৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব
আজ জেল গেটে ১৯৬৫ সালের ২০ শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় যে বক্তৃতা করেছিলাম সেই বক্তৃতার মামলার সওয়াল জবাব শেষ হয়। জনাব আবদুস সালাম খান সাহেব ও জহিরউদ্দিন সাহেব আমার পক্ষে সওয়াল জবাব করেন। সরকারি উকিল জনাব মেজবাহউদ্দিন সরকারের পক্ষে করেন। প্রায় চার ঘণ্টা চলে। ৬ দফা দাবি কেন সরকারের মেনে নেওয়া উচিত তার উপরই বক্তৃতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দরকার। দেশরক্ষা শক্তিশালী করা প্রয়ােজন। গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্ত নের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনাে যােগাযােগ ছিল না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। আরও অনেক কিছু।
আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমার বুকে ব্যাথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবে না! আমার সম্পদ ছলে-বলে-কৌশলে নিয়ে যাবে বাধা দেওয়া তাে দূরের কথা-বলাও যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিণ্ডি এখন ইসলামবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।
আমার ব্যক্তিগত মত ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬-দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। পরে জানাইয়া দেই। এও বলেছি এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দস্তখত করেছে তারা যেন সসম্মানে ফিরে আসেত পারে। তবে যদি পিডিএম কোনাে আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযােগিতা করতে রাজি আছিসহযােগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবেই করা হয়েছে। দেখলাম কাগজে আমার কথা মতই প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে :
“The meeting of the E.P.A., League Working Committee discussed the 8-point programme of the PDM and resolved that the matter be referred to East Pakistan Awami League Council for final decision.
It is further resolved that pending decisions by the council the East Pakistan Awami League will extend it responsive cooperation to any movement of the PDM for the restoration of democratic rights of the peoples of Pakistan.
The Meeting of the East Pakistan Awami League Working Committee reiterates its faith in the Six-Points programme and will continue the movement for its realization.’
ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুব রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আবদুর রশিদ ও নূরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম এ যােগদান করার জন্য লাহাের রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। তারাও সভায় যােগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায়। ৬ দফার আর প্রয়ােজন নাই তাদের কাছে।
আপােষ হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরােধ আছে। তাজুদ্দিন, মােমিন সাহেব, ওবায়দুর, শাহ মােয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬দফা ছাড়া পিডিএমএ যােগদান করতে রাজি নয়। খােন্দকার মােশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান একথা ও কথা বলে, তবে সেও পিডিএম-এর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে। তাজুদ্দিন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে।
সরকার নিশ্চয়ই জানে ‘যার কিছুই নাই তার আবার কিছু নষ্ট হবার ভয় কি? একটা ‘দোষ’ বােধ হয় আমার আছে সেটা হলাে জনগণ আমাকে ভালবাসে এবং যে ৬দফা দাবি করেছি তাহা সমর্থন করে, তাই বােধ হয় এই অত্যাচার। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে যে কোনাে ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোনাে প্রােগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য দাবি বলে জনগণ মেনে নিয়েছে। অত্যাচার করে তাহা দমানাে যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়।
নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নূরে আলম, নূরুল ইসলাম—আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিক নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬দফা ছাড়া আপােষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএম-এর পক্ষে, কর্মীরা কেউই রাজি না। মানিক ভাইও পিডিএম এর পক্ষে। ৮দফা পিডিএম দিয়েছে। আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবর রহমান ও নূরুল ইসলাম সাহেব তাে বিবৃতিই দিয়েছে। আট-দফা আওয়ামী লীগের মানসপুত্র’ বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬দফা দাবির চেয়েও ভাল। আমি এটা স্বীকার করতে পারি নাই—তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে। পূর্ব বাংলার লােকদের ধোকা দিতে চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মহম্মদ আলী। ৮দফা পূর্ববাংলাকে ৬দফা দাবি থেকে মােড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমিও চাই, তবে এই সকল বড় বড় নেতারা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না তা আমার জানা আছে।
মওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণও করেছে। ১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হােসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি। পিডিএম এ যােগদান করতে পারেন না এবং যারা দস্তখত করেছে সেটা অনুমােদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৬ দফা ছাড়া কোনাে আপােষ হবে না। অন্য কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন।
পিন্ডি থেকে জনাব কামরুজ্জামান এমএনএ, জনাব ইউসুফ আলী এমএনএ, জনাব নূরুল ইসলাম এমএনএ আওয়ামী লীগের এই তিন সদস্য পিডিএম
সম্মেলনে যােগদান করেছেন। ৬দফা ছাড়া পিডিএম-এ যােগদান করতে এদের নিষেধ করা হয়েছে।
ন্যাপও পিডিএম-এ যােগদান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিলে আন্দোলন কে করবে? সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ কর্মী ছাড়া অন্য দলের একটি কর্মীও জেলে নাই। ত্যাগ করলে এই দুই দলের নেতা ও কর্মীরা করছে। ঘরে বসে বিবৃতি দিয়ে এই দলের কর্মীরা রাজনীতি করে না। কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে এই পিডিএম করার পিছনে বিরাট যড়যন্ত্র আছে।
লাহােরের সভায় পিডিএম কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাতে নবাবজাদা নসরুল্লাহকে সভাপতি আর মাহমুদ আলীকে সম্পাদক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিকে প্রেসিডেন্ট করার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এটা পূর্ব পাক। আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধোকা দেওয়ার ষড়যন্ত্র। কিছুতেই পারবে না—এ বিশ্বাস আমার কাছে।
কারাগারের রােজনামচা, ২৩ মে ১৯৬৭