৬ দফার আন্দোলন
জহিরুদ্দিনের ইচ্ছা আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যােগাদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে ৮দফার বিপরীত কোনাে দাবি করা যাবে না। অর্থ হলাে, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। ৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম কমিটিতে যােগদান করতে পারবে না। কাউন্সিল সভা হউক দেখা যাবে। যদি পার্টি যেতে চায় আমার আপত্তি কি? কতদিন থাকব ঠিক তাে নাই। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শােষক ও শাসকগােষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের নেতারা বুঝতে চায় না। নবাবজাদা নসরুল্লাহ সাহেব বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যােগদান না করলে তার সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যখন তিনি সভাপতি হয়েছেন পিডিএম-এর তখন তাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যােগদান করে নাই। দেখলাম, জহির সাহেব ও সালাম সাহেব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। মশিয়ুর ভাই আমাকে গােপনে বললেন, “লাহাের যেয়ে আমার কিছুটা ধারণা হয়েছে এর মধ্যে কিছু ষড়যন্ত্র আছে। আমাকে আরও বললেন, আমি যদি যােগদান না করি তবে তিনিও পিডিএম থেকে পদত্যাগ করবেন।
আমেনাকে বললাম, “৭ই জুন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করিও। হরতাল করার। দরকার নাই। সভা শােভাযাত্রা পথসভা করবা।” সকলেই তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা ও অসুবিধার কথা বলল।
আড়াইটার সময় ফিরে এলাম। গােসল করে খাবার খেয়ে কাগজ নিয়ে বসলাম। পাঁচটায় আবার গেটে যেতে হলাে। রেণু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। হাচিনা পরীক্ষা ভালই দিতেছে। রেণুর শরীর ভাল না। পায়ে বেদনা, হাটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শােনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ৬ দফা মানতে হবে—সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবেচলবে—পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শােনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, “ও শিখলাে কোথা থেকে?” রেণু বলল, “বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে।” বললাম, “আব্বা, আর তােমাদের দরকার নাই এ পথের। তােমার আব্বাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক।” জামাল খুলনা থেকে ফিরে এসেছে। রেহানা খুলনায় যাবার জন্য অনুমতি চায়। বললাম, “স্কুল বন্ধ হলে। যাইও।’ কামালও বাড়ি যেতে চায় আব্বাকে দেখতে। বললাম, “যেও। কোথা। থেকে যে সময় কেটে যায় কি বলব? জেলে সময় কাটতে চায় না, কেবল দেখা করার সময় এক ঘন্টা দেখতে দেখতে কেটে যায়। ছেলেমেয়েরা বিদায় নিয়ে চলে গেল, আমিও আমার চির পরিচিত দেওয়ানী ওয়ার্ডের দিকে চললাম। ওবায়েদ কোর্টে গিয়াছিল দেখা হয়ে গেল পথে। বললাম, “খবর কি? ওবায়েদ বলল, ‘আপনার যাহা মত আমাদেরও সেই মত।
২৮ তারিখের কাগজে দেখলাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর ও ফতুল্লা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে—যাতে ৭ই জুন ৬ দফা দাবি দিবস’ পালন করতে না পারে। বুঝতে আর কষ্ট হলাে না।
সংবাদ ও ইত্তেফাক বন্ধ করার ব্যাপার নিয়েও আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটাকে দমাতে হবে। এটাই হলাে সরকারের উদ্দেশ্য।
আর একটা আশ্চর্য জিনিস আজ কাগজে দেখলাম, কলেজগুলির অনুমােদন নিতে হবে সরকারের থেকে। ইংরেজকেও হার মানাইয়া দিয়েছে এই সরকার। কলেজের অনুমােদন দিত বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজ আমল থেকে এ পর্যন্ত চলছিল এই নীতি। হঠাৎ সরকারের হাতে এই ক্ষমতা নেওয়ার অর্থ বুঝতে কারই বা কষ্ট হয়! ভুল করছেন, বুঝতে পারছেন না! বাধন শক্ত হলে ছিড়েও তাড়াতাড়ি।
কারাগারের রােজনামচা, ২৭ মে/ ২৮ মে ১৯৬৭