You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.03.17 | শক্তিশালী বাংলাদেশই আমাদের কাম্য | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

শক্তিশালী বাংলাদেশই আমাদের কাম্য

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন যে, আমরা বাংলাদেশকে একটি বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। শুক্রবার বিকেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের এক বৃহত্তম জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন যে, অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এক নতুন এশিয়া সৃষ্টি উদ্দেশ্যে নির্যাতিত মানবতার বোঝা সমানভাবে বহন করে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষ এক সাথে সংগ্রাম করে যাবে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে ওঠা প্রসঙ্গে বলেন যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যাতে নিজেরাই তাদের ভাগ্য নির্ধারণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তা দেখার জন্য ভারত সর্বদাই উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু অন্য একটি দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে প্রভাব বিস্তার ও কতৃত্ব আরোপের সুযোগ তাদের থাকা উচিত নয়। এই প্রসঙ্গে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সুখী ও সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে প্রতিভাত হওয়ার জন্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে নিজ নিজ দেশের আদর্শ ও ঐতিহ্য অনুসরণের উপদেশ দেন। তিনি বলেন যে, যদিও নানাবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মতের অভিন্নতা রয়েছে, তৎসত্বেও বিশ্বশান্তি স্থাপনের স্বার্থে উভয়কেই নিজস্ব মত ও পথ বেছে নিতে হবে। শ্রীমতি গান্ধী আশা প্রকাশ করেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ সদ্যমুক্ত বাংলাদেশে পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে পারবে। পথ যদিও বিপদসঙ্কুল বন্ধুর তবুও যে জাতি আত্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে দাসত্বের শৃঙ্খল মোচন করতে পেরেছে সে জাতি অদূর ভবিষ্যত যে কোনো বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হবে বলে শ্রীমতি গান্ধী দৃঢ় আশা পোষণ করেন। শ্রীমতি গান্ধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরদের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে, বাংলাদেশের যুবসমাজের অতুলনীয় বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। তিনি জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, আজ জনগণের বন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্মদিন। এই মহান দিনে তিনি জনগণকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মহাননেতা, যিনি মানবতার কল্যাণের জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। শ্রীমতি গান্ধী বিগত স্বাধীনতা আন্দোলনে উৎসর্গীকৃত প্রাণ ছাত্রলীগ ও মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। শ্রীমতি গান্ধী অত্যন্ত বলিষ্ঠ তার সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, পারস্পরিক সমঝোতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতেই ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এই বন্ধুত্ব দুইটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব। বাংলাদেশকে সাহায্য করার প্রশ্নে ভারত কেবলমাত্র তার আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। শ্রীমতি গান্ধী ভারতের জাতীয় ঐক্য রক্ষার প্রশ্নে মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহেরু, সুভাষ চন্দ বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, খান আবদুল গফফার খান ও মওলানা আজাদ প্রমুখ প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের মূল্যবান অবদানের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। শ্রীমতি গান্ধী বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণও শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন নেতা পেয়েছেন, যিনি ইতোমধ্যেই কিংবদন্তীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর হাতকে শক্তিশালী করা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। ঢাকায় প্রাপ্ত ঐতিহাসিক সম্বর্ধনার জবাবে শ্রীমতি গান্ধী বলেন যে, তিনি একথা ভাল ভাবে জানেন যে, আজকের এই সম্বর্ধনা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয় বরং এই সম্বর্ধনা একটি জাতির সেই দেশের প্রতিনিধির উদ্দেশ্যে যে দেশ তার আদর্শের জন্যে বিশ্বের কাছে সুপরিচিত। তিনি বলেন যে, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর রক্তধারা মিলেমিশে একাকার গেছে। অতএব দু’দেশের জনগণের ভাগ্যেন্নয়নের জন্য দুই দেশের এক সঙ্গে কাজ করা আজ আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। শ্রীমতি গান্ধী বলেন যে, একটি বিশেষ আদর্শ ও মানবতার সেবার ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যে, এই দুই দেশের বন্ধুত্বের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও ফাটল ধরাতে পারে। শ্রীমতি গান্ধী বলেন, জন্মের প্রথম লগ্নই হচ্ছে যে কোনো স্বাধীন জাতির জন্য একটি কঠিন সময়। স্বাধীনতাই কেবল মাত্র সমস্যার সমাধান করতে পারে না। দেশ ও জাতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রত্যেককে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করে যেতে হবে। যখন আপনারা সোনার বাংলা গঠনের এই মহান কাজে আত্মনিয়ােগ করবেন তবে এই মহৎ পথে চলতে গিয়ে আপনাদের সামনে অনেক প্রলোভন আসবে। কিন্তু এই প্রলোভন বাংলাদেশের সাহসী, উৎসাহী ও প্রতিভাশালী জনগণের চলার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারবে না বলে শ্রীমতি গান্ধী দৃঢ় আশা পোষণ করেন।

রেফারেন্স: ১৭ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ