You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.03.26 | স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ণ বিবরণ | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

আমার জনপ্রিয় বীর বাঙালি ভাই ও বোনেরা আজ আমরা স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উদযাপন করছি। আজকের এই মহান দিনে বেদনা ভরা হৃদয়ে আমি আমার দুঃখ ভরাক্রান্ত দেশবাসীর সাথে একযোগে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাধীনতার জন্য আত্মদান করেছেন, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। একই সাথে আমি মুক্তিবাহিনী সকল অজ্ঞ দল, বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক জওয়ান, নির্বিক যুবসমাজ, ছাত্র, কৃষক, মজদূর, বুদ্ধিজীবী যথা আমার সমগ্র সংগ্রামী জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের গৌরবময় ও ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাদের এ ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের শুধু নয় সারা বিশ্বের উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী জঙ্গী মানুষের জন্য স্থায়ী প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আমার প্রিয় দেশবাসী- গত ২৫ বছর ধরে আপনারা নির্দয়, শোষণ, ক্ষুধা, বঞ্চনা, নিরক্ষরতা, স্বৈরাচার, দারিদ্র্য, নিরপেক্ষ ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করেছেন, সাম্রাজ্যবাদী শোষকরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি নিকৃষ্টতম উপনিবেশে পরিণত করেছিল। আমরা সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করতাম। শোষণের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করতাম। আমরা যখন দারিদ্য ও ক্ষুধায় নিমজ্জিত, তখন তদনীন্তন পাকিস্তানি শাসক চক্র আমাদের কষ্টার্জিত ও হাজার কোটি টাকা এখান থেকে লুট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলেছে। আমরা যখন ন্যায় বিচারের জন্য আবেদন জানিয়েছি, তখন আমাদের ভাগ্যে জুটেছে নিষ্পেষণ আর মৃত্যু। সম-সাময়িক কালে নিষ্ঠুরতম স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে, আর তিন কোটি মানুষ সর্বশান্ত। এই সবকিছু ঘটেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য। আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই যুদ্ধবিধ্বস্ত দুসর পান্ডুর জমি, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্থ পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তান হারা মায়ের আর্তনাদ নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের স্বাধীনতা যদি এদেরকে আশা- নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুষ্টি অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তাহলে সে স্বাধীনতা মিথ্যা, সে আত্মত্যাগ বৃথা। আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উৎসবের লগে দাঁড়িয়েছে। আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি, বিধ্বস্ত মুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। গুটি কয়েক সুবিধাবাদী নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফসল ভোগ করবে। আমি ভবিষ্যত বংশধরদের সুখী ও উন্নততর জীবন প্রতিবেশের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যোগাযোগ বন্দবস্ত, দারিদ্য, খাদ্যভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আকর্ষিত ভূমি-এ সবকিছু আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। জনগণের গভীর ভালোবাসা, আস্থা, অদম্য সাহস ও অতুলনীয় ঐক্য- এগুলিকে সম্বল করেই আমার সরকার এই মহা সংকট কাটিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। আমি আশা করব অতীতে আপনারা যেভাবে দুর্জয় সাহসে বুক বেঁধে ইয়াহিয়ার সামরিক তন্ত্রকে পরাভূত করেছিলেন, গভীর প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে তেমনি বর্তমান সংকট মোকাবেলা করবেন। আমরা পুরাতন আমলের জীর্ণ ধ্বংস্তুপের মধ্য থেকে নতুন সমাজ গড়ে তুলবো।
প্রসাশন ব্যবস্থা: ভাই ও বোনেরা আপনারা জানেন, হানাদার পাকিস্তানিবাহিনী আমাদের বাংলা রাইফেল ও পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্যকে হত্যা করেছে। আইনের শাসন কায়েম ও শান্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠনের অভাব বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নতুন নিযুক্তির মাধ্যমে আমরা পুলিশ বিভাগকে সংগঠিত করছি এবং ইতোমধ্যে যেসকল সমাজবিরোধী দুষ্কৃতকারী স্বাধীনতা উত্তর সুযোগ- সুবিধাদি অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের দমন করে জনসাধারণের মনে নিরাপত্তা বোধ ফ্ৰিাইয়া আনার কাজে হাত দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন জাতির জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী একটি প্রাদেশিক প্রশাসনিক কাঠামো। এর কিছু কিছু আমলা ঔপনিবেশিক মানসিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। তারা এখনোও বনেদি আমলাতান্ত্রিক মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। আমরা তাদেরকে স্বাধীন জাতীয় সরকারের অর্থ অনুধাবনের জন্য উপদেশ দিচ্ছি এবং আশা করছি তাদের পশ্চাত্ৰুক্তি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘঠবে। আমার সরকার নবরাষ্ট্র এবং নতুন সমাজের উপযোগী করে সমগ্র প্রশাসন যন্ত্রকে পুনর্গঠিত করবে। প্রস্তাবিত প্রশাসনিক কাঠামোতে জনগণ ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টিপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশকে সমস্ত মহকুমাগুলিকে জেলা পর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা তৈরি করছি।
শাসনতন্ত্রঃ বিশেষজ্ঞরা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং খসড়া শাসনতন্ত্র গণ-পরিষদের পূর্বে প্রস্তুত হয়ে যাবে। এই শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হবে- জাতীয়তা, গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ৫৪টি বন্ধু রাষ্ট্র এ পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিপুল সংখ্যক বন্ধুরাষ্ট্রের এই স্বীকৃতি দান রাষ্ট্র অন্যান্য সদস্যদেরকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করবে।
মিত্রদের সাহায্য চাই: উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য আমরা বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে উদার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। বিশেষ করে ভারত আমাদের সুদীন ও দুর্দিনের প্রতিবেশি। সম্প্রতি মহান ভারতের মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এ শুভেচ্ছা সফরের প্রাক্কালে আমরা শান্তি বন্ধুত্ব ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এ চুক্তি দুই দেশের মেহনতী মানুষের শুভেচ্ছা, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব এবং সংহতি বন্ধনকে মজবুত করবে। সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্যোগ মুহূর্তে পাশে এসে দাড়িয়েছিল। আমি সোভিয়েত রাশিয়া সফর করে এসেছি, সেখানে তাদের অকৃত্রিম আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সোভিয়েত নেত্রীবর্গ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজে সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আমি পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, স্কান্ডেনেভিয়ান দেশগুলি এবং অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ যারা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জোট বহির্ভূত সক্রিয় নিরপেক্ষতা ভিত্তিতে রচিত। বৃহৎ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাহিরে আমরা শান্তিকামী। আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সাথে সৎভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেও আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করবো। কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে শর্তহীন। আমরা জাতীয় সর্বভৌম ও সব জাতির সমমর্যাদা নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেও হস্তক্ষেপ করবেন না। এটাই আমাদের কামনা। দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানের শাসকরা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিচ্ছে না। তারা পাঁচ লক্ষ নীরিহ বাঙালিকে সন্ত্রাস ও দুর্দশার মধ্যে আটকে রেখেছেন। আমি বিশ্বব্যাপী বিবেকসম্পন্ন মানুষ ও বিশেষকরে মি. ভুট্টোর কাছে আবেদন করছি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। এই ইস্যুকে কোনোক্রমেই যুদ্ধ বন্দিদের সাথে সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না। কারণ তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে- যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যা ও অপরাধী। মানবিকতাকে লঙ্ণ করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে তাদের বিচার হবে। পাকিস্তানের সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের কাছে আমার আবেদন। ন্যূরেমবার্গ মামলায় আসামীদের থেকেও নিকৃষ্ট ধরনের এই অপরাধীদেরকে তারা স্বজাতি বলে ভাববেন না। যারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা দেশে ফিরে এসেছে। সাহায্য পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য আমরা কার্যকরী কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। বিনা মূল্যের ন্যায্য মূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ছিন্নমূল মানুষের মাথা গুজবার ঠাই করে দেয়ার জন্যে অস্থায়ী বাসগৃহ তৈরির কাজে হাত দেয়া হয়েছে। শশ্মান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামি দিনের মায়েরা হাসবে- শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো। আপনারা নিশ্চয় আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। ক্ষেত, খামার, কারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেত ভাবে আমরা চেষ্টা করি যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে। সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি। জয় বাংলা।

রেফারেন্স: ২৬ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ