৬-দফার দাবি তুলল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য, তখন এই বাঙালিরাই বেশি বাধা দিতেছে
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শােষক শ্ৰেণী বুঝলাে এবার বােধহয় আর শােষণ করা চলবে না, তখন আবার ষড়যন্ত্র করল সেই লােকগুলি দিয়ে—যারা ইলেকশনের পূর্বে হক সাহেবের মাথায় চেপে, আওয়ামী লীগের কাঁধে পা রেখে ইলেকশনে পার হয়ে এসেছে। বৃদ্ধ হক সাহেবকে ব্যবহার করল এরা। যখন দ্বিতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলী শাসনতন্ত্র তৈয়ার করতে শুরু করল, আওয়ামী লীগের সদস্যরা সােহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে ভিতর ও বাহিরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে সংগ্রাম শুরু করল, তখন এই বাঙালিদের ভােট দিয়ে আমাদের দাবিকে ভােটে পরাজিত করে নতুন শাসনতন্ত্র গঠন করল। তখনও যদি বাঙালিরা এক হতে পারতাম তাহলে নিশ্চয়ই স্বায়ত্তশাসন দাবি আদায় করতে পারতাম। আজও যে আমাদের ওপর জুলুম হচ্ছে—মােহাম্মদ আলী (বগুড়া) সাহেব যদি আইয়ুব সাহেবের হাতে মন্ত্রীত্বের লােভে ধরা না দিতেন, তবে অনেকগুলি দাবি আদায় হতাে। আজও দেখুন, আওয়ামী লীগ যখন ৬-দফার দাবি তুলল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য, তখন এই বাঙালিরাই বেশি বাধা দিতেছে। মােনায়েম খাঁ সাহেব গভর্নর আছেন, কে তাকে তাড়াচ্ছে? তিনি চরম অত্যাচার করে চলেছেন। আমাদের গ্রেপ্তার, ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ, নিউনেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত, তার মালিককে গ্রেপ্তার, নারায়ণগঞ্জ ও তেজগাঁয় গুলি করতে একটুও মনে বাধলাে না তার। কাদের গ্রেপ্তার করছে? কাদের গুলি করে হত্যা করা হলাে? কে বা কারা শত শত ছাত্রের জীবন নষ্ট করল? তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিশ্চয়ই আসে নাই। যদি এই স্বায়ত্তশাসনের দাবি কৃতকার্যতা লাভ করে, তবে যারা অত্যাচার করল, তাদের ছেলেমেয়ে বংশধররা তার সুবিধা ভােগ করবে কিনা? যারা জীবন দিল তাদের বংশধররাই কি শুধু ভােগ করবে? আমাদের দুঃখের জন্য আমরাই দায়ী বেশি। আমার ঘরে থেকে যদি চুরি করতে আমিই সাহায্য করি সামান্য ভাগ পাওয়ার লােভে, তবে চোরকে দায়ী করে লাভ কি?
এই সব কথা বলতে বলতে জমাদার চলে এল, আর সিপাহিও এগিয়ে এল, আর সিপাহিও এগিয়ে এল। কয়েদিটা তাড়াতাড়ি সেলে চলে গেল। আমি চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থেকে আবার খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলাম।
কারাগারের রােজনামচা, ২৩ জুলাই ১৯৬৬