স্বাধীনতার ফল সকলকেই দিতে হবে
ভারতরত্ন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শনিবার বলেন যে, অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ফলে অবশ্যই সকলকে ভোগ করতে দিতে হবে; স্বাধীনতাকে অবশ্যই করে তুলতে হবে অর্থপূর্ণ । বঙ্গভবন প্রাঙ্গণে তাকে দেয়া নাগরিক সম্বর্ধনায় মানপত্রের জবাবে তিনি একথা বলেন। বঙ্গবভনের সবুজ প্রাঙ্গণ সবুজ শাড়ির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্লাউজ পরে শাপলা শালুকে সাজানো মঞ্চে দাড়িয়ে তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন একই মঞ্চে বসেছিলেন নিবিষ্ঠ মনে।
এমন ঐক্য কোথাও দেখিনিঃ
শ্রীমতি গান্ধী স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণ যে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য প্রদর্শন করেছে আমি আর কোনো আন্দোলনেই তা দেখিনি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনেক মুক্তি সংগ্রামের সাথে জড়িত ছিলেন। তাছাড়া অনেক দেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস তাঁর জানা। কিন্তু সমগ্র জাতির এমন ঐক্য আমি কোথাও দেখিনি। তিনি বলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপনাদের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিলেন। কিন্তু তার আদর্শ আপনাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছে। সুতরাং কোনো শক্তিই আপনাদের অবদমিতো করতে পারবে না।
ভারতের সহযোগিতাঃ
পঞ্চান্ন কোটি ভারতবাসীর নেত্রী শ্রীমতি গান্ধী ভারতীয় সাহায্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা ভারতবাসী আপনাদের সাধ্যমতো সামান্য সাহায্য করার চেষ্টা করেছি মাত্র। কিন্তু স্বাধীনতার জন্যে আপনারাই স্বীকার করেছেন সর্বোচ্চ ত্যাগ।
গ্রামে ছড়িয়ে পড়ুনঃ
যুব সমাজকে লক্ষ্য করে শ্রীমতি গান্ধী বলেন, আপনাদের ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এবার আপনাদের দেশ গড়ার পালা। আপনারা মানব শক্তিকে বিচিত্র পথে সম্প্রসারিত করে দিন, কারিগরি শিক্ষায় উদ্যোগী হোন এবং গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ুন। তিনি বলেন, গ্রামে গঞ্জে অবশ্যই নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। নতুন জীবনের কাঠামো প্রস্তুত করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই আমাদের দেশকে আধুনিক দেশে পরিণত করব। তবে একই সাথে পুরাতনের শিকড়ও সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই বস্তি ও দূষিত পরিবেশের সম্প্রসারণ রোধ করতে হবে। শ্রীমতি গান্ধী বলেন যে, এমন বিত্ত্ববান সমাজ পর্যন্ত এ দিকটি উপেক্ষা করে চলে।
ঐতিহাসিক ঢাকাঃ
শ্রীমতি গান্ধী ঢাকা নগরীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে, এ উপমহাদেশে ঢাকা শহরের নাম বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় পর্যটকগণ ঢাকা নগরীর সমৃদ্ধির বিপুল চিত্র রেখে গেছেন। ঢাকার তাঁতিদের নৈপুণ্য বিশ্বব্যপী খ্যাতি অর্জন করেছিল। তিনি বলেন, এই ঐতিহাসিক ঢাকা আজ স্বাধীনতার অগ্নিস্পর্শে উজ্জীবীত একটি মহান নগরীমাত্র নয়- ঢাকা আজ সংগ্রামের প্রতীক, একটি মহান আদর্শের প্রতীক। তিনি বলেন যে, ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সদর দফতর নয়- এখন ঢাকা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি সুমহান প্রাণকেন্দ্র। ভালোবাসায় মুগ্ধ আমিঃ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মহানায়িকা ভারতের শ্রীমতি গান্ধী বলেন, আপনাদের সোনার বাংলার সম্প্রতি রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ সংক্ষিপ্ত সফরে আমি যে জায়গায়ই গিয়েছি সেখানেই মানুষের মুখমন্ডলে লক্ষ্য করেছি বন্ধুত্বের সুউষ্ণ আভা। বাংলার মানুষের ভালবাসা ও স্নেহ আমায় মুগ্ধ করেছে। ভারতবাসীর শুভেচ্ছা নিয়ে আমি এসেছি: শ্রীমতি গান্ধী বাংলাদেশের জনগণের উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বলেন যে, তিনি ভারতের সমগ্র মানুষের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা বয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন যে, ভারতের জনগণ বাংলাদেশকে এতো ভালোবাসে যে, তারা প্রত্যেকেই এদেশে আসতে আগ্রহী। কৌতুক করে তিনি বলেন যে, এ আগ্রহীদের সকলকেই যদি আসতে দেয়া হতো তাহলে বাংলাদেশে এক বিরাট শরণার্থী সমস্যা দেখা দিতে পারত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এখানে একা এসেছি সত্য তবে এক অর্থে আমার সাথে ভারতের সমগ্র জনতাই এখানে এসেছেন। আমাকে আপনারা যে সম্মান দেখিয়েছেন তাও সেই ভারতবাসীর প্রতি আপনাদের ভালবাসারই প্রকাশ । মানপত্র: প্রারম্ভে ঢাকার নাগরিক বৃন্দের পক্ষ থেকে স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন দফতরের মন্ত্রী জনাব শামসুল হক মহান ভারতের নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মানপত্র পাঠ করেন। মানপত্রে তিনি বলেন যে, অনেক রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রী গড়ে উঠেছে- কোনো ষড়যন্ত্রই তা নস্যাৎ করতে পারবে না। মানপত্রে বলা হয় যে, বহু রক্তের বিনিময়ে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে মৈত্রীর বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই মৈত্রীর পারাবতকে এশিয়া দিক দিগন্তে ছড়িয়ে দেব। আর তারই মাধ্যমে গড়ে উঠবে শান্তি ও সমৃদ্ধির নয়া এশিয়া।
রেফারেন্স: ১৮ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ