দিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
নতুন খেলা
নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিশ্রুতি, হুমকি আমাদের দেশে নতুন নয়-বড় কোন ঘটনাও নয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দলেরই উল্লেখ্য কোন ইস্যু ছিল না। কিন্তু এই একটি সাধারণ ইস্যু সব রাজনৈতিক দলেরই ছিল। সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই অর্পিত ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের ওপর। এদেশের মানুষের ভাগ্য বারবার তাদের সঙ্গে নির্বাচনী ওয়াদার খেলাপ হয়েছে। রাজনৈতিক দল ভুলেছে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা। কায়েম স্বার্থের বেদীমূলে আহুতি দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক দলের দায়িত্বকে।
বস্তুর স্বান্দিকতাকে স্বীকার করলে সহজেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায়। এবং নির্বাচনে বিজয়ী এবং বিজিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একে অন্যের অপরিহার্যতা মেনে নিতে পারেন। বিজয়ী এবং বিজিত অন্য কথায় ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদলের এই একে অন্যকে মেনে নেয়াই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মূল চাবিকাঠি।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বিরোধী এবং সরকারী দলের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এই মত বিরোধ থেকে বিভাজনের রাজনীতির পুনর্বাসন হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্যই আশংকা রয়েছে জনগণের প্রত্যাশা আর একবার ব্যর্থ হওয়ার। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি গোড়া থেকেই সতর্ক দৃষ্টি থাকলে শতাব্দীকাল বঞ্চিত এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব। কারণ এদেশের মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে জানে। জীবিকার প্রয়োজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এদেশের মানুষ ভাগ্য গড়তে জানে। এদেশের মানুষের রয়েছে দুটো পরিশ্রমী হাত।
স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবেন-এ প্রতিশ্রুতি দেয়াতেই পরম নির্ভয়ে এদেশের জনগণ প্রেসিডেন্ট জিয়াকে বিজয়ী করেছিলেন ৩রা জুনের নির্বাচনে। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই জাতীয় সংসদ সদস্যদের কাছেও জনগণের প্রত্যাশা অনেক।
এবার সকল দলেরই ছিল একটি ইস্যু। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটাতে হবে। সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটানো সহজ কাজ নয়। ব্যর্থতার আশংকাকে কেউই উড়িয়ে দিতে পারেন না। কারণ একটি মাত্র নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ নাও ঘটতে পারে। এদেশের মানুষ এর আগেও একাধিকবার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক কারনে সে অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি পর পর। একবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরই জারী হয়েছে সামরিক আইন। পর পর অন্ততঃ কয়েকবার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি বলে ভোটারদের পরিপক্কতাও গড়ে ওঠেনি।
১৬ই ফেব্রুয়ারী বিচিত্রা রাজনৈতিক কলামে লিখেছিল। এবার জনগণ এমন একটি পার্লামেন্ট তৈরি করবেন যাতে বিরোধীদল শক্তিশালী থাকে। বিগত দিনের এক দলের প্রাধান্য জনিত অভিজ্ঞতা অন্ততঃ তাদের কাছে সুখকর নয়। শক্তিশালী বিরোধীদলের অবস্থান কামনা করে বিচিত্রা ইতিপূর্বে আরও প্রতিবেদন পরিবেশন করেছে। বিরোধীদল বিরোধিতার-স্বার্থেবিরোধিতার আবর্তে ঘুরপাক খাবেনা শুধি এ প্রত্যাশা জনগণের। অবশ্য জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন যারা তারা এ ফলাফলকে অন্য দৃষ্টিতেই দেখবেন।
তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশে যেখানে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি-সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য নির্বাচনের কিছু অর্থ থাকলেও থাকতে পরে। সংসদ নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ সেখানে একটি উৎসবে অংশগ্রহণের চেয়ে খুব বেশি বড়াে নয়। তাই এখানে জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনা।
আমাদের বিরোধী দলগুলো একবার নির্বাচন বর্জন একবার গ্রহণ ইত্যাদি খেলা খেলতে খেলতে অবশেষে নির্বাচিত হয়ে এসে এবার মাঠে ছুড়ে দিয়েছেন কারচুপির বল। এ বল জনগণকে কত সময় ব্যস্ত রাখবে কতবার পা বদল হবে। অবশেষে কার কাছে থাকবে আমরা জানি না। আসলে যদি এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু করতে হয়, তবে বিরোধী দলগুলোর উচিত সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী গ্রহণ করে। প্রায় সব বিরোধী দল এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কথা বলছেন, বিরোধী দলীয় ঐক্যের কথা বলছেন। যদি আন্দোলন করতে হয় তারও যেন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী নেয়া দরকার, যদি সংসদে বসতে হয় এবং শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হতে হয়, তার ও চাই সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী। কেননা জনগণ এজন্যই তাদের নির্বাচিত করেছেন। এই সুনিদিষ্ট কর্মসূচী নির্বাচনের আগে বা পরে কেউই এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেন নি। তাও এক এক সময় মানুষের সামনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এক একটি বল, নির্বাচন বর্জন, ভেতর বাইরে সংগ্রাম, দুর্নীতি, কারচুপি নীল-নকশা ইত্যাদি। সেই প্রেক্ষিতেই উঠছে অভিযোগ।
….এবং বিচিএা অভিযুক্ত
বিচিত্রা অভিযুক্ত। কারণ বিচিত্রা একটি সঠিক সংবাদ পরিবেশন করেছিল। বিচিত্রা অভিযুক্তঃ কারণ বিচিত্রার কর্মীদের কর্মনিষ্ঠার ফলে সম্ভব হয়েছিল সঠিক সংবাদ পরিবেশন করা। আমরা খবর অনেক পাই। এসব খবরের কোনো কোনোটি কোন রাজনৈতিক দলের ভেতরকার, কোনোটি আবার কোনো সংস্থা, সংগঠন বা ব্যাক্তির। কিন্তু সব খবর আমরা পরিবেশন করি না। বাইরে নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়ে কোন রাজনৈতিক দল আবার গোপনে রাতের অন্ধকারে বিশেষ ভবনের ভিতরে গিয়ে দরকষাকষি করেন, আপোস করেন, সে খবরও আমাদের কাছে আসে, সে খবর আমাদের রাখতে হয়। কিন্তু সব কথা আমরা প্রকাশ করি না। চতুর্থ রাষ্ট্র সংবাদপত্রের প্রতি, সাংবাদিকতা পেশার প্রতি যে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের থাকা দরকার, সেটি আজও অনুপস্থিত, সেই মনোভাব আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। তাই সঠিক সংবাদ পরিবেশন করার দায়ে অভিযুক্ত হয় সংবাদপত্র। অভিযোগ উঠেছে বিচিত্রার বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ বিচিত্র নয়। তবু আমরা সকলের প্রতি গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই।