You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.05.09 | শেখ মুজিবের ঘােষণা | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

শেখ মুজিবের ঘােষণা

‘শক্তিশালী কেন্দ্র নয় শক্তিশালী পাকিস্তানই আমাদের কাম্য। তাই মুক্তিসনদ হিসাবে ৬-দফা দাবী পেশ করা হইয়াছে। আর এই দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত। কোন কিছুই আমাদের সঙ্কল্প হইতে বিচ্যুত করিতে পারিবে না।’ গতকাল (রবিবার) নারায়ণগঞ্জ টাউন হল ময়দানে নয়নাভিরাম ও সুশৃংখল পরিবেশে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করিয়া আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান তেজদৃপ্ত কণ্ঠে উক্ত ঘােষণা করেন। গতকাল নারায়গঞ্জের জনসভারই সর্বপ্রথম ৬-দফার প্রণেতা শেখ মুজিবর রহমানকে সাড়ে পাঁচ কোটির নহে—সমগ্র পাকিস্তানের দশ কোটি জনগণের নেতা বলিয়া ঘােষণা করা হয়। এই উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জের মানুষের শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি আওয়ামী লীগ কর্তৃক শেখ মুজিবর রহমানকে ৬-দফা খােদিত একটি স্বর্ণতারকায় ভূষিত করা হয়। সভায় আদমজী শ্রমিকদের পক্ষ হইতে শেখ মুজিবকে পাটের তৈরী মালায় ভূষিত করা হয়। বস্ত্রমিল শ্রমিকদের পক্ষ হইতে আওয়ামী প্রধানকে মাল্যভূষিত করা হয়। ইহাছাড়া পাটব্যবসায়ী, সিটি আওয়ামী লীগ এবং জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতেও তাঁহাকে মাল্যভূষিত করা হয়। ৬-দফার প্রতীক। হিসাবে শেখ মুজিব ৬টি শান্তি কপােত উড়াইয়া দেন। সভাশেষে ৬-দফার প্রতীক। হিসাবে ৬টি মশাল জ্বালাইয়া সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করা হয়।
গতকাল জনতার অনুরােধে নির্ধারিত সময়ের অর্ধঘণ্টা পূর্বেই সভার কাজ শুরু করিতে হয় এবং রাত ৮টা পর্যন্ত সভার কাজ চলে। ৬-দফা দাবী আদায়ের অগ্নিশপথ গ্রহণ করার জন্য আদমজী জুট মিলে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। মিছিলসহকারে সভায় আগমন করে। ইহাছাড়া শীতলক্ষ্যা, নলুয়া, পাইকপাড়া, দেওভােগ ও হাজিগঞ্জ ইউনিয়ন হইতে এবং বিভিন্ন মহল্লা হইতে মিছিল সহকারে জনতা সভায় যােগদান করে। এই সকল মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের হাতে ৬-দফা দাবীর সমর্থনে ও অন্যান্য দাবী-দাওয়া সম্বলিত বিভিন্ন ফেষ্টুন শােভা পাইতেছিল। সন্ধ্যা প্রায় ৭টার সময় বিড়ি শিল্পের শ্রমিক ও মালিকদের একটি মিছিল আসিয়া সভায় শামিল হয়। মুহর্মুহু করতালির মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, শক্তিশালী, সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা পেশ করি। কিন্তু আমাদের বিদেশীর চর এবং পাকিস্তানের ধ্বংসকারী বলিয়া আখ্যায়িত করা হইতেছে। কিন্তু এসব আখ্যা আমাদের কাছে নূতন নয়। পাকিস্তানের ভিত্তি লাহাের প্রস্তাবের প্রণেতা শেরেবাংলা এবং পাকিস্ত নের অন্যতম স্রষ্টা শহীদ সােহরাওয়ার্দীকেও উক্ত আখ্যায় আখ্যায়িত হইয়া পৃথিবী হইতে বিদায় নিতে হইয়াছে।
সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিপুল জনতাকে লক্ষ্য করিয়া শেখ মুজিব এক এক করিয়া ৬-দফা কর্মসূচীর বিস্তারিত ব্যাখ্যাদান করিয়া তুমুল করতালির মধ্যে ঘােষণা করেন, ৬-দফা দাবী উত্থাপনের পর হইতে নূতনভাবে আমার বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দায়ের কার হইতেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের জানিয়ে রাখা দরকার যে, কোন কিছুতেই আমাদের ৬-দফা আদায়ের প্রতিজ্ঞা হইতে বিচ্যুত করা যাইবে না। নিবিষ্টচিত্ত শ্রোতাদের লক্ষ্য করিয়া আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, আওয়ামী লীগের ১৪ শত কর্মী ৬-দফা আদায়ের জন্য কারাভােগসহ যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিয়াছেন। এ সময় জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন তিনি, প্রয়ােজনবােধে আপনারাও কারাভােগে প্রস্তুত আছেন কি? সঙ্গে সঙ্গে একযােগে লক্ষ হস্ত উত্তোলন করিয়া জনতা কারাভােগের প্রস্তুতির শপথ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব খাদ্যসহ বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, বাধ্যতামূলক লেভী ধরা হইয়াছে, তাই সার্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থাও প্রবর্তন করা উচিত ছিল। তিনি বলেন যে, লেভী ধরিয়া সরকারী গুদামে ধান-চাউল জমা করা হইয়াছে বলিয়া আজ বাজারে ধান-চাউলের অভাব দেখা দিয়াছে। তিনি অনতিবিলম্বে মােকাবিলা করিয়া দুর্দশাপীড়িত মানুষকে রক্ষা করার দাবী জানান।
৬-দফার সমালােচকদের লক্ষ্য করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, ৬-দফায় শ্রমিক-কৃষকদের কথা নেই, এই সকল সমালােচকদের জানাইয়া দিতে চাই যে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচী দেখুন। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। অতএব, তাহাদের ঐসব সমালােনা অর্থহীন। কেননা সমাজতন্ত্রের মধ্যেই দেশের শ্রমিক-কৃষকের সমস্যার সমাধান নিহিত আছে।

জহীররুদ্দীন
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জনাব এ. কে. এম শামসুজ্জোহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব জহীরুদ্দীন বলেন যে, ৬-দফার জনপ্রিয়তাই ক্ষমতাসীন মহলকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছে। তুমুল করতালির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন যে, ইতিমধ্যেই করাচী আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ৬-দফা দাবী অনুমােদন করিয়া উহা আদায়ের জন্য সংগ্রাম পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করিয়াছে। ৬-দফার জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে দেখিয়া ক্ষমতাসীনরা বেসামাল হইয়া ৬-দফার প্রণেতা শেখ মুজিবর রহমানকে হয়রানি করিতেছে। তবে যত হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক না কেন ৬-দফার সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে এবং ইনশাআল্লাহ আমরা সফল হইব।

মিজানুর রহমান চৌধুরী
সরকারী নীতির তথ্যভিত্তিক সমালােচনা করিয়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এম. এন. এ বলেন যে, প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের পূর্বে জনাব আইয়ুব খান প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে, কার্টেলের অবসান ঘটাইবেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত উহার কোন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না।
জনাব চৌধুরী বলেন যে, বর্তমান শাসকরা অহরহ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ করিয়া থাকেন। কিন্তু আপনারা সকলেই জানেন, শেরেবাংলা জীবনে ওকালতী করিয়া বহু অর্থ আয় করা সত্ত্বেও মৃত্যুকালে কোন টাকা-পয়সা রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। মরহুম জনাব সােহরাওয়ার্দী ওকালতী করিয়া মাসে ৩০/৪০ হাজার টাকা রােজগার করিতেন, কিন্তু মৃত্যুকালে তিনি ১৩ হাজার টাকা ঋণ রাখিয়া গিয়াছেন। খাজা নাজিমুদ্দিন ও জনাব মােহাম্মদ আলীর ছেলেরা চাকুরী করিয়া সংসার চালাইতেছেন। কিন্তু বর্তমান আমলে দেখা যাইতেছে যে, ৫/৬ বছর আগেও যাহারা ৬০০ টাকা মাইনায় চাকুরী করিত, আজ তাহারা কোটি কোটি টাকার মালিক। মুষ্টিমেয় লােককে ধনী করার নীতির সমালােচনা করিয়া জনাব চৌধুরী বলেন যে, মশলা আমদানীর জন্য একটি মাত্র লােককে ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকার লাইসেন্স দেওয়া হইয়াছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকিলে উক্ত টাকার লাইসেন্স ২২ হাজার অথবা উহা অপেক্ষাও বেশীসংখ্যক ছােট ব্যবসায়ীকে বণ্টন করিয়া দিত। ফলে, একজন মুনাফার পাহাড় গড়ার সুযােগ পাইত না।

রফিকুল হােসেন
বিশিষ্ট আওয়ামী নেতা জনাব রফিকুল হােসেন বলেন যে, ৬-দফা পাকিস্তানের ১০। কোটি লােকের মুক্তি সনদ। তাই, ইহার প্রণেতা শেখ মুজিবর রহমানও ১০ কোটি পাকিস্তানীর সত্যিকারের নেতা।

দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ মে ১৯৬৬